পোস্টার, ব্যানার, দেয়াল লিখনে নগরীর সৌন্দর্যহানি, অকার্যকর আইন
রাজধানীর প্রধান সড়কের আশপাশসহ শহরের অলিগলিতেও যত্রতত্র পোস্টার, ব্যানার লাগানো ও দেয়াল লিখনের কারণে ঘটছে সৌন্দর্যহানি। সড়কের পাশের দেয়াল, ভবন, গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসার দেয়াল কিছুই বাদ যায়নি।
এমনকি মেট্রোরেলের খুঁটিতেও ঝুলছে ব্যানার, পোস্টার। ফলে সৌন্দর্যহানির সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সম্পদ। এদিকে 'দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২' গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার ১০ বছর পরেও তা অকার্যকর।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নগরের নান্দনিকতা ও সৌন্দর্য রক্ষায় যত্রতত্র দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানোকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে প্রণিত 'দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো আইন ২০১২' একদম অকার্যকর হয়ে আছে।"
"রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরা এই আইন ভেঙ্গে দৃষ্টি দূষণ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ফলে সাধারণ মানুষ ও এই আইন মেনে চলতে উৎসাহ বোধ করেন না," বলেন তিনি।
আইনের যথাযথ ও সর্বাঙ্গীন প্রয়োগের মাধ্যমে দেয়াল লিখন বন্ধ করে নগরের সৌন্দর্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন এ নগর পরিকল্পনাবিদ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির নির্বাচনি প্রচারণা ছাড়াও অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত প্রচার, স্কুল-কলেজে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি, নতুন সিনেমা-নাটকের পোস্টারসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচারণায় পোস্টারিং করা হচ্ছে হর হামেশাই। যথাযথ নিয়মে পোস্টার লাগানো ও অপসারণে নির্দিষ্ট আইন থাকলেও মানছে না কেউ।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে অভিযান চালিয়ে পোস্টার উচ্ছেদসহ জড়িতদের অর্থদণ্ড করলেও যত্রতত্র পোস্টারিং ও দেয়াল লিখন বন্ধ হচ্ছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা টিবিএসকে বলেন, "ক্লিন সিটি গড়তে এ ধরনের পোস্টার, ব্যানারের বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত অবস্থান রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে নিয়মিতই মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হচ্ছে এ অবৈধ পোস্টারিং এর বিরুদ্ধে। এছাড়া আমাদের প্রচার প্রচারণাও অব্যহত রয়েছে।
দুই সিটি করপোরেশন বলছে তারা নিয়মিত অবৈধ পোস্টার-ব্যানার লাগানো ও দেয়াল লিখনের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসছে কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ পোস্টার না লাগানোয় সরাসরি কারো উপর আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহম্মাদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ৭৫টি ওয়ার্ডের জন্য ২ জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। তারা নিয়মিতই দক্ষিণ সিটির আওতাধিন এলাকায় অবৈধ পোস্টার, বিলবোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছেন এবং আমরা লোক দিয়ে অপসারণ করছি। তবে এসব পোস্টার রাতে কিংবা আমাদের অগোচরে লাগায় বলে তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এছাড়া আমরা আস্তে আস্তে ডিজিটাল বিলবোর্ডের দিকে যাচ্ছি।"
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, পরিবেশ দূষণের মধ্যে বায়ু, পানি ও শব্দদূষণের কথা বলা হলেও এখন 'দৃশ্য দূষণ' নগরের দৈনন্দিন সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। দৃশ্য দূষণ প্রাকৃতিক পরিবেশে ক্ষতিকারক পরিবর্তন তৈরি করে মানুষের দর্শনীয় স্থানগুলোকে বিরক্ত করে। তাই এর বিরুদ্ধে ব্যক্তি এবং সামষ্টিক উদ্যোগে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দু-একটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এ ধরনের চিত্র দেখা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর প্রধান সড়ক, সড়কের পাশের বাড়ির দেয়াল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ফ্লাইওভারের পিলার, বড় গাছ ও বিলবোর্ডসহ সব জায়গায় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন ধরনের পোস্টার সাঁটানো রয়েছে। কোথাও কোথাও একটির ওপরে একাধিক পোস্টার সাঁটানোর কারণে অনেক মোটা আকার ধারণ করেছে।
