তাঁত বোর্ডের উৎপাদন কেন্দ্র এখন পরিত্যক্ত পোড়াবাড়ি
রঙ উঠে পাকা ভবনে ধরেছে ফাঁটল, খসে পড়েছে পলেস্তারা। মরিচা ধরেছে ভবনের ফটক ও জানালায়। অব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো হয়ে পড়ছে অকেজো। এছাড়া চারপাশের ঝোপঝাড়ের কারণে তৈরি হয়েছে ভীতিকর পরিবেশ। সবকিছু মিলিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় থাকা তাঁত বোর্ডের সার্ভিসেস অ্যান্ড ফ্যাসিলিটি সেন্টারটি অনেকটা পরিত্যক্ত পোড়াবাড়িতে পরিণত হয়েছে।
সরকারিভাবে তাঁত পণ্য উৎপাদন ও তাঁতীদের সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে দুই যুগেরও বেশি সময় আগে নির্মিত এই সেন্টারটি আজও চালু হয়নি। ঠিক কী কারণে চালু হয়নি বা হচ্ছে না সেটিও জানা নেই দায়িত্বরত কর্মকর্তার। অরক্ষিত এই সেন্টারে নিজেকেও নিরাপদ মনে করেন না ওই কর্মকর্তা। অথচ এই সেন্টারেই হতে পারতো অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থান।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সদরের তিতাস নদীর পূর্বপাড় ঘেঁষে ২.৫০ একর জমিতে সেন্টারটি নির্মাণ করে তাঁত বোর্ড। তৎকালীন সময়ে তাঁত পণ্যের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে এই সেন্টারটি নির্মাণ করা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সার্ভিসেস অ্যান্ড ফ্যাসিলিটি সেন্টার নামকরণ হলেও মূলত তাঁত পণ্য উৎপাদনের জন্যই এটি নির্মাণ করা হয়। এই সেন্টারে বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একটি কারখানা, একটি অফিস, একটি স্টোর, একটি আবাসিক ও একটি ডরমেটরি ভবন রয়েছে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের এই প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবে তাঁত পণ্য উৎপাদন ও তাঁতীদের প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার কথা ছিল। তাঁতের কাপড় বুনন, কাপড়ে রঙ করা এবং কাপড় বুনন পরবর্তী বিভিন্ন নকশা করাসহ তাঁতীদের বিভিন্ন সেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয় সেন্টারটিতে।
এটি চালু করার জন্য নির্মাণ কাজ সম্পন্ন এবং যন্ত্রপাতি সংযোজন করার পরপরই ১৯৯৬ সালে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করতে বিজ্ঞপ্তি দেয় তাঁত বোর্ড। কিন্তু সেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও একই বছর অজ্ঞাত কারণে বাতিল করা হয়। সেন্টারটি চালু করতে ইতোপূর্বে কয়েক দফায় বস্ত্র মন্ত্রণালয় ও তাঁত বোর্ডের পৃথক প্রতিনিধি দল এসে সেন্টারটি পরিদর্শন করে গেছে। কিন্তু নির্মাণের দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও একদিনের জন্যও সেন্টারটি চালু করা হয়নি।
দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। এখনও কারখানা ভবনের ভেতরে ৪০টি সেমি অটো তাঁত মেশিন রয়েছে। এর সবগুলোই অকেজো। বর্তমানে সেন্টারটিতে শুধুমাত্র একজন লিঁয়াজো কর্মকর্তা আছেন। তিনি এসেছেন প্রায় পাঁচ বছর আগে। অন্যদিকে একজন নিরাপত্তাপ্রহরী গত বছরের সেপ্টেম্বরে অবসরে গেছেন। এরপর থেকে সরকারি এই সম্পত্তি অরক্ষিত হয়ে আছে।
রাজধানীর সিলভার কম্পোজিট টেক্সটাইলের নির্বাহী (টেক্সটাইল ডিভিশন) তানবীর হোসেন জানান, ওই সেন্টারে থাকা সেমি অটো তাঁত মেশিনগুলো এখন আর ব্যবহৃত হয় না। তবে যে সময় ওই মেশিনগুলো কেনা সে হিসেবে প্রতিটি মেশিনের দাম প্রায় এক লাখ টাকা হতে পারে।
তাঁত বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওই সেন্টারে ভবন-যন্ত্রপাতি মিলিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে।
বিশাল এই সেন্টারটিতে লোকবল বলতে কেবলমাত্র একজন লিঁয়াজো কর্মকর্তা রয়েছেন। পুরো সেন্টারটি এখন তার দায়িত্বে। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে ইদু মিয়া নামে ভূমিহীন এক ব্যক্তি তার পরিবার নিয়ে সেন্টারটিতে বসবাস করছেন। নিরাপত্তাপ্রহরী না থাকায় তিনিই সেন্টারের দেখাশোনা করেন।
ইদু মিয়া বলেন, আমার ঘর-বাড়ি না থাকায় এলাকার চেয়ারম্যানকে বলে লিয়াজোঁ কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে গত ১০ বছর ধরে এই সেন্টারে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। কিন্তু এখানে থাকার মতো কোনো পরিবেশ নেই। পুরো সেন্টারটি একটা জঙ্গলের মতো। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করিনা- যেন বখাটেরা এসে এখানে আড্ডা জমাতে না পারে। নিরাপত্তাপ্রহরী অবসরে যাওয়ায় এবং নতুন করে কোনো নিরাপত্তাপ্রহরী নিয়োগ না হওয়ায় আমিই এখন সেন্টারের দেখাশোনা করি। কিন্তু সবসময় মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে।
সেন্টারটি চালু হলে এলাকার অনেক বেকার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। সেজন্য এটি চালু করতে সংশ্লিষ্ট দফতরে একাধিকবার যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। তিনিও এটি চালু হওয়ার বিষয়ে আর কোনো আশার আলো দেখছেন না। তবে স্থানীয়দের দাবি, এটি চালু করে যেন বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।
বাঞ্ছারামপুর পৌর এলাকার বাসিন্দা ফারুক আহমেদ বলেন, এলাকার মানুষ এখনও বিশ্বাস করে যে, সেন্টারটি একদিন চালু হবে।
লিয়াজোঁ কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শুরু থেকেই সেন্টারটি বন্ধ রয়েছে। কেন এটি চালু হয়নি, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবেন। আমি ছাড়া এখন আর কেউ এখানে কর্মরত নেই। এটি চালু করতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিনিধি দল পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।
তিনি আরও বলেন, এখন যদি এটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে সবকিছু নতুন করে সংযোজন করতে হবে। কারণ আগের সেমি অটো তাঁত মেশিন দিয়ে উৎপাদন করে খরচে কুলানো যাবে না। সেজন্য পাওয়ার লোম মেশিন বসাতে হবে।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সারোয়ার বলেন, জনগণের করের টাকায় তৈরি প্রতিষ্ঠানটি এভাবে পড়ে থাকবে তা আমরা চাই না। ভবনগুলো সংস্কার করে যদি ফলপ্রসু কিছু পাওয়া যায় তবে সেটি সংস্কার করা হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর) আসনের সংসদ সদস্য এ বি তাজুল ইসলাম বলেন, সেন্টারটি চালু করতে তাঁত বোর্ডকে একাধিকবার বলেছি। কিন্তু এটি একদিনের জন্যও চালু হয়নি। আমি বলেছিলাম হয় আপনারা কিছু করুন না হয় এটি আমাকে দিন। কিন্তু তারা কিছুই করছে না।