রাবি’র এক সাবেক অধ্যাপক যেভাবে স্থানীয় ইতিহাস সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন
স্থানীয় ইতিহাসের ওপর পিএইচডি করতে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন মো. মাহবুবর রহমান।
প্রধান কারণ, তথ্য সংকটে। তথ্য সংগ্রহে নেমে দেখলেন, কোথাও এক জায়গায় স্থানীয় ইতিহাসের ওপর তথ্য পাওয়া যায় না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক হওয়ার পরও এ সমস্যা তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে।
এরপর ৯০'র দশকে নেদারল্যান্ডসের একটি আর্কাইভসে গিয়ে দেখেন সেখানে পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন ও সাময়িকী সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে।
সেখান থেকেই ড. মো. মাহবুবর রহমান বাংলাদেশেও একটি হেরিটেজ আর্কাইভস গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন।
সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে নিজের বাসাতেই লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার সংগ্রহ করতে শুরু করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবর রহমান জানালেন, এভাবে সংগ্রহ করতে করতে ২০০২ সাল থেকে বাসাবাড়িতে সেলফ করে সংগ্রহ করা শুরু করেন।
প্রতিষ্ঠিত হয় 'হেরিটেজ: বাংলাদেশের ইতিহাসের আরকাইভস' নামের এই সংগ্রহশালা।
১৮৭২ সালে করা প্রথম আদমশুমারী রিপোর্ট, কিংবা সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট বা ভূমি জরিপের রিপোর্ট কিংবা সরকারি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা দুষ্প্রাপ্য রিপোর্ট- সবই সংগ্রহ করেছেন মাহবুবর রহমান।
মাহবুবর রহমান বলেন, "লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, স্মরণিকা ও সাময়িকী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি দেশের সময়কে জানতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অথচ বাংলাদেশের কোথাও এসব সংগ্রহ করে রাখা হয় না। তাই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাতেই এসব সংগ্রহ করা শুরু করি।"
তিনি বলেন, "১৯৯৮ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাসাতেই লিফলেট, পোস্টার ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের স্মরণিকা ও বার্ষিকী সংগ্রহ শুরু করি। তখন ছাত্রছাত্রীদের পড়াতাম। তাদের বলতাম, তাদের স্কুল-কলেজে স্মরণিকা ও বার্ষিকী পেলে যেন নিয়ে এসে আমাকে দেওয়া হয়! বেশ সাড়া পেলাম, ছাত্রছাত্রীদের সাথে বন্ধুবান্ধবরাও লিফলেট, ব্যানার, পোস্টার, স্মরণিকা ও বইপত্র দিতে শুরু করলো। আমি প্রতিদিন রাজশাহীর সাহেব বাজারে পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে কেজি দরে বইপত্র, ম্যাগাজিন কিনে নিয়ে আসতাম। এভাবে একবার দুইমণ বিচিত্রা পত্রিকা কিনে নিয়ে আসি।"
এখানে ইতোমধ্যে সংগৃহীত হয়েছে ৩০৯৫ শিরোনামে প্রায় ৩০,০০০ সাময়িক পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন ও গবেষণা জার্নাল। রয়েছে প্রায় ৫২০০ পোস্টার ও ৫০০০ লিফলেট। সংগ্রহশালায় রয়েছে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার উপর প্রায় ১০,০০০ গ্রন্থ, স্মরণিকা ও বার্ষিকী। রয়েছে ৪৭১টি এমফিল ও পিএইচডি থিসিস এবং আদিবাসী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। জীবনীগ্রন্থের ওপর বিশাল সংগ্রহ রয়েছে হেরিটেজ আর্কাইভসে।
প্রায় ৩২০০টি জীবনী গ্রন্থ রয়েছে যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা জীবনী গ্রন্থ রয়েছে ৫৭২টি। রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে প্রায় ১২০০ গ্রন্থ, প্রায় ৫০০ রাজনৈতিক সাহিত্য।
তাছাড়া বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, শ্রমিক, নারী, রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়ে অসংখ্য গ্রন্থ ও ডকুমেন্টস, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার স্মরণিকা ও বার্ষিকী, ১৯৯৮ সাল থেকে সংবাদ পত্রিকা, বামপন্থী পত্রিকা ভ্যানগার্ড ও একতা পত্রিকা, ৫০টি বিষয়ে পেপার ক্লিপিং, দৈনিক পত্রিকার ঈদ ও নববর্ষ সংখ্যা কয়েকশত, প্রায় ৩০০টি বিষয়ে কয়েক হাজার গ্রন্থ ইত্যাদি এখানে সংগৃহীত হয়েছে।
হেরিটেজ আরকাইভস এখন পর্যন্ত ৬৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সংগ্রহ দান হিসেবে পেয়েছে। এসব সংগ্রহে অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ, সরকারি রিপোর্ট ইত্যাদি আছে।
