বাকল্যান্ড বাঁধের দুই নরসুন্দর
নয়াচরে বিদ্যুত গেছে বছরখানেক হয়। 'বোঝেন তাইলে ২০ বছর আগে কেমন আছিল? আমার ওস্তাদের নাম আকাশ। আমি কোনোদিন স্কুলে যাই নাই। আমার নিজের কোনো জমি-জিরেত নাই। আমার আরো দুই ভাই আছে। বাবার ১৫ গণ্ডা (প্রায় বিঘা) জমি আছে কিন্তু আমারে কিছু দেয় নাই। আমি মাটি ভাড়া নিয়া ঘর তুইল্যা থাকি। ভিটি কাচা। দুই ছেলে মেয়ে। ছেলেটা বড় মানে ১৩ বছর আর মেয়েটার ১১ বছর হবে। আকাশ ওস্তাদ যা শিখাইছে তা সম্বল কইরা ঢাকায় আসছি প্রায় ১৭-১৮ বছর। এই এক জায়গাতেই আছি।' কাদের খন্দকার বলছিলেন।
কাদের খন্দকারের বয়স ৪২ হবে। বিয়ে করেছিলেন ২৭-২৮ বছর বয়সে। লেখাপড়া কিছুই জানেন না। টিপসই দিয়ে কাজ চালান। বাবা-মা জীবিত আছেন। বাড়ি মাদারিপুরের নড়িয়ার নয়াচরে। মাসে একবার বাড়ি যান মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর ব্রিজ পার হয়ে টঙ্গীবাড়ির সর্বদক্ষিণের দীঘিরপাড় হয়ে। দীঘিরপাড় থেকে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার পর ২৫ মিনিট হাটলে তাঁর নয়াচরের বাড়ি পৌছানো যায়।
কাদের বছরে ভিটি ভাড়া দেন পাঁচ হাজার টাকা। ঘরে তাঁর টেলিভিশন নাই। সংসারে তাঁর একলার রোজগার।
প্রশ্ন করি: প্রতিদিন কত হয়?
কাদের: কাল (৩০ মার্চ) ৪০০ টাকা ইনকাম হইছে।
সদরঘাট থেকে পূবমুখে হাঁটা দিলে লালকুঠি, শ্যামবাজার পার হয়ে উল্টিনগঞ্জ মসজিদের অল্প আগে একদম বুড়িগঙ্গার পাড়ে একটা বটগাছ আছে। গাছটার বয়স বেশি নয় তবে এই একই জায়গায় মনে হয় বয়সী আরেকটা বটগাছ ছিল। তারই ছানাপোনা এটি। অল্প যেটুকু ছায়ার বিস্তার তার মাঝেই তিনজন নরসুন্দর মানে ক্ষৌরকার, পর পর মাঝারি গড়নের একটা করে আয়না ধরে দাঁড়ান। কাদের খন্দকার তাদেরই একজন। কাদেরের সম্বল একটি লোহার চেয়ার যার গদী মোটা, নদীর ধারের দেয়ালটি তার তাকের কাজ দেয়। সেই তাকে ম্যাটাডোর কোম্পানীর ৫১০ এমএলের একটি শেভিং ক্রিম, দুটি চিরুনি ( একটি মোটা দাতের অন্যটি চিকন দাতের), একটি কাচের আফটার শেভ লোশন, একটি তোয়ালে, পানি রাখার জন্য দুটি কনডেনডস মিল্কের কৌটা ও দুটি কেচি। কাদেরের পরনে হালকা নীল রঙের টেট্রনের বেপারী পাঞ্জাবী ও চেক লুঙ্গি, পায়ে চপ্পল।
আবার প্রশ্ন: কতক্ষণ কাজ করতে পারেন?
সমীর শীল: যতক্ষণ আলো থাকে।
উল্লেখ্য কাদেরের ঠিক পরের আস্তানাটিই সমীর শীলের। লম্বা গড়নের মানুষটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫-৬ বছরের ছিলেন। বাড়ি খুলনায়। তাঁর কাছে জানা গেল, বৃহস্পতিবারে কিছু বেশি কাস্টমার পাওয়া যায়। সমীরের গায়ে হাফ শার্ট ও পায়ে রাবারের স্যান্ডেল।
প্রশ্ন এবার তৃতীয়জনকে: চুল-দাড়ি কাটাতে কত টাকা করে নেন?
কাদের খন্দকার: আমরা তো নেই না আমাগো দেয়। কেউ ৪০ টাকা, বড়জোড় পাই ৫০ টাকা।
প্রশ্ন: কারা আপনাদের কাস্টমার?
