মহামারির সময়ে হাজার হাজার ছেলে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, এখন স্কুল চালু হয়েছে তারা ফেরেনি
১২ বছরের রাফি সাতসকালে কাজে যায়, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। সারাদিন ঘরে বসে অস্থির সময় কাটান তার মা, ৩৪ বছরের রেখা। দুই সন্তানের এ জননীর বড় ছেলে রাফি, কাজ করে একটি গ্ল্যাস ফ্যাক্টরির বিপজ্জনক পরিবেশে। এজন্যেই সুর্যাস্তের সময়ে রেখা সন্তানের পথ চেয়ে বসেছিলেন। অস্থির হয়ে উঠছিলেন থেকে থেকে। বার বার মুঠোফোন হাতে নিয়ে দেখছিলেন ছেলের কোনো কল মিস করেছেন কিনা।
তার উদ্বেগের আরেক কারণ- রাফির ফেরার কথা আরও ৩০ মিনিট আগে। এখনও না ফেরায় ঘরে অস্থিরতা ফুটে উঠছিল না রেখার চোখেমুখে। এক সময় আর সুস্থির থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে সদর দরজার সামনে দাঁড়ান, মনে আশা যদি ছেলেকে আসতে দেখেন।
এই দৃশ্য ধরা দেয় প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম টাইমের প্রতিবেদকদের চোখে। তারাও সেদিন গিয়েছিলেন রেখার বাড়িতে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে রেখা তাদের বলেন, "ওর চাকরি খুব বিপজ্জনক। প্রতিদিন সকালে ছেলেকে বিদায় দেওয়ার সময় দোয়া করি- আল্লাহ আমার ছেলেকে সহি-সালামতে ঘরে ফিরিয়ে দিও।"
গত ১৮ মাস ধরে স্থানীয় ওই গ্লাস কারখানায় কাজ করছে রাফি। অনেকবার সে কাজ থেকে জখম বা কাটা ক্ষত নিয়ে ঘরে ফিরেছে। একদিন বিকেলে কাজ করতে করতে জানালার প্যানেল কাটার ধারালো ব্লেড লেগে রাফির হাতের তালু কেটে যায়। রক্তের ধারায় ভেসে যায় পরনের টি-শার্ট। কারখানার মালিক সাথে সাথে রাফিকে স্থানীয় একটি জরুরি চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রে নিয়ে যান। কিন্তু, কারখানার কেউ রেখাকে ওই দুর্ঘটনার কথা জানায়নি।
স্মৃতিচারণ করে রেখা বলেন, "মনে মনে নিজেকে খুব দোষী করি, ভাবি আমি কত খারাপ একজন মা। কারণ আমি জানি, রাফি কাজ করতে চায় না। সে স্কুলে পড়তে চায়।"
এই গল্প আজ বাংলাদেশের হাজারো রাফিদের।
২০২০ সালের মার্চে সরকার প্রথম যখন করোনা সংক্রমণ রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কেউই ভাবেনি এরপর ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশের এই শিক্ষাখাতের অচলাবস্থা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দীর্ঘতম স্কুল-কলেজ বন্ধের ঘটনা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সশরীরে পাঠদান পুনরায় শুরু হলেও, ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট বিস্তারের কারণে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব আবারও বাড়লে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে টানা চার সপ্তাহ বন্ধ ছিল স্কুল।
বাংলাদেশে প্রথম লকডাউন চালুর পর প্রায় দুই বছর পার হয়েছে। শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে ফিরতে পারেনি, যাদের অধিকাংশের বয়স ১২ বা তার বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়টায় দরিদ্র পরিবারের এসব সন্তান পুরোদস্তুর শিশুশ্রমিকে পরিণত হয়েছে।
শুরু যার কথা দিয়ে, সেই রাফিও ঝরে পড়া শিশুদের একজন। ২০২০ সালের মার্চে সরকারের লকডাউন ঘোষণা আসার আগে সে পড়তো ঢাকার শান্তিপুর হাই স্কুলে। তখন স্কুলটিতে ৫-১৭ বছরের শিক্ষার্থী ছিল ১,১০০ জন। কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর স্কুলের মরচে পড়া ফটক উন্মুক্ত হয়, তারপর ফিরেছে মাত্র ৭০০ জন। পরের মাসগুলোয় সেই সংখ্যা আর বাড়েনি।
