‘কাকে বাবা ডাকবে জান্নাত!’
'এক সপ্তাহ আগে প্রথম কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছিলেন আমার ভাই মনিরুজ্জামান। দুইদিন আগে ফোনে কথা হয়েছিল। সকালে শুনলাম সে আর নেই, এখন কাকে বাবা ডাকবে জান্নাত,' চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মর্গের সামনে কেঁদেকেঁদে কথাগুলো বলছিলেন ফায়ার সার্ভিসের নিহত সদস্য মো. মনিরুজ্জামানের (৫০) বড় ভাই মো. আলী।
নিহত মনিরুজ্জামান কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট থানার সাতবাড়িয়া পৌর এলাকার শামসুল হকের সন্তান। তিনি কুমিরা ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন। মনিরুজ্জামান কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে বদলি হয়ে কুমিরা ফায়ার সার্ভিসে আসেন।
মো. আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'তিন বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছিলেন মনিরুজ্জামান। এক সপ্তাহ আগে তার ঘর আলো করে আসে শিশুকন্যা জান্নাতুল মাওয়া। কিন্তু বাবার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই সে এতিম হয়ে গেল।'
শুধু মনিরুজ্জামান নন। সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুন নেভাতে গিয়ে বিস্ফোরণে আট দমকলকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চারজনের পরিচয় মিলেছে। মো. মনিরুজ্জামান ছাড়া অন্য তিনজন হলেন হাবিবুর রহমান (১৯), মোমিনুল হক (২৪), ও মহিউদ্দিন (২২)।
বাকিদের পরিচয় শনাক্তে আগামীকাল থেকে স্বজনদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামে ডিআইজি আনোয়ার হোসেন। রোববার (৬ জুন) বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ তথ্য জানান তিনি।
আরও পড়ুন: ১৫ জনের পরিচয় শনাক্ত, বাকিদের শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা কাল থেকে
ছেলের অপেক্ষায় বাবা, বাবার অপেক্ষায় সন্তান
বিএম কনটেইনার ডিপোর ট্রাক হেলপার মো. রুবেল গতকাল শনিবার রাত আটটার দিকে তার বাবা সাইদুলের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছিলেন। রুবেল জানিয়েছিলেন, কাজ শেষে তিনি শিগগির বাসায় ফিরবেন।
বাবার সঙ্গে এটা ছিল রুবেলের শেষ কথা। তারপরই ডিপোতে ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বিস্ফোরণের পর রুবেলের ফোন বন্ধ পান বাবা। এরপর ছেলের খোঁজে চমেক-এর এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি।
পাঁচ বছরের সিয়াম তার মায়ের হাত ধরে হাসপাতালে এসেছে বাবার খোঁজে। সিয়ামের মা নাজনিন জানান, তাদের বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলায়। তার স্বামী শাহাজাহান ওই ডিপোতে কাজ করতেন। গতকাল রাত নয়টার দিকে শাহাজাহানের সঙ্গে পরিবারের কথা হয়। তারপর থেকে তার মুঠোফোন বন্ধ রয়েছে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, '৪৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছি। ৪১ জনের মরদেহ চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯০ জনের বেশি। গুরুতর দগ্ধ তিনজনকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে ১৫ জন, জেনারেল হাসপাতালে ছয় জনকে ভর্তি করা হয়েছে।'
সীতাকুণ্ড অগ্নিদুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের নিহত ও নিখোঁজ কর্মীদের নামের তালিকা :
১। জনাব মোঃ রানা মিয়া, ফায়ারফাইটার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-মানিকগঞ্জ (নিহত)।
২। জনাব মনিরুজ্জামান, নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-কুমিল্লা (নিহত)।
৩। জনাব আলাউদ্দিন, ফায়ারফাইটার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-নোয়াখালী (নিহত)।
৪। জনাব মোঃ শাকিল তরফদার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন (নিহত)।
৫। জনবা মিঠু দেওয়ান, লিডার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-রাঙ্গামাটি (নিহত)।
৬। জনাব মোঃ ইমরান হোসেন মজুমদার, লিডার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-চাঁদপুর (নিখোঁজ)।
৭। জনাব শফিউল ইসলাম, ফায়ারফাইটার, কুমিরা ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-সিরাজগঞ্জ (নিখোঁজ)।
৮। জনাব নিপন চাকমা, লিডার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-রাঙ্গামাটি (নিহত)।
৯। জনাব রমজানুল ইসলাম, ফায়ারফাইটার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-শেরপুর (নিহত)।
১০। জনাব সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ফায়ারফাইটার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-ফেনী (নিহত)।
১১। জনাব মোঃ রবিউল ইসলাম, ফায়ারফাইটার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-নওগাঁ (নিখোঁজ)।
১২। জনাব ফরিদুজ্জামান, ফায়ারফাইটার, সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন, নিজ জেলা-রংপুর (নিখোঁজ)।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১২ জন নিখোঁজ আছেন। ডেডবডি পাওয়া গেছে ৯ জনের। এর মধ্যে পরিচয় শণাক্ত করা গেছে ৮ জনের। বাকি নিখোঁজ ৪ জনের মধ্যে উদ্ধারকৃত ডেডবডি কার তা শণাক্ত করার চেষ্টা চলছে।