কাদের: লেবার, বাইন্ডার, পাইকার, সরদার, বাবুর্চি, ভ্যানওয়ালা, ফেরিওয়ালা-এরা।
প্রশ্ন: বৃহস্পতিবারে কাস্টমার বেশি হয় কেন?
কাদের: অনেকে বাড়ি যায়। আবার শুক্রবারে জুম্মাবার।
উপরের এই আলাপ হয়েছে দুদফা যাওয়ার পর। এর আগে আমি আশপাশে ঘুরে বেড়ালাম। বটগাছের সমীরদের সেলুন এলাকার এক পাশে আয়না ঝোলানোর দেয়াল পাড় হলে একদিকে সেলিম হাজীর শেড, এরপরে ইক্ষুর খোলা আড়ৎ। জায়গাটা পুরো ভ্যানওয়ালাদের দখলে। এরা পাইকারি দামে শাক-সবজি কিনে নেওয়ার পর ভ্যানগুলো মহল্লায় ছড়িয়ে পড়বে বিক্রি করতে। এর মধ্যে একজন ১৫ টাকা কেজি দরে ২০ কেজি উচ্ছে কিনে ফিরলে লোকেরা বেশ উল্লাস দেখাল-দাও মারছ মিয়া, তোমার কপাল ভালো। দাঁড়িয়ে দেখলাম।
দেখলাম, শ্যামবাজারের ঘাটগুলো দিয়ে একের পর এক পুইশাকের, ডাটাশাকের, ধনেপাতার, কুমড়ার, লাউয়ের ট্রলার আসছেই। একটা পুরো কুমড়া বোঝাই ট্রলার দেখা বেশ মজার ব্যাপার। অদূরেই ঈগল, সুন্দরবন নামের দূরপাল্লার লঞ্চগুলো বিশ্রাম নিচ্ছে। রাতভর কীর্তনখোলা, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা বেয়ে সকালেই কি না পৌঁছেছে ঢাকায়। এর মধ্যে তিনতলা একটা লঞ্চ যাত্রী বোঝাই করে ছাড়ল সদরঘাট। লঞ্চটিতে চাঁদ খচিত পতাকা। কে একজন বললো, সকাল থেকা অনেকগুলা গেল। কই যাচ্ছে? জিজ্ঞেস করে উত্তর পেলাম, লেংটার মেলায়। মধ্য চৈত্রে চাঁদপুরের বেলতলীতে সোলেমান শাহ লেংটার মাজার ঘিরে ৭ দিন ব্যাপী মেলা বসে। লালসালু পরা বাউলা টাইপের মানুষদের মিলনমেলা সেটি। সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লঞ্চ ছাড়ে এসময় ভক্তদের নিয়ে। ভক্তরা বলেন, লেংটা মানে জিরো। মানে সোলেমান শাহ লোভ, কাম, হিংসা ইত্যাদি সকল রিপুর উর্ধ্বে উঠে গিয় শূণ্য অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি জিরো মানে লেংটা মানে সব লালসা থেকে মুক্ত।
ঘোরাঘুরি করে সাড়ে দশটায় আবার গেলাম। সমীর আর কাদের দুজনকেই পেলাম। শুরুর আলাপ বলেছি। এবার বাকিটা বলি-
সমীরের চেয়ারটি পুরোই কাঠের, তবে এটার গদীও মোটা। সমীর চেয়ারে তারকাটা লাগাচ্ছিল। আমি উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলাম, এতো বেলা করলেন কেন? আমি সকালে এসে ঘুরে গেছি। সমীর বলেন, 'সকালে তো বসার সুযোগ থাকে না। সবজির পাইকার-বেপারীরা জায়গা দখল করে থাকে।'
কাদের এসেই ভাত, ডাল আর ভর্তা খেয়েছেন ৩০ টাকার। এর আগে তার গ্রামের বাড়ি শ্বশুরবাড়ির আলাপে হয়েছে। এখন বলি সে কোথায় থাকে: কাদের থাকেন লোহারপুলে একটা মেসে। দিনে পঁচিশ টাকা ভাড়া পড়ে। সারাদিন একরকম খেয়ে না খেয়েই দিন কাটে তাঁর। রাতে কেবল একটু ভালো যা খান। একজন এসে বাটি-ভাত দিয়ে যান। দাম পড়ে ৪০ টাকা। এটাই বাটি-ভাতের লোয়েস্ট লেভেল। ৭০, ৬০ আর পঞ্চাশ টাকারও বাটি-ভাত আছে তবে কাদের যেমন আয় করেন তেমনই খেতে পারেন। কাদেরের পছন্দ বাইলা মাছ। এখানে মাঝে মধ্যে পাংগাস পান। কাদের কোনোদিন সিনেমা দেখেননি। গান শোনেন না।
বকি আলাপ কাদের আর সমীরের সঙ্গে:
প্রশ্ন : তাহলে অবসর কাটান কিভাবে?