ডিসেম্বর নাগাদ স্কুলের এতগুলো বেঞ্চ খালি পড়ে থাকতে শুরু করে যে সেগুলো রদ্দি হিসেবে বেচে দেওয়া শুরু করেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। যে শিশুদের অভাবে বেঞ্চগুলিও রদ্দির খাতায় নাম লেখাল–তাদের দুই-তৃতীয়াংশই আসলে বালক শিশু।
শান্তিপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, "তাদের অনেকেই এখন নিজ পরিবারের একমাত্র রুটিরুজি আয়কারীতে পরিণত হয়েছে।"
মহামারির শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে ঠিক কতজন শিশু কাজে যোগ দিয়েছে তা সঠিকভাবে জানার কোনো উপায় নেই। টাইম ম্যাগাজিন একটি ধারণা পেতে, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ২০টি স্কুলের শিক্ষার্থী উপস্থিতির তথ্য সংগ্রহ করে। এতে দেখা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ এবং ২০২১ সালের নভেম্বর– এ সময়ের মধ্যে স্কুল থেকে ঝরে পড়াদের মধ্যে কমপক্ষে ৫৯ শতাংশ ছিল বালক। ছেলে শিশুদের ঝরে পড়ার এই বৈষম্যমূলক হারকে বাংলাদেশভিত্তিক সুপ্রতিষ্ঠিত এনজিও ব্র্যাকের তথ্যও সমর্থন করছে।
ক্রমবর্ধমান এক সংকট:
মহামারিকালে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শিশুশ্রমিক বৃদ্ধি পেয়েছে এমন আশঙ্কা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলও। একারণে চলতি বছরের মার্চে শিশুশ্রম সম্পর্কিত ১৩৮ নং কনভেনশনে পুনরায় অনুস্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সরকার। ১৪ বছরের নিচের শিশুকে কোনো শিল্পে কাজ করতে দেওয়া হবে না- সে সময় এমন ঘোষণাও দেওয়া হয়। একইসঙ্গে, আগামী তিন বছরের মধ্য সম্পূর্ণরুপে শিশুশ্রম নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দেয়।
কিন্তু, প্রতিশ্রুতি হোক বা আশার বাণী, অন্নের দায় বড় দায়। মহামারির কারণে যে ১৮ মাস স্কুল বন্ধ ছিল, তারমধ্যেই দেশজুড়ে গৃহস্থালি আয় গড়ে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। অনেক পিতামাতা জানিয়েছেন, তারা কোনো বিকল্প উপায় খুঁজে না পেয়েই ছেলে শিশুদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে অন্তত ছোট ভাইবোনদের খাবারের টাকা তারা আয় করতে পারছে। নাহলে তাদেরকেও অনাহারে থাকতে হতো।
মহামারির কারণে স্কুল প্রথম বন্ধের সময় কিন্তু অবস্থা এতোটা খারাপ ছিল না। রাফির বাবা-মাও তাদের বড় সন্তানের শিক্ষা নিয়ে সচেতন ছিলেন। প্রতিবেশীদের সাথে যৌথভাবে তারা একজন গৃহশিক্ষকও ঠিক করেন–যিনি দিনে অন্তত একঘন্টা করে ওই এলাকার এক ডজনের বেশি শিশুকে পড়ানোর ভার নেন। তারপর একদিন শুরু হলো লকডাউন। যত দিন যায়, কর্মজীবী ওই এলাকার মানুষের আর্থিক সামর্থ্য ততো কমতে থাকে। রাফির পরিবারেও নেমে আসে আর্থিক দুর্দশা।
২০২০ সালের গ্রীষ্মকাল তখন, ছোটখাট সফল উদ্যোক্তা রেখার স্বামী তাজুল তার কাপড়ের ব্যবসাটি আর ধরে রাখতে পারলেন না। সংসারের প্রয়োজনে এরপর একসাথে দুটি ছোট চাকরি নেন। দিনে রাস্তার পাশের দোকানে আর রাতে ওই মার্কেটের নৈশপ্রহরীর কাজ করতেন। এত চেষ্টার পরও বাড়িভাড়া আর ক্ষুদ্রঋণের সুদ মেটানোর জন্য যথেষ্ট আয় হচ্ছিল না। পাওনাদারেরা বাড়ি বয়ে এসে তাগাদা দিতে থাকে, রাফির মা রেখাকে হুমকিধামকি দিতে থাকে। রেখা ডায়াবেটিস রোগী, ভুগছেন আরও কিছু জটিল রোগে; তার পক্ষে বাইরে কাজ করে স্বামীকে সাহায্য করা সম্ভব ছিল না। তখন প্রায় দিশেহারা অবস্থা তাজুলের, বাধ্য হয়েই ছেলে রাফিকে কাজে পাঠানোর চিন্তা আসে তার মাথায়।
সেদিনের কথা মনে করে রেখা বলেন, "কোনোদিন এমন পরিকল্পনা ছিল না আমাদের, তবু অবস্থা এত খারাপ হয়ে গেল, উপায়ও ছিল না।"
রেখা কোনোদিন ভাবতেই পারেননি আদরের ছেলেকে গ্ল্যাস ফ্যাক্টরির মতো বিপজ্জনক জায়গায় কাজে পাঠাতে হবে; বুকে পাথর বেঁধে হলেও। তবুও অভাবের ছাপ সর্বত্র। "আমরা এখন খুব কষ্টে দিন কাটাই"- প্লাস্টার বা রঙের বালাইহীন কংক্রিটের ঘরটাও যেন রেখার একথার সাক্ষ্য দেয়। ছোট্ট ওই এক ঘরেই খাওয়াদাওয়া, ঘুমসহ সবকিছুই সারতে হয় পরিবারটির সদস্যদের।