ড. মো. মাহবুবর রহমান বলেন, "আমি সংগ্রহ শুরু করার সময় ভেবেছি, বাংলাদেশের লাইব্রেরিতে যেসব সংগ্রহ করা হয়না, সেসব এই হেরিটেজ আর্কাইভসে সংগ্রহ করা হবে। বাংলাদেশের কোথাও কেউ লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, স্মরণী ও সাময়িকী সংগ্রহ করে না। একমাত্র হেরিটেজ আর্কাইভসেই তা সংগ্রহ করা হয়। এখানে বেশিরভাগ লিফলেট, ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, স্মরণী ও সাময়িকী ৯০'র দশকের হলেও ৭০'র দশকের অনেক লিফলেট, পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার, স্মরণীকা ও সাময়িকী রয়েছে। কারণ এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।"
"দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছে। যখন যেখানে পেয়েছি ট্রাক ভর্তি করে কিনে এনেছি অনেক সময় কিনে কুরিয়ারে নিয়ে আসা হয়েছে। তারপর বেছে হেরিটেজ আর্কাইভসে রাখা হয়েছে। প্রায় ৪০ থেকে ৪৫টি জেলায় আমার নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। তাদের জেলার স্থানীয় ইতিহাসের ওপর কোনো লেখা ম্যাগাজিন বা বইপুস্তক বের হলে তারা আমাদের দেন।"
তিনি বলেন, "২০০২ সাল থেকেই সংগ্রহের ক্যাটালগ করা হতো। ২০০৬ সালে বর্তমান ভবনের স্থানে জমি কিনে একতলা বিল্ডিং করে সেখানে সংগ্রহশালা গড়ে তুলি। এখানে বর্তমানে ৭ ফিট বাই তিন ফিট বুক সেলফ রয়েছে ১৭৮টি। আরও কিছু আলমারি রয়েছে যাতে বইপুস্তক সংগ্রহ করে রাখা হয়।"
২০১১ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত হেরিটেজ আরকাইভ পরিদর্শনে এসে অভিভূত হন। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হেরিটেজ আর্কাইভসের তিনটি ফ্লোর নির্মাণ করে দেন তিনি। ফলে বইপত্র রাখার স্থানের এখন আর কোনো অভাব নেই।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেনও গত ১৪ই নভেম্বর (২০২০) হেরিটেজ আরকাইভস পরিদর্শন করেছেন।
তবে বর্তমানে হেরিটেজ আর্কাইভসটি একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, এখানে ৬ জন স্থায়ী কর্মী আছেন। হেরিটেজ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. মাহবুবর রহমান নিজেই।
এটি শুক্রবার বাদে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। হেরিটেজ ভবনে গবেষকদের জন্য ২টি গেস্টরুম আছে। দেশ বিদেশের অনেক গবেষকরা এখানে এসে থেকে গবেষণা করেন। হেরিটেজ আরকাইভসে ৭০ আসন বিশিষ্ট ১টি সেমিনার কক্ষও আছে। এখানে নিয়মিত সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়া হেরিটেজ আরকাইভস থেকে স্থানীয় ইতিহাস নামক একটি গবেষণা জার্নাল প্রকাশিত হয়। এ জার্নালের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে জেলা বা তার নিচের প্রশাসনিক ইউনিটভিত্তিক যেকোন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। স্থানীয় ইতিহাস জার্নালের ২৩তম সংখ্যা ছিলো 'মুজিববর্ষ' সংখ্যা। স্থানীয় ইতিহাসের ২৫তম সংখ্যা হবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সংখ্যা যা আগামি মার্চ মাসে বের হবে।
ড. মাহবুবর রহমান বলেন, "হেরিটেজ আর্কাইভসকে এমনভাবে সংগ্রহশালা তৈরি করা হয়েছে যেখানে থেকে একজন গবেষক সাতদিনে বাংলাদেশের যেকোনো বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ লিখতে পারবে। তবে আরকাইভসের নিজস্ব কোন আয়ের উৎস নেই। আমার ও ব্যক্তি অনুদানে এটি চলে। নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস করা গেলে আর্কাইভস নিয়ে কোনো চিন্তা থাকতো না। বর্তমানে স্থানীয় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ডিজিটালাইজেশনের কাজ চলছে। অনেক লিফলেট, পোস্টার, ম্যাগাজিন ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে।"
হেরিটেজ আরকাইভসের একটি অংশ পারিবারিক জাদুঘর। এখানে পারিবারিক জীবনের বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়, যেমন : হুকা, হেরিকেন, কূপি, কলের গান, টেলিফোন সেট, রেডিও, কলম, দোয়াত, টাইপ রাইটার, সাইক্লোস্টাইল মেশিন, ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার, যাতা, খড়ম, পয়টা, পান বাটা, কাসার বাসনপত্র, মাটির জিনিসপত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি, মুদ্রা, বিয়ের কার্ড, বিয়ের শাড়ি, আমন্ত্রণপত্র, ইত্যাদি।