গণপরিবহনের অভাব, চট্টগ্রাম শহরে ট্রাফিক ভোগান্তি চরমে
কয়েক দশকেও সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায় চট্টগ্রাম শহরে গণপরিবহনের অভাব ও যানজটের সমস্যা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, যানজট নিরসন এবং সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা প্রণয়নে গত ২৭ বছরে নেওয়া হয়েছে তিনটি পরিকল্পনা। কিন্তু সেসব শুধু রয়েছে কাগজে কলমেই।
এসব পরিকল্পনাকে পাশ কাটিয়ে চালু রাখা হয়েছে একেরপর এক অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম। এর খেসারত দিচ্ছেন নগরের ৬০ লাখ মানুষ।
শুরু থেকে ফ্লাইওভারসহ বড় অবকাঠামোর নির্মাণের বিরোধিতা করে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে বলা হয়েছিল পরিকল্পনাগুলোতে। কিন্তু এসব কথায় কান দেয়নি সংশ্লিষ্টরা।
ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যানজটের কারণে থমকে যাচ্ছে নগর জীবন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের তথ্যমতে, ১২ বছর আগে চট্টগ্রামে যানবাহনে ঘন্টায় গতি ছিল ২১ কিলোমিটার। বর্তমানে যানবাহনের গড় গতি ৫ কিলোমিটার।
'চিটাগং স্ট্র্যাটেজিক আরবান ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যানের জরিপে দেখা গেছে, নগরীর চলাচলরত যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে কম গতি বাসের।
সকালে (ভোর ৪টা থেকে সকাল ১০টা) বাসের গতি ঘণ্টায় ১৩.৯ কিলোমিটার এবং বিকেলে (বিকেলে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা) এ গতি ১০.৩ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর সকালে গড় গতি ১৮.৩ কিলোমিটার থাকলেও বিকেলে দাঁড়ায় ১০.৭ কিলোমিটারে।
গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং সড়কে নির্মাণ কাজ চলায় এ গতি আরো কমেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তা খোরশেদুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগে জিইসি মোর থেকে আগ্রাবাদ যেতে সময় লাগতো ২০-৩০ মিনিট। বর্তমানে যানজটের কারণে অনেক সময় এক ঘণ্টারও বেশি লাগে।"
নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার আক্তারুজ্জামান সেন্টারের দোকানী কফিল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সন্ধ্যার পর গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। গাড়ি পেতে যুদ্ধ করতে হয়। এরপর যানজট তো আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ চলায় সড়কটি অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে।"
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরে রাস্তা আছে মাত্র এক হাজার ১৬৯ কিলোমিটার, এর মধ্যে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। এর মধ্যে মোটরসাইকেল প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার। এরপরই রয়েছে ৩৬ হাজারের বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি। নগরে চলাচলরত বাসের সংখ্যা মাত্র ২ হাজার ৯৯টি।
নগরে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি ফ্লাইওভার ও একটি ওভারপাস নির্মাণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এছাড়া সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা খরচ করে লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এখনও নির্মাণাধীন।
শুরু থেকে ফ্লাইওভার নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তবে কোন কথাই কানে নেয়নি সিডিএ। এসব বড় প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করছেন ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী স্বল্প সংখ্যাক মানুষ।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের এক জরিপে বলা হয়, বহাদ্দারহাট এবং লালখানবাজার ফ্লাইওভারে বাস, মিনিবাস, টেম্পোসহ গণপরিবহন চলাচল করে না।
ফলে মাত্র ৫-৬ ভাগ মানুষ (ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী) এগুলো ব্যবহার করে। বাকি ৯৫ ভাগ মানুষের কোন কাজে আসে না ব্যয়বহুল এসব উড়াল সড়ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি জংশনে প্রতিদিন ১ লাখ গাড়ি যাতায়াত করলে, সেখানে ফ্লাইওভারের প্রয়োজন হয়। চট্টগ্রামের ট্রাফিক ভলিয়ম অনুসারে এখানে কোন ফ্লাইওভারের প্রয়োজন ছিল না বলে মত তাদের।