বাংলাদেশে যখন মহামারি প্রথম আঘাত হানে, তখন নাগরিক ও সুশীল সমাজের বেশিরভাগের উদ্বেগ ছিল কন্যা শিশুদের নিয়ে। কারণ, অভাব-অনটনের কারণে বহু পরিবার অল্পবয়সী কন্যাদের বাল্যবিবাহ দেয়। সংসারে অন্নের মুখ কমানোর এ চেষ্টায় অনেক মেয়ের বিয়ে হয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ বয়সী পুরুষের সাথে। 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন'-এর এক জরিপে লকডাউনের প্রথম ছয় মাসেই বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিবাহ রেকর্ড করা হয়। এসব কন্যাশিশুদের অন্তত অর্ধেকের বয়স ছিল ১৩- ১৫ বছর।
রাফির শান্তিপুর হাই স্কুলের শিক্ষকরাও কন্যাশিশু শিক্ষার্থীদের ট্র্যাক রেকর্ড সতর্কভাবে সংরক্ষণ করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা দেখেছেন, যে মেয়েরা আর স্কুলে ফিরে আসেনি, তাদের অনেকেই পরিবারের সাথে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে এবং সেখানকার স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তবে এই স্কুলের অন্তত ১৫ জন কন্যা শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে এবং তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার সাহা জানান, মহামারির অভিঘাত ছেলে শিশুদের ওপর পড়ার বিষয়টি তারা ধারণা করতে পারেননি। "এত বিস্তৃত ক্ষতি ছিল আমাদের অনুমান বা কল্পনারও বাইরে।"
বাংলাদেশে সার্বিকভাবে মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক নয়। শিক্ষার্থীদের বার্ষিক বেতন দিতে হয় গড়ে ৩ হাজার টাকা (৩৫ ডলার)। অথচ মহামারির আগেই দেশে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজনের দৈনিক আয় ছিল এক দশমিক ৯০ ডলারের চেয়েও কম। তার ওপর রয়েছে লাগাতার মূল্যস্ফীতি। গত দুই বছরে স্টেশনারি পণ্য, পাঠ্যপুস্তক বা ইউনিফর্মসহ সব শিক্ষাপণ্যেরও দাম বেড়েছে।
নারী শিক্ষায় যেন দেশ পিছিয়ে না পড়ে, সেজন্য উপবৃত্তি বা ভাতা দেয় সরকার। ১১-১৬ বছরের কন্যাশিশুরা স্কুলে পড়লে, বছরে তারা উপবৃত্তি ও বিদ্যালয়ের বেতনে সরকারের দেওয়া ভর্তুকিসহ গড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা (৪০ ডলার) পায়। এভাবে বাল্যবিবাহ কমাতেও সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। অনেক পরিবার এখন তাদের মেয়েদের স্কুলে রাখতেই বেশি আগ্রহ দেখায়।
সে তুলনায় ছেলে সন্তানদের কথা এখন অনেকটা আলাদা। ব্র্যাকের শিক্ষা-বিষয়ক পরিচালক সাফি খান বলেন, "সে তুলনায় কিন্তু ছেলে শিশু যেসব পরিবারে রয়েছে, তাদের কাছে শিক্ষার ব্যয় একটি বড় দুশ্চিন্তা। পরিস্থিতি বেশ নাজুক হলেও, সে তুলনায় তেমন সহায়তার উদ্যোগ নেই।"
সংকটের লক্ষণ প্রথম যখন দেখা যায়:
লকডাউনের সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দা, জনজীবনে স্থবিরতা প্রান্তিক ব্যবসায়ী ও খেটেখাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামকে কঠিনতর করে তোলে। আর তখনই ছেলে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া শুরু হয় বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলও'র বাংলাদেশ শাখার পরিচালক তুমো পৌতিয়ানিয়েন। "এই অবস্থায় লিঙ্গের কারণেও পার্থক্য তৈরি হয়েছে। স্কুল বন্ধ হওয়ার পর বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষ তাদের কন্যাদের কাজে পাঠানো নিরাপদ মনে করেনি, সে তুলনায় ছেলে সন্তানদের কাজে পাঠানো তাদের কাছে খুব দরকারি আয়ের উৎস হিসেবে গণ্য হয়।"
বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের শিক্ষায় বিদেশি উৎস থেকে সহায়তা এসেছে লাখ লাখ ডলার। তবে শিশু অধিকার কর্মীরা টাইমকে জানান, তারা মহামারিকালে স্কুল ছেড়ে চলে যাওয়া হাজার হাজার ছেলে শিশুদের জন্য একইরকম বা সমান সহায়তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেন না।
দাতারা যেন শিশুশ্রমের বিষয়ে ইচ্ছে করেই উদাসীন রয়েছে এমন মন্তব্য করে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পরিচালক টনি মাইকেল গোমেস বলেন, "আমি দুটি ক্ষেত্রে বড় পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি। আপনি যদি সত্যিকার অর্থে জানতে চান, তারা (দাতারা) আসলে কীসের জন্য অনুদান দিচ্ছে বা তাদের দেওয়া সম্পদ শিশুদের জীবন উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা- তাহলে আমি 'না'-ই বলব।"
তার সাথে একমত পোষণ করে ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শেলডেন ইয়েট বলেন, "কন্যাশিশুরা যে ঝুঁকির মধ্যে থাকে, আমি তা খাটো করতে চাই না। তবে একইসাথে ছেলে শিশুদের বিশেষ কিছু প্রয়োজনে সহায়তার দিকটি অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।"
মহামারিকালে দরিদ্র অনেক পরিবারকে ধারদেনা করে চলতে হয়েছে। এই দেনার বোঝা তাদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। তখন স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ছেলে শিশুদের কাজে পাঠান অভিভাবকরা।
এমন এক অভিজ্ঞতার কথা জানান হেলেনা নামের এক নারী। হেলেনা তার ১১ বছরের ছেলে আলমগীরকে যখন স্কুল ছাড়ার কথা বলেন, তখন সে রাগে বইপত্র সব ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেয়। "এ ঘটনায় আমার মন ভেঙে যায়"- বলেন তিনি।
একদিন সন্তানকে বাড়ির কোণে বসে নীরবে কাঁদতেও দেখেছেন। অথচ হেলেনা ছিলেন নিরুপায়। "ছেলেকে কাঁদতে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমি তো ওর ব্যথা বুঝি।"
মহামারির বছর পাঁচেক আগে হেলেনার স্বামী গুরুতর অসুস্থ হয়ে কাজকর্মের শক্তি হারান। তখন আলমগীরের বড় ভাইকে একটি ইটভাটায় শ্রমিকের কাজে পাঠান হেলেনা। সে দিনে ৩০০ টাকা মজুরি পেত। "বড় ছেলেকে ত্যাগ স্বীকার করিয়ে ভেবেছিলাম অন্য সন্তানদের মানুষ করব। তাদের শিক্ষিত করব"- বলছিলেন তিনি।
কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে লকডাউন শুরু হলে ইটভাটা কয়েক মাস ধরে বন্ধ থাকে। পরিবারটি তখন বাধ্য হয়ে ৪০ হাজার টাকা ঋণ করে। ওই টাকায় দুবেলা খাওয়ার চালডালের খরচ, চিকিৎসা খরচ ইত্যাদি পূরণ করে পরিবারটি। আজো সেই ঋণের ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ বাকী। হেলেনার শঙ্কা, তার দুই ছেলেকে আরও বহুদিন এ দেনার ভার টানতে হবে।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিয়ে তথ্য-উপাত্ত লজ্জাজনকভাবে সীমিত। তবে আইএলও জানিয়েছে, এ হার মহামারির আগে কমছিল। যদিও, ২০১৩ সালের পর থেকে দেশব্যাপী কোনো শিশুশ্রম জরিপ সরকারিভাবে করা হয়নি। ২০১৯ সালে নিজস্ব এক জরিপ চালায় ইউনিসেফ। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে ১২-১৪ বছর বয়সী প্রতি ১০ জন বালকের একজনকে পূর্ণসময় কাজ করতে হচ্ছে। তাদের মজুরি বিভিন্ন রকম, তবে গবেষণাটি ইঙ্গিত দেয় যে অধিকাংশ শিশুশ্রমিকের আয় মাসে ৪০ ডলারেরও কম।
ইউনিসেফের শেলডেন ইয়েট বলেন, "মহামারির শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা নিজেদের তথ্যউপাত্ত আপডেট করতে পারিনি। তাই শিশুশ্রমের ওপর মহামারির সঠিক প্রভাবও আমাদের অজানা রয়েছে। তবে আমরা নিশ্চিত জানি, পরিস্থিতির আরও অনেক বেশি অবনতি হয়েছে।"
- সূত্র: টাইম