আগামী অর্থবছরে এডিপি ব্যয় হবে জিডিপির ৫.৫৮%, ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পক্ষ থেকে চাহিদা বাড়লেও আগামী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার সঙ্কোচনের পথে হাটছে অর্থবিভাগ।
বিভাগের পক্ষ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য এডিপির আকার ২.৪৬ লাখ কোটি টাকা বেধে দেওয়া হয়েছে, যা প্রাক্বলিত জিডিপির মাত্র ৫.৫৮ শতাংশ। জিডিপির অনুপাতে এডিপির এ হার গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকেই সরকার জিডিপির ছয়-সাত শতাংশ পর্যন্ত এডিপি প্রণয়ন করে আসছে। চলতি অর্থবছরেও জিডিপির ৬.৫ শতাংশ এডিপি প্রণয়নের পর পরিসংখ্যান ব্যুরো জিডিপির ভিত্তিবছর হালনাগাদ করার পর তা ৫.৭১ শতাংশে নেমে আসে।
এ হিসাবে আগামী অর্থবছরের এডিপির আকার ০.১৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমছে। তবে আগামী অর্থবছরের উন্নয়ন প্রকল্পের চাহিদা ছিল ৩৮,৫০০ কোটি টাকা বেশি।
চলতি বছরের এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি ও আগামী বছরের প্রস্তাবিত এডিপি নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির সভায় বলা হয়, বাজেতের মূল লক্ষ্য হবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মা্যধমে আয় বৃদ্ধি করে দারিদ্র্য বিমোচন।
সভায় অর্থবিভাগের সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, "সরকারের বা সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকবে না এমন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হবে না"।
নতুন প্রকল্প প্রণয়নে নিরুৎসাহিত করে তিনি বলেন, এডিপির আওতায় নেওয়া চলতি প্রকল্প বাস্তবায়নে কম পক্ষে সাত বছর লাগবে। "এ অবস্থায় নতুন প্রকল্প নেওয়া হলে বিদ্যমান প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে", বলেন তিনি।
মধ্য মেয়াদী বাজেটারি কাঠামোর (এমটিবিএফ) সিলিং মেনে প্রকল্প প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি।
নতুন প্রকল্প অনুমোদনের জন্য থোক বরাদ্দ ও উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে স্থানীয় সরকারের ১০ ধরনের সংস্থায় বিশেষ বরাদ্দ আলাদা রেখে এডিপির বিভিন্ন অর্থ মন্ত্রনালয় ও বিভাগে বরাদ্দ দেবে পরিকল্পনা কমিশন। এর ফলে সরকারের প্রকল্পগুলোর চাহিদার তুলনায় বরাদ্দের অপ্রতুলতা আরও বাড়বে।
প্রকল্পের অনুকূলে প্রত্যাশা অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে না পারলে সরকারের উন্নয়ন কার্য্যক্রম বাধাগ্রস্থ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এডিপির বেশ কিছু বড় প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
ইতোমধ্যেই মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে এমন প্রকল্পের সংখ্যাও অনেক। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পেলে এ সব প্রকল্প বাস্তবায়নে বাড়তি সময় লাগবে। এর ফলে এক দিকে বাড়তি অর্থ ব্যয় হবে, অন্য দিকে সুফল পেতেও বাড়তি সময় লাগবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ১২.২৯ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়েছে, এডিপির আকার ৯.২৬ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে আগের বছরের চাইতে ১৯.১৪ শতাংশ বাড়িয়ে এডিপি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এর পরের বছরগুলোতে এডিপির আকার ১২.৮৩ শতাংশ থেকে ৩৮.৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২০.৮৭ শতাংশ বৃদ্ধির পর মহামারি চলাকালীন ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ শতাংশের সামান্য বেশি বাড়িয়ে এডিপি প্রণয়ন করা হয়। আর চলতি বছর এডিপির আকার বাড়ে ৯.৮৪ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে ১৪.০৯ শতাংশ। নতুন বাজেটে রাজস্ব আদায়ে ১১.৩১ শতাংশ ও আর্থিক জিডিপির আকার ১১.৯১ শতাংশ বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
চলতি প্রকল্পে প্রত্যাশা অনুযায়ী বরাদ্দ না পেলে প্রকল্পের বাস্তবায়নে গতি আসবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, অনেক মেগা প্রকল্প শেষ হওয়ার পথে থাকলেও অনেক প্রকল্পে শুধু মাঠ পর্যায়ের কাজ হয়েছে। বাজেটে বরাদ্দ না পেলে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে সময় ও ব্যয় বেড়ে যাবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রত্যাশিত রাজস্ব আহরণে প্রত্যাশিত গতি না আসায় এর চাপ পড়ছে উন্নয়ন খাতে।"
"সরকারের আদায় করা রাজস্বে পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করাই সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম পুরোপুরি ঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছে", বলেন তিনি।
"প্রত্যাশা অনুযায়ী বরাদ্দ না পেলে প্রকল্পের বাস্তবায়নে গতি আসবে না। প্রকল্প থেকে সুফল পেতেও বাড়তি সময় লাগবে।"
এরই মধ্যে এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে গেলে নতুন জট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বিদেশি সহায়তা বাড়ছে না
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ১.৩৭ লাখ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ও বাকি ৮৮,০২৪ কোটি টাকা বিদেশি উৎস থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বিদেশি সহায়তার অংশ কমিয়ে ৩৭.৭৭ শতাংশ ধরা হয়ছে। প্রস্তাবিত এডিপিতে বিদেশি সহায়তা ধরা হয়েছে ৯৩০০০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থসচিব সভায় বলেন, "বিদেশি সহায়তার পাইপলাইনে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি পরে থাকলেও তা থেকে প্রত্যাশিত হারে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আবার অভ্যন্তরীণ সম্পদের উপর চাপও বাড়ছে।"
প্রতি বছর পাইপলাইন থেকে অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যবহারের তাগিদ দেন তিনি।