১৯৯৫ সালে প্রণীত চট্টগ্রামের মহাপরিকল্পনায় স্বল্প মেয়াদী এবং দীর্ঘ মেয়াদী দুই ধরনের কৌশলগত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। সেখানে ফুটপাতের উন্নয়ন, উন্নত মানের বাস সার্ভিস চালুর মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী; এ দুই ধরণের পদক্ষেপেই শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছিল। এছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের ট্রাফিক এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য স্থায়ী কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা ইউনিট গঠনের কথা বলা হয়েছিল।
২০০৮ সালের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) এবং ২০১৮ সালের স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যানেও প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনেও কথা বলা হয়েছে। অথচ গত ২৭ বছরে এ ধরনের কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
'চিটাগং স্ট্র্যাটেজিক আরবান ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যানের (চট্টগ্রাম নগরীর কৌশলগত পরিবহন মহাপরিকল্পনা)' জরিপে দেখা যায়, দৈনিক ৬.৭ মিলিয়ন ট্রিপ সংঘটিত হয় চট্টগ্রামে। ২২ শতাংশ ট্রিপ সিএনজি অটোরিকশা এবং রিকশা দিয়ে হয়। ২৫ শতাংশ ট্রিপ হয় পায়ে হাঁটার মাধ্যমে। আর ১০ শতাংশ ট্রিপ ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ির মাধ্যমে হয়ে থাকে। যানবাহন ব্যবহারকারী ৮৩ শতাংশ মানুষের ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়িতে প্রবেশাধিকার নেই। নগরের ৬৫ শতাংশ যাত্রীর যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম গণপরিবহন।
মোট সড়কের ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে বাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো। নগরীর ২৯ শতাংশ সড়ক দখল করে আছে ব্যক্তিগত গাড়ি। এসব গাড়িতে যাতায়াত করেন মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ। বিপরীতে সড়কের মাত্র ১৭ শতাংশ জায়গা দখল করে ৪৮ শতাংশ যাত্রী বহন করে বাস। সড়কের ২৭ শতাংশ সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশার দখলে থাকে, এসব পরিবহনে যাতায়াত করে মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ। ৬ শতাংশ জায়গা দখল করে ১২ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করে টেম্পো। এ ছাড়া সড়কের ৭ শতাংশ জায়গা দখল করে ১০ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করে হিউম্যান হলার।
২০০৮ সালের চট্টগ্রামের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের এক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়, ৩৩ জন যাত্রী বহনকারী একটি বাস সড়কের ৩৩ ফুট স্থান দখল করে। টেম্পো একই যাত্রী বহনে সড়কের ৬৬ ফুট স্থান, বেবি টেক্সি ৯৯ ফুট, রিকশা ১৩২ ফুট এবং কার ৪৬২ ফুট জায়গা দখল করে থাকে। অর্থাৎ ৮০৬৪৫টি অন্যান্য যানবাহনের পরিবর্তে শুধুমাত্র ৭৯২৫টি বাস ব্যবহার করে নগরীর ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৩৪ জন মানুষকে বহন করা যাবে।
পরিকল্পনাগুলোতে সুপারিশ করা হয়, গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর মাধ্যমে নাগরিকদের গণপরিবহনমুখীর করা। অর্থাৎ নগরীর সড়কগুলোতে বাসের জন্য আলাদা লেন করা। যেন বাসে করে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন মানুষ। এর ফলে বাসে চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে মানুষ। ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে আর ঝুকবে না। বাড়বে না গাড়ির সংখ্যাও। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে এমন ব্যবস্থাপনা রয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামে এ ধরনের কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চট্টগ্রামে গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। সব পরিকল্পনাগুলো কাগজেই রয়ে গেছে।"
"কোনো পরিকল্পনায় ফ্লাইওভার নির্মাণের কথা বলা ছিল না। আমরা বহুবার বলেছি, হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট করেও কোন সমাধান হবে না। কিন্তু কেউ কথা কানে নেয়নি। অথচ ৩০০-৪০০ কোটি টাকা খরচ করে যদি ধাপে ধাপে বিআরটি করা যেত।"
"এখনো সময় আছে। যথাযথ পরিকল্পনা করতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ডিজাইন করতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন করা গেলে যানবাহনের গতি ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত উন্নীত করার সুযোগ রয়েছে", যোগ করেন সুভাষ বড়ুয়া।