সাধারণত রাজনৈতিক নেতাদের পোস্টার, ব্যানার, অবৈধ দেয়াল লিখন, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ডের ছড়াছড়ি দেখা যায় রাজধানীতে। এছাড়া রয়েছে বিদ্যালয়, কলেজ, কোচিং সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা বিজ্ঞাপন। আর তা দৃশ্যমান থাকে জনবহুল স্থানগুলোতে। এতে ব্যাপকভাবে দৃশ্য দূষণ হচ্ছে এবং যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে।
কখনও নিজস্ব লোক দিয়ে পোস্টার ও দেয়াল লিখন হলেও এ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের দ্বারাও করা হচ্ছে এ কাজ। আবার নির্ধারিত উৎসব বা অনুষ্ঠান শেষে এসব পোস্টার অপসারণ করার কথা থাকলেও সেটিও করা হচ্ছে না। একইভাবে উৎসব পালনে সরকারি রাজস্বও পরিশোধ করছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা সামিউল হক টিবিএসকে বলেন, "বাড়ির দেয়ালে রং করে একদিনও রাখা যায় না। রাতে এসে পোস্টার লাগিয়ে যায়। যাদের পোস্টার লাগায় তাদের বিরুদ্ধে কিছু করারও নেই, সবাই এলাকার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। এছাড়া বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তির পোস্টারও রাতের আঁধারে এসে লাগিয়ে যায়।"
বাংলামোটরের বাসিন্দা তাসমিমা ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "পোস্টার, ব্যানার যেমন দেয়াল ও পরিবেশের ক্ষতি করে তেমনি নানা সময়ে এগুলো দূর্ঘটনারও কারণ হয়। এছাড়া অনেক পোস্টারে নানা ধরনের আপত্তিকর ছবি ও লেখা থাকে যেগুলোতে চোখ পড়লেই অস্বস্তি লাগে। এজন্য দরকার নগর কর্তৃপক্ষের সচেতন হওয়া।"
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এলাকায় ৫২টি ব্যস্ততম স্থানে পোস্টার লাগানোর জন্য বিশেষ বোর্ড স্থাপন করেছিল উত্তর সিটি যেখানে নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান তাদের পোস্টার লাগাতে পারবেন। তবে এসব স্থানগুলোতে খুব বেশি পোস্টার লাগাতে দেখা যায় না।
আইনে কী বলা আছে?
নগরীর সৌন্দর্য রক্ষায় সরকার ২০১২ সালে 'দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২' প্রণয়ন করে। এ আইনের ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে না। কিন্তু বিগত দশ বছরেও এ আইনটি বাস্তবায়নে সরকারি কোন সংস্থার কার্যকরী উদ্যোগ নেই।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মাঝে মাঝে নিজ উদ্যোগে এসব পোস্টার, ব্যানার অপসারণ করে থাকে। কিন্তু যারা এসব ব্যনার, ফেস্টুন ও পোস্টার লাগান তাদের বিরুদ্ধে আইনি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ফলে অপসারণের কয়েক দিনের মধ্যেই আবার এগুলো নগরীতে ছেয়ে যায়।
ধারা-৪ বলা হয়েছে, কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারবে এবং নির্ধারিত স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে। তবে শর্ত থাকে যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে, উল্লিখিত নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে, দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে।
অপরাধ ও দন্ড বিষয়ে আইনের ধারা ৬ এর উপধারা-২ এ বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগালে সেই অপরাধের জন্য ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিম্নে ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা এবং উর্ধ্বে ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হবে। অনাদায়ে ১৫ (পনের) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ডও দেওয়া হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া উপধারা-৩ এ বলা হয়েছে, কোনো সুবিধাভোগীর অনুকূলে ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো হলে উক্ত অপরাধের জন্য ওই সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে নিম্নে ১০ (দশ) হাজার টাকা এবং উর্ধ্বে ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হবে। এছাড়া, অনাদায়ে ৩০ (ত্রিশ) দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার বিধানও রয়েছে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে।
কিন্তু বাস্তবে এ আইন প্রয়োগে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন খুব বেশি উদ্যোগী নয়।