ইস্পাহানি কলোনীর গান আর বাগান আজও আমার স্মৃতিতে
আমরা কবে টিকাটুলি ছেড়েছি, তারিখ সঠিক মনে নেই। তবে সালটা ছিল ১৯৫৭। আমাদের (নিজেদের) বাড়ির কাজ চলছিল দিলু রোডে। কিন্তু তার আগেই টিকাটুলি ছাড়তে হয়েছিল বলে মাঝে একটা বছর ছিলাম ইস্পাহানি কলোনীতে।
ইস্পাহানি কলোনী ছিল মগবাজার মোড় পেরিয়ে হাতের বাঁ দিকে। বাবা ব্যাংকে চাকরি করতেন বলে, তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম পুঁজিপতি পরিবারের মির্জা আহমেদ ইস্পাহানির সঙ্গে আমার বাবার ভালো সম্পর্ক ছিল। ঢাকায় তখন তো এখনকার মতো এত বাড়িঘর ছিল না। বাবা ঢাকায় ভাড়া থাকার মতো বাড়ি খুঁজছিলেন। এমন কোথাও যেখানে থেকে দিলু রোডের বাড়িটার নির্মাণ কাজও সহজে দেখাশোনা করা যাবে। আর তখন ইস্পাহানি সাহেবই বাবাকে তাদের ইস্পাহানি কলোনীতে থাকার জন্য বললেন।
আমরা ঐ বাড়িতে ওঠার আগে একবার বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলাম। ছোট্ট, সুন্দর, ছিমছাম একটা একতলা বাড়ি। টিকাটুলির বাড়িগুলো ছিল পুরোনো ধাঁচের। কিন্তু ইস্পাহানি কলোনীর বাড়িগুলো ছিল আধুনিক ধরনের। ৮/এ রোডের তিন বেডের একটা বাসায় আমরা থাকতে শুরু করলাম ১৯৫৭ সালের মাঝামাঝি থেকে।
পাড়া বলতে টিকাটুলিকে যেমন দেখেছি, এটা সেরকম ছিল না। সামনে একটা বাগান ছিল, বেশ সুশৃঙ্খল ভদ্র একটা এলাকা ছিল।
টিকাটুলির মতো আশেপাশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে এত ভাবও ছিল না। হবেই বা কী করে, একবছরেরও কম সময় থেকেছি সেখানে। অনেকটা মুসাফির হয়ে এসেছিলাম। তবে ঐ গলির ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা ছিল, আমরা সেখানে প্রায়ই হাঁটতে যেতাম।
আমার নানাভাই আমাদের সঙ্গেই থাকতেন বাড়ির কাজ তদারকি করার জন্য। বড় বড় হিসেবের খাতায় প্রতিদিনের কাজের হিসেব লিখে রাখতেন। প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে এই কাজ করতেন আমার নানাভাই। সকালে লাল চা খাওয়ার অভ্যাস ছিল নানার। আমাকে দেখলেই নানাভাই পিরিচে করে একটু লাল চা খেতে দিতেন।
চুরি করিনি, বন্ধুদের দেখাবো বলেই নিয়েছিলাম
যেহেতু বাড়ির কাজ চলছে, তাই খুচরা টাকাপয়সা বাড়িতে থাকতো তখন। আমি তো টাকাপয়সা কী জিনিস বুঝতাম না, আমি এসব নিয়ে খেলতাম। টাকা ছিল আমার কাছে কিছুটা খেলার সামগ্রী।
তাই একদিন বান্ডিল থেকে একটা টাকার নোট নিয়ে আমার ব্যাগে ভরে রেখেছি, বন্ধুবান্ধবকে এই অন্যরকম জিনিসটা দেখাতে হবে তো! এটার যে মূল্য আছে, এটা দিয়ে যে কেনাকাটা করা যায় এতকিছু তো আর বুঝতাম না তখন।
যাইহোক, বাসায় আমাকে পরে জিজ্ঞেস করা হলো, আমি টাকা নিয়েছি কি-না। আমি তো বুঝিইনা টাকা কী জিনিস। এটা যে টাকা তা-ই তো জানতাম না! আমি কিছু না বুঝেই দিলাম এক দৌড়। আমার ভাই আমাকে ধরে নিয়ে এলো। এরপর আমার ব্যাগ খোলা হলো। ব্যাগে পাওয়া গেল একটা এক টাকার নোট।
এ-ই ছিল আমাদের তখনকার বুঝবুদ্ধি। এরপর টাকা খরচ করতে শিখেছি অনেক পরে গিয়ে।
লোকজন বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে গান শুনতো
আমাদের বড় ভাইয়েরা গান ও তবলা শিখতো ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে। তার অনেক সাগরেদ এখনও আছে। তার কাছেই ক্লাসিক্যাল ধ্রুপদী গান শিখতো আমার ভাইয়েরা। আমি দেখতাম, লোকজন বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে গান শুনছে। এই দৃশ্য কি এখন দেখা যায়?