কাদের: অবসর আবার কি!
প্রশ্ন : মানে আনন্দ করেন না?
কাদের: কাস্টমারদের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা যা হয় সেটাই আনন্দ।
প্রশ্ন: আপনার বন্ধু-বান্ধব কয়জন?
কাদের: নাইতো।
প্রশ্ন: ছেলেমেয়েরা ভালো খাওয়া বা জামা কাপড়ের জন্য বায়না করে না?
কাদের: তারা তো জানে আমি কেমন রোজগার করি, বায়না সেরকম ধরে না।
প্রশ্ন: শশুরবাড়ি যান না?
কাদের: যাই। তাদের অবস্থাও ভালো না।
কাদের বললেন, ঢাকা শহরে থাকা খাওয়া বাবদ দিনে দেড়শ টাকা চলে যায়। কোনো কোনোদিন দেড়শ টাকা রোজগারও হয় না। তাহলে ছেলেপুলে নিয়ে চলি কিভাবে? কিসের টেলিভিশন, কিসের আনন্দ, কিসের কি?
কাদেরের এক কাস্টমার
মানুষটা সৈনিকদের মতো দেখতে-উঁচা, লম্বা, টান টান শরীর। মুখে খোচা খোচা দাড়ি আর গোফ। গাত্রবর্ণ তামাটে। ছাপা হাফ শার্ট গায়ে। তার বাড়ি উত্তরবঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের বছরে জন্ম। নাম স্বাধীন। টমেটোর বেপারী তিনি। ফুট সেলুনে চুল-দাড়ি কাটাতে লজ্জা পাচ্ছেন মনে হলো। বলেও ফেললেন, 'কপাল খারাপ আসলে। ২০০৯ সালে ৪০ লাখ টাকা নষ্ট হয়েছে। অথচ কুচবিহারে আমার দাদার ১০০ বিঘা জমি ছিল কিন্তু তিনি ভারতের নাগরিকত্ব নিতে পারেননি। আমার এক চাচাতো ভাই আমার এক মাসের ছোট নাম ফায়ার, বাড়িতে নাপিত ডেকে দাড়ি-গোফ কামায়। আদম ব্যবসা করতাম। দুবাইতে, সিঙ্গাপুরে লোক পাঠাতাম আর তাতেই বিপদে পড়লাম। এখন বড় ছেলেটাকে বিদেশে পাঠাতে পারলে একটু বাঁচি।'
বড়জোড় ১৫ মিনিট লাগলো কাদেরের। স্বাধীনকে সুন্দর বানিয়ে ফেললেন। কামানো মুখে তাকে ঝকঝকে দেখাচ্ছিল। স্বাধীন আয়নায় চেহারা দেখে খুশি। আফটার শেভের গন্ধও ভালো লাগল তার। ২০ টাকা দিলেন কাদেরকে। তারপর আরো একজন এলেন, বয়স তার ভালোই মনে হলো। তিনি কাছের এক বাইন্ডিং কারখানায় কাজ করেন, বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে।
জানতে চাইলাম, এখানে গোফ দাড়িয়ে কাটিয়ে সুবিধা কী?
লোকটি: সেলুনে তো চুল কাটাতেই ৭০-৮০ টাকা নেয়, সঙ্গে দাড়ি-গোফ ধরলে ১০০ টাকা। এখানে ৫০ টাকায় সব কাজ সারা যায়। এটাই সুবিধা।
বেলতলী মেলার আরেকটা লঞ্চ ছাড়ল। কাদের কি মেলায় যাবেন? ভাবলাম জিজ্ঞেস করি। কিন্তু একটু সংকোচ লাগলো। জীবিকার ধাক্কায় মানুষটার জীবন টলোমলো। মেলায় যাওয়া মানে তার অন্তত একদিনের ইনকাম নষ্ট, তবু কি মানুষটার চায় না মন একটু আনন্দ করতে? একটু কি খুশি হওয়ার ফুরসত তার মিলবে এ জীবনে?
সাতপাঁচ ভেবে তারপর বললাম, কাদের ভাই একটু চা খাবেন? এনে দিই?
কাদের রাজি হলেন না। অনুরোধ করেও রাজি করাতে পারলাম না। বুঝিবা এটুকু বিলাসিতাও তার মানায় না।