‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডে সহায়তা বজায় রাখবে এনবিআর
স্থানীয় উৎপাদনশীল খাতে 'মেড ইন বাংলাদেশ' লেবেলের পণ্য তৈরি করে এমন খাতে আগামী অর্থবছরেও নীতি সহায়তা দেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)।
আমদানি নির্ভরতা কমাতে এ লক্ষ্যে স্থানীয় থ্রি হুইলার উৎপাদনে ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে এনবিআর। একইভাবে পিভিসি পাইপের কাঁচামাল উৎপাদনেও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ার কথা ভাবছে সংস্থাটি।
খাত সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে পিভিসি পাইপের বাজারের আকার প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয়ভাবে পিভিসি পাইপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও এর মূল কাঁচামাল রেজিন পুরোটাই আমদানিনির্ভর।
এছাড়া ব্যবসা পর্যায়ে (মূলত পাইকার, ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটর) বিদ্যমান ৫ শতাংশ ট্রেড ভ্যাট এক থেকে দুই শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনাও রয়েছে, যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি ০.৫ শতাংশ করা। পাশাপাশি হোটেল ও রেস্টুরেন্টের ব্যবসায়ে ভ্যাট হারেও ছাড় আসতে পারে।
এনবিআরের বাজেট সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান ভ্যাট আইনকে আরো আরো ব্যবসাবান্ধব করতে বেশকিছু ধারায় সংশোধন আনার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে রাজস্ব আদায়কারী এ সংস্থাটির।
সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে পাওয়া বাজেট প্রস্তাব তারা পর্যালোচনা করছেন। তবে যে প্রস্তাবই তৈরি হোক, তা অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর চূড়ান্ত হবে।
স্থানীয় শিল্পের প্রসারে এনবিআরের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বিস্তৃত করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহাম্মদ রুমাতুল মুনীম।
গত মাসে একাধিক প্রাক বাজেট সভায় তিনি বলেন, এনবিআর ইমপোর্ট সাবস্টিটিউট স্থানীয় উৎপাদনমুখী শিল্পের প্রসারে সহযোগিতা করতে চায়। তবে অতীতে যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তাতে কী ফল এসেছে, তাও এনবিআর খতিয়ে দেখছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে থ্রি-হুইলার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নেই। দেশব্যাপী যে বিপুল সংখ্যক থ্রি-হুইলার চলে, তা আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত অটোরিকশার সংখ্যা ৩ লাখ ৬ হাজার।
বর্তমানে থ্রি-হুইলার আমদানিতে সবমিলিয়ৈ ৯০ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হয়। উৎপাদনকারীদের জন্য বিদ্যমান সুবিধা অনুযায়ী, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করলে তার শুল্ক-কর হবে ৪৫ শতাংশ। আর নতুন করে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি হলে তা নেমে দাঁড়াবে প্রায় ৩৩ শতাংশে।
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় অটো কোম্পানির একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি পেলে আমদানি ও উৎপাদনে কর হারের যে ব্যবধান তৈরি হবে, তাতে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।
আরেকটি হলো পিভিসি পাইপ, আবাসিক ভবনের পানির পাইপ হিসেবে বহুল ব্যবহার হয়ে আসছে পিভিসি পাইপ। পিভিসি পাইপ এক সময় পুরোটাই আমদানিনির্ভর থাকলেও বর্তমানে দেশে ন্যাশনাল পলিমার, আরএফএল, এ১, লিরা, যমুনাসহ আরো কিছু স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এই পাইপ উৎপাদন করছে। পিভিসি পাইপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত এর কাঁচামাল রেজিন আমদানি করে তা থেকে উৎপাদন করে।
কিন্তু দেশে কোন প্রতিষ্ঠান রেজিন উৎপাদন করে না। তবে স্থানীয় পিভিসি পাইপ উৎপাদনকারীরা বলছেন, স্থানীয় ভাবে রেজিন উৎপাদন শিল্পে সরকার ভ্যাট ছাড় দিলে তাতে তুলনামূলক কম দামে কাঁচামাল কেনার সুযোগ তৈরি হবে, যা পিভিসি পাইপের বাজারমূল্য কমাতেও সহায়তা করবে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও দুবাই থেকে রেজিন আমদানি করেন তারা। স্থানীয়ভাবে রেজিন উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দিলে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠার সুযোগ তৈরি হবে।