ইআরডির সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, ঋণচুক্তি হয়ে গেলেও অনেক প্রকল্পের কাজ বিভিন্ন জটিলতার কারণে শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে প্রকল্প চলমান থাকা অবস্থায় রেয়াতকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বিভিন্ন জটিলতা তুলে ধরে তিনি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর বা প্রকল্প অনুমোদনের আগেই প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে রাখার তাগিদ দেন তিনি।
নতুন প্রকল্পের চাপ বাড়ছে
পরিকল্পনা কমিশনের প্রোগ্রামিং ডিভিশনের তথ্য বলছে, এডিপির আওতায় অনুমোদন পাওয়া ১,৮১৯ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকা।
গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যয় হওয়া ৫.৭১ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের সঙ্গে চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ যোগ করা হলে আগামীতে চলমান প্রকল্পে আরও লাগবে ১০.৭০ লাখ কোটি টাকা।
বিদ্যমান প্রকল্পে তীব্র অর্থসঙ্কটের মধ্যেও সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো নতুন করে আরও ১৪৭৫ প্রকল্প অনুমোদনের চাহিদা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী।
তিনি সম্পদ কমিটির সভায় জানান, আগামী বছরের এডিপি প্রনয়নের লক্ষ্যে সব মন্ত্রনালয় ও বিভাগের সঙ্গে তাদের চাহিদা নিয়ে বৈঠক করেছেন। এ সব বৈঠকে প্রতিটি মন্ত্রনালয় এমটিবিএফ সিলিংয়ের চাইতে বেশি বরাদ্দের চাহিদা দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, নির্মাণধর্মী প্রকল্প নিরোৎসাহিত করে আগামী অর্থবছরের এডিপি প্রনয়নের নীতিমালা জারি করা হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয়গুলোর প্রস্তাবিত প্রকল্পের অধিকাংশই অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে প্রস্তাব করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, বরাদ্দের ক্ষেত্রে করোনা থেকে পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন বিশেষ করে সমাপনীর অপেক্ষায় রয়েছে এমন প্রকল্পে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
বাড়তি বরাদ্দ চাইছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে ৮,২৫৯ কোটি কোটি টাকা থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়িয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য আগামী অর্থবছরের এডিপিতে ব্যয় সীমা ধরা হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
এরপরও বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির সভায় বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর দাবি জানান বিভাগটির সচিব মোঃ আবু বকর ছিদ্দীক।
তিনি সভায় বলেন, প্রকল্পের বাস্তবায়ন সাম্প্রতিক সময়ে খুব একটা সন্তোষজনক অবস্থানে নেই। তবে ২০১৮ সালের রেট শিডিউলের আওতায় কাজ হওয়ায় অনেক ঠিকাদার কাজ নিতে চাইছে না।
এসডিজি অর্জনের গতি ত্বরান্বিত করতে স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন বিভাগটির সিনিয়র সচিব হেলাল উদ্দিন।
স্থানীয় সরকার বিভাগ পল্লী এলাকার পাশাপাশি শহরেও পানি, স্যানিটেশানসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে উল্লেখ করে এসডিজির আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ স্যানিটেশান নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে বরাদ্দ দেওয়া ৪১৭০৭ কোটি টাকা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
সভায় বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানান বিদ্যুত বিভাগের সচিব মোঃ হাবিবুর রহমানও।
সভায় অংশ নেওয়া একটি সূত্র জানায়, তিন মন্ত্রণালয়ের ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল।
"রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের কথা আগে কেউ জানত না। এই যুদ্ধের কারণে অনেক খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে।" নতুন প্রকল্পে সংযমী হয়ে বিদ্যমান প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
চলতি বাজেটের সংশোধনীতেও বড় কাটছাট এডিপিতে
চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে কোন কাটছাট করা না হলেও বরাদ্দের বড় ধরনের কাটছাট হয়েছে এডিপি বরাদ্দে।
সম্পদ কমিটির সভায় উপস্থাপিত সংশোধিত বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫,৯৩,৫০০ কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের ১০,১৮১ কোটি টাকা কম।
এডিপি থেকে ১৭,৭৭৪ কোটি টাকা কেটে নেয়ায় বরাদ্দ দাড়িয়েছে ২.০৭ লাখ কোটি টাকায়।
অন্যদিকে, পরিচালন ব্যয়ে কাটছাট না করে বাড়তি ৭৫৯৩ কোটি টাকা যোগ করা হয়েছে সংশোধিত বাজেটে।
বরাদ্দের পাশাপাশি সফল বাস্তবায়নে জোর অর্থনীতিবিদদের
বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়ানো গেলে বরাদ্দ কিছুটা কমলেও এডিপির আওতায় প্রকল্পের সুফল বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. আখতার মাহমুদ।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে এডিপি বাস্তবায়নে সফলতা দেখা হয় কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে তার ভিত্তিতে, যা মোটেও কাম্য নয়।"
তিনি আরও বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে সমাজে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে, জনসাধারণের কতটুকু উপকার হয়েছে তা মূল্যায়ন করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, "খরচ কমিয়ে ফলাফল পেলে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। তবে বাস্তবতা হলো আমাদের উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে সবাই বাড়তি ব্যয়েই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। নির্মাণধর্মী প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ হাসিলের সুযোগ বেশি, আবার এ ধরনের উন্নয়ন সহজে দৃশ্যমানও হয়।"
এ অবস্থায় তিনি এডিপি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দক্ষতা বাড়ানোর তাগিদ দেন।