ভাইদের মধ্যে একজন তবলা বাজানো শিখতো, আরেকজন শিখতো গান গাওয়া। আমিও গান শিখতাম, তবে রেডিওতে শুনে শুনে। রেডিও শুনে আমি জীবনে প্রথম যে গান শিখেছি তা হলো, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশী'। যদিও রবীন্দ্রসংগীত খুব একটা পছন্দ না আমার।
তখন আমার পাঁচ বছর। আমার বাবা দেখলো যে, ভাইদের গান শেখানো সময় আমিও গিয়ে ভাইদের সঙ্গে বসে থাকতাম।
গান যখন দ্রুত হয়, তখন ওস্তাদজি আমাকে একটা সিকি দিয়ে বলতেন, তুমিও তাল দাও। আমি তাল দেয়াটা খুব ভালোভাবে শিখেছিলাম।
এরপর একদিন বাবা আমাকে ওস্তাদজির সামনে নিয়ে গেলো।
'ওস্তাদজি আরেকজনকে আনলাম, ও ও শিখবে এখন থেকে আপনার কাছে।'
ওস্তাদজিকে আমার বাবা সালামি অর্থাৎ গুরুদক্ষিণা দিলেন। তখনকার দিনে 'সালামি' কে দেখা হতো একটা ভদ্র আচরণ হিসেবে।
কান দিয়ে গান শিখতাম
খুব পছন্দ করতেন ওস্তাদজি আমাকে। ওস্তাদজি আমাকে দেখে বললেন, 'ও গান শিখবে? ও তো আমাদের সঙ্গে এমনিই বসে থাকে।'
গান যে আমি রেডিও শুনেই গাইতে পারি সেটা তো আর ওস্তাদজি জানেন না। আমাকে তিনি গান গাইতে বললেন। পাঁচ বছর বয়স, কোনো লজ্জাটজ্জাও ছিল না। আমি নির্দ্বিধায় 'আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি' গানটা গাইলাম। গান শুনে ওস্তাদজি একদম চুপ। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, 'ও কার কাছে গান শেখে? আমার বড় ভাই বললেন, ' ও রেডিও শুনে শুনে গান গায়।'
ওস্তাদজি তখন বললেন, 'তোমার ওই সারেগামা শেখার দরকার নাই। যেহেতু কান দিয়েই শিখেছ গান, কান দিয়েই শেখো।'
প্রথমদিনেই তিনি আমাকে পুরিয়া ধানেশ্রি রাগের একটি গান শোনালেন- 'গোধূলী লগনে কে এল, চুপিচুপি রাঙা পায়ে'
এটা কি নজরুলের গান না কার গান আমি কিছুই জানিনা। তবে, এটা ছিল আমার ওস্তাদের কাছ থেকে শেখা প্রথম গান। অত্যন্ত ধ্রুপদী কায়দায় শেখানো হতো।
এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো গান মুখস্থ আমার। তারপর দ্বিতীয় গান। সেটা ছিলো ভৈরবী গান, 'তুম জাগো মওহানা পিয়া'। ওস্তাদজি যখন এই গান গাইতেন, আমাকেও গাইতে হতো তার সঙ্গে। তখন ওস্তাদজি বলতেন 'দেখো, কান দিয়ে শেখে বলে ও ঠিক ধরতে পারছে'।
তৃতীয় গানটা ছিল, 'আল্লাহু আল্লাহ, জাল্লে শান আল্লাহ'। এটাও ভৈরবী। আমি এই গানটা বহুদিন শুনিনি। এরপর একদিন ইউটিউবে বিসমিল্লাহ খানের গলায় গানটা শুনলাম। এরপরে ইউটিউবেই আবার পেলাম অজয় চক্রবর্তীর গলায় এই গান। আমি সবসময় খুঁজেছি এই গানটা। আমার খুব প্রিয় একটি গান।
ক্লাসিক্যাল গানে সুরটাই মূল।