তবে পিভিসি পাইপ আমদানিকারকরা বলছেন, স্থানীয় পিভিসি পাইপ উৎপাদনকারীদের সুরক্ষার নামে আমদানিতে মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক-কর থাকায় ভোক্তার পকেট থেকে বাড়তি টাকা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পাইপ অ্যান্ড টিউবওয়েল মার্চেন্টাইজ অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মো সোলায়মান পারসি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পিভিসি পাইপ আমদানিতে বর্তমানে ১০৪ শতাংশ শুল্ক-কর। ফলে ১০ টাকা আমদানি মূল্যের পাইপের দাম হয়ে যায় প্রায় ২১ টাকা।
"অথচ স্থানীয় উৎপাদনকারীদের ভ্যাট মুক্ত। ওই পন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদনকারীরা তো ১২ থেকে সর্বোচ্চ ১৩ টাকায় বিক্রি করতে পারার কথা। কিন্তু তারা বিক্রি করে হয়তো ১৯ টাকায়। এর অর্থ হলো স্থানীয় শিল্পকে সুবিধা দেওয়ার নামে পকেট কাটছে ভোক্তার আর সুবিধা নিচ্ছে হাতে গোণা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান", বলেন তিনি।
কতোটা কার্যকর?
স্থানীয় শিল্পের জন্য গত কয়েক বছর ধরেই আয়কর ও ভ্যাটসহ বিভিন্ন ধরণের ছাড় দিয়ে আসছে সরকার। সব ক্ষেত্রে না হলেও কিছু ক্ষেত্রে এর সুফল মিলছে। এক সময় ফ্রিজ, টেলিভিশন ও এসি আমদানি নির্ভর হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় শিল্প গড়ে উঠায় এখন আমদানি নির্ভরতা অনেক কমেছে।
গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় মোবাইল ফোন শিল্পের প্রসারের সরকার কর অব্যাহতির পাশাপাশি ভ্যাটও অব্যাহতি দিয়ে আসছে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এর ফলে স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৭০ শ০তাংশ স্মার্ট ফোন ও ৫০ শতাংশ ফিচার ফোনের চাহিদা এখানকার কোম্পানিগুলো পূরণ করছে। এছাড়া দেশীয় জাহাজ শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতির পাশাপাশি ট্যাক্সও কমিয়ে দেওয়ার ফলে নতুন করে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা বেড়েছে ৩০টি।
এছাড়া গত বছর 'মেড ইন বাংলাদেশ' কে প্রণোদনা দেওয়ার অংশ হিসেবে শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের অটোমোবাইল শিল্পে ২০ বছরের কর অব্যাহতি, ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেক্ট্রিক সেলাই মেশিন, ইন্ডাকশন কুকার, কিচেনহুড সহ বিভিন্ন ধরণের হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদনকারী শিল্পে ১০ বছরের কর অব্যাহতি, কৃষি পন্য, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, আইটি হার্ডওয়্যার খাতে উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে ১০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হয়।
তবে এনবিআরের দেওয়া সুবিধা সব খাতে কাজে লাগেনি।
এনবিআরের একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই ভ্যাট হার কমিয়ে এক থেকে দুই শতাংশ করার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। এটি কমিয়ে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট প্রদান নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে। তিনি স্বীকার করেন, এই হার বেশি হওয়ায় সরকার প্রত্যাশিত ভ্যাট আদায় করতে পারছে না।
স্নেহাশিষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির পার্টনার স্নেহাশিষ বড়ুয়া টিবিএস-কে বলেন, ট্রেড ভ্যাট ৫ শতাংশ যৌক্তিক নয় কারণ অনেক প্রতিষ্ঠানের ভ্যালু অ্যাডিশন আরো অনেক কম হয়।
"এজন্য টার্নওভারের ওপর ভ্যাট কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করা হলে অনেকেই ভ্যাট দিতে আগ্রহী হবে", বলেন তিনি।
এনবিআর ট্রেড ভ্যাট হিসেবে বছরে তিন হাজার কোটি টাকা আদায় করে। তিনি বলেন, এই হার কমিয়ে আদায় নিশ্চিত করা গেলে তা কয়েকগুণ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।