রাজধানীতে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারীরা
বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে মিরপুরের বাসা থেকে বের হলে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন আহমেদ মাহী বুলবুল। এসময় দুর্বৃত্তরা তার কাছ থেকে একটি মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বুলবুলের মৃত্যু হয়। বুলবুল মূলত দন্ত চিকিৎসক, এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজ করতেন। তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ব্যবসায়িক কাজে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন, এ ঘটনা পরিকল্পিতও হতে পারে।
গত ২২ মার্চ রাতে রাজধানীর গুলিস্তানে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মো. জাহাঙ্গীর মিয়া (৫৫) নামে পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) আহত হয়েছেন। গুলিস্তান টিএনটি অফিসের সামনে এ ঘটনার পর তাকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এই এলাকা থেকে ২৩ মার্চ রাতে ইমন ও জুয়েল নামে দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর তাদেরকে বংশাল থানায় নিয়ে গেলে সেখানে সুইস গিয়ার ছুরি দিয়ে পাঁচ পুলিশ সদস্যকে তারা এলোপাথাড়ি আঘাত করে। এতে এক কনস্টেবল গুরুতর আহত হন।
এভাবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়তই বিচ্ছিন্নভাবে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এসব ঘটনায় দেখা যায় ছিনতাইকারীরা আগের তুলনা বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। পথে কিংবা বাসের জানালা দিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের জিনিসপত্র। রিকশায় যাতায়াতের সময় মোটরসাইকেল থেকে ছোঁ মেরে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ও জিনিসপত্রসহ ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার ঘটনা কম ঘটছে না। এতে আহত এবং নিহতের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। কিন্ত এভাবে কী পরিমাণ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে জানা যাচ্ছে যারা মামলা করতে যাচ্ছেন তাদের মামলা নেয়া হচ্ছে না, আবার মামলা নেয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুরির মামলা নেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অধিকাংশ ভুক্তভোগীই পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বর্ণলতা মন্ডল (২১)। সোমবার (১৪ মার্চ) সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে কার্জন হলে যাওয়ার পথে ছিনতাইকারীররা তার মুঠোফোন ছিনিয়ে নেন। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে তারা মামলা না নিয়ে জিডি করার পরামর্শ দেন। জিডিতে 'ছিনতাই হয়েছে' লেখার পর তা কেটে 'চুরি হয়েছে' উল্লেখ করে থানা পুলিশ।
ভুক্তভোগী স্বর্ণলতা মন্ডল টিবিএসকে জানান, চুরি উল্লেখ করে জিডি করার পর এ ঘটনায় মামলা দায়েরের জন্য একাধিকবার বলার পরও তারা মামলা নেয়নি। পরে সিনিয়র অফিসারকে অবগত করার পর ঘটনাটিকে চুরির মামলা হিসেবে নেয় তারা। তবে চুরির মামলা নিয়েও ফোন উদ্ধারে তাদের কোন অগ্রগতি নেই।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কাজল হোসেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায় গেলে মূল সড়কের পাশে কয়েকজন তরুণ তাকে ঘিরে ধরে এবং ফোন ছিনিয়ে নেয়। এরপর তাদের একজনকে ধরে তিনি ব্যস্ত এলাকার দিকে যেতে থাকেন কিন্তু ততক্ষণে চক্রটির বাকি সদস্যরা উপস্থিত হয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে আঘাত করতে চাইলে তিনি সরে আসেন।
ভুক্তভোগী কাজল এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে টিবিএসকে বলেন, চক্রটি আমাকে ঘিরে ধরার পর আশপাশে প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছিলো তখন। কিন্ত তাদের কাছে বারবার সাহায্য চেয়েও পাইনি। চক্রটির হাত থেকে মুক্ত হয়েই আমি ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চাইলে দেড় ঘণ্টা পর পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। তারা আমাকে জানায় চক্রের কোন সদস্য ধরা পড়লে তাকে জানানো হবে।
তবে থানায় মামলা করলেই দোষীদের যথাযথ বিচার কিংবা ফোন ফিরে পাওয়া যাবে কিনা সেই আশংকা থেকে তিনি মামলা বা জিডি করেননি বলেও জানান।
কাজলের মতো জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে সাহায্য চাইছেন বহু ভুক্তভোগী। ৯৯৯-এর তথ্যে দেখা যায়, আগের তুলনায় গত কয়েক মাসে ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীদের কলের পরিমাণ বাড়ছে। এরমধ্যে রাজধানীতে গত ডিসেম্বরে ১১২টি, এরপর কিছুটা বেড়ে জানুয়ারিতে ১৩৪, ফেব্রুয়ারিতে ১২৮ এবং মার্চের ১২ তারিখ পর্যন্ত ৬৬টি কল এসেছে। তবে সারাদেশের তুলনায় ঢাকায়ই সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে ৯৯৯-এর তথ্যে।