একদিন ওস্তাদজি আমাকে বললেন, তোমাকে আমি তারানা শেখাবো। তারানা কি আমি জানিনা। তারানা হলো, যেখানে কোনো স্পষ্ট শব্দ নেই, শুধু সুর আর লয়ের খেলা।
পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে বসে ক্লাসিক্যাল গান শুনতাম
এরপর আমি যখন সা-রে-গা-মা শিখলাম তখন আমি আপনাপনিই বুঝে গেছি গানের কোনটা সা, কোনটা রে কোনটা গা।
খুব সহজে কান দিয়ে আমি গান শিখেছি। তাই আজ ৬৫ বছর পরেও আমি গান শুনলেই অনেকটা বুঝতে পারি, গান কোন রাগে হচ্ছে, কোথায় উঠছে, কোথায় নামছে।
যেহেতু আমার শেখা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গানটা ছিল ভৈরবী, এখন ভৈরবী আমার প্রিয় রাগ। পুরিয়া ধানশ্রি, আদানা, জনপুরী এই ক্লাস্টারটা আমার খুব ভালো লাগে।
দরবারি রাগ অবশ্য বেশিরভাগের ভালো লাগে। আমার দরবারীর চেয়ে ভৈরবীই ভালো লাগে বেশি। আগে এটা মাহফিলের শেষে গাওয়া হতো। রাতের শেষভাগে গাওয়া হতো বলে এটা ছিল শেষ রাতের রাগ। যা এখন সকালের রাগ হয়ে গেছে।
ওস্তাদজি রেডিওতে গান গাওয়ার আগে আমাদের বলে যেতেন, 'তোমরা বলবে গানের কোনটা কোন রাগ'।
ক্যায়া কারু সাজানি আয়েনে বালেম- আমার মনে আছে আমরা পুরো পরিবার একসঙ্গে বসে শুনলাম। এখন এরকম পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে বসে ক্লাসিক্যাল গান শুনতে দেখা যাবে?
আমাদের মা গিটার বাজাতেন!
আমাদের দেখে আমার মায়েরও ইচ্ছে হলো গান শেখার। বাবা গিয়ে আমার মায়ের জন্য একটা গিটার কিনে আনলেন। আমার মা ক্লাসিক্যাল গিটার বাজানো শিখতেন। তখন ১৯৫৮ সাল, আমার মা ছিলেন একজন রক্ষণশীল, ধার্মিক এবং চার সন্তানের জননী। সেই অবস্থাতেও মা তখন গিটার বাজাতো। ভাবা যায়? কিন্তু এটাই ছিল তখনকার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের চিত্র।
ইস্পাহানি কলোনী থেকে দুটো স্মৃতি নিয়ে এসেছিলাম
একটি হলো গান। তখন এই ধ্রুপদী গানগুলো শেখা না হলে, এখন হয়তো আর এসব শুনতাম না। অপরটি হলো বাগান। টিকাটুলির বাগান বলতে ছিল সবজির বাগান।
কিন্তু ফুলের বাগান পেয়েছি প্রথম ইস্পাহানি কলোনীতেই। আমরা যখন এরপরে দিলু রোডের বাসায় চলে আসি, ইস্পাহানি কলোনীর মালীও তখন আমাদের সাথে চলে আসলো। বাসায় পার্টটাইম মালী হয়ে আসলো, ইস্পাহানি কলোনীর মালী। তার বেতন ছিল মাসে ৩০ টাকা।
আমরা এই কলোনীতে প্রায় একবছরের মতো ছিলাম। খুব বেশি মেশা হয়নি, তবে এতটুকু বলবো, সবাই বেশ ভদ্র-নম্র ছিল। এখনকার দিনের বড়লোকের মতো ছিলেন না।
এরপর ১৯৫৮ সালে সম্ভবত ফেব্রুয়ারী মাসে আমাদের দিলু রোডের যাত্রা শুরু হলো।
- লেখক- সাংবাদিক ও গবেষক