এতে দেখা যায়, ডিসেম্বর ১৬১টি কলের ১১২টি ছিল রাজধানীর এবং জানুয়ারিতে ২০৭ ও ফেব্রুয়ারিতে ২১৮টি কল ছিল সারাদেশের।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর গণমাধ্যম কর্মকতা ইন্সপেক্টর আনোয়ার সাত্তার টিবিএসকে বলেন, আমাদের কাছে নিয়মিতই ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীদের কল আসছে। এটি শুধু ছিনতাই বেড়ে যাওয়াকেই ইঙ্গিত করছে না, ৯৯৯-এর প্রতিও যে আস্থা বাড়ছে এজন্য বেশি কল পাচ্ছি। কলের পর স্থানীয় পুলিশের সাথে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দেই। তবে অনেকেই সকালের ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাহায্য চান বিকেলে, এমন কলেও তাদেরকে থানার ডিউটি অফিসারের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি আইনগত সাহায্য পাওয়ার জন্য।
তবে ৯৯৯ থেকে থানায় যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার পরও মামলার সংখ্যা দেখে ছিনতাইয়ের চিত্র বোঝার উপায় নেই। সবচেয়ে বেশি কল এসেছে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ থেকে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ৩০টি কল আসলেও মামলা হয়েছে মাত্র ৯টি। এভাবে ডিএমপির ৫০ থানা এলাকায় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে ৩২৯ জন ভুক্তভোগীর কল থাকলেও মাত্র ৩৭টি মামলা দায়ের হয়েছে থানাগুলোতে। এ তথ্য থেকে ধারণা করা যাচ্ছে অধিকাংশ ছিনতাইয়ের ঘটনাকে চুরি বলে মামলা নেয়া বা জিডি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে। ফলে ছিনতাইয়ে জড়িত চক্রের সদস্যরা ধরা না পড়ায় এ অপরাধ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরীতে মামলা হয় ১৪৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬টি, ২০১৯ সালে ১৫৫টি, ২০১৮ সালে ২১৬টি, ২০১৭ সালে ১০৩টি, ২০১৬ সালে ১৩২টি, ২০১৫ সালে ২০৫টি ও ২০১৪ সালে ২৬৫টি মামলা দায়ের হয়।
ডিএমপির একটি সূত্র টিবিএসকে বলেছেন, ছিনতাই প্রতিরোধে এলাকাভিত্তিক টহল জোরদারসহ বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে এসব নির্দেশনার পরও প্রায় সব এলাকার চিত্র আগের মতোই। নিয়মিত টহলের পরিবর্তে আগের মতোই দায়সারা দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোঃ ফারুক হোসেন টিবিএসকে বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। থানার টহল জোরদার ছাড়াও পুলিশের অন্য ইউনিটগুলোও কাজ করছে। এছাড়া ভুক্তভোগীদের মামলা নেয়ার জন্য থানাগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ছিনতাইয়ের অধিকাংশ ভুক্তভোগীই মামলা করতে আসেন না। ফলে সব ঘটনায় আমরা অবগত হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। মামলা নিচ্ছে না এমন কোন প্রমাণ পাওয়া গেলে ডিএমপি ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে রাজধানীতে বেশি ছিনতাই হচ্ছে এমন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুর থানা এলাকা। জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (মোহাম্মদপুর জোন) মুজিব আহম্মদ পাটওয়ারী টিবিএসকে বলেন, নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকা হওয়ায় বেশি ছিনতাই হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন অস্ত্রের মুখে মোবাইল নিয়ে নদীর ওপারে চলে যায়। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে কয়টি মামলা হয়েছে তার প্রায় সব আসামিকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। কিন্ত তারা জামিনে বের হয়ে ফের একই অপরাধে জড়াচ্ছে।
রাজধানীর যেসব এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা সবচেয়ে কম তার মধ্যে রয়েছে কলাবাগান থানা এলাকা।
এদিকে রাজধানীতে চুরি–ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে এবং ঈদকে সামনে রেখে আরও বাড়তে পারে বলে ডিএমপির মাসিক অপরাধ সভায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে অপরাধীদের তালিকা তৈরি করে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শুধু পাহারা দিয়ে অপরাধ দমন করা যায় না, অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে অপরাধ প্রতিরোধ করতে হবে, এটাই আসল পদ্ধতি।
তবে কঠোর নির্দেশনার পরও ছিনতাই ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে ডিএমপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাদের মতামত পাওয়া যায়নি।