কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা চরমে - এশিয়াও সমানে সমান ছুটছে
আমাদের বর্তমান কম্পিউটার প্রযুক্তির আগামীতে যে বিবর্তন হতে যাচ্ছে, তাকেই বলা হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। আইবিএম-এর ওয়েবসাইটের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তামনে প্রচলিত সব কম্পিউটারের জন্য যেসব সমস্যা সমাধান খুবই কঠিন বলে বিবেচিত হয়, পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্রকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই সেসব সমস্যার সমাধান করতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে কোয়ান্টাম বিট ব্যবহার করা হয়, যেখানে প্রচলিত কম্পিউটারগুলোতে বাইনারি বিট ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে আমরা যে প্রযুক্তির কম্পিউটার ব্যবহার করি, তার বয়স অর্ধশতকের বেশি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। এ প্রযুক্তিকে সামনে প্রতিস্থাপিত করবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে বেশ এগিয়ে গেছে। আর এতে পিছিয়ে নেই এশিয়াও।
গত বছর জাপানের টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয় ও আইবিএম নতুন কোয়ান্টাম কম্পিউটার চালু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে এটিই দ্বিতীয় কোয়ান্টাম কম্পিউটার। কোয়ান্টাম প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে টোকিয়ো ইউনিভার্সিটি ও আইবিএম কোয়ান্টাম ইনোভেশন ইনিশিয়েটিভ কনসোর্টিয়াম তৈরি করেছে। এ প্রকল্পের সাথে আরও যুক্ত আছে টয়োটা ও সনি'র মতো জাপানের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো।
মার্কিন 'একচ্ছত্র আধিপত্যকে' চ্যালেঞ্জ
নতুন এ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি কম্পিউটারের হিসাব বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে কয়েকগুণ বেশি বাড়িয়ে তুলবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কার্যকরী কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করার জন্য একে-অপরের সাথে মোটামুটি প্রতিযোগিতা শুরু করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানি জাপাটা'র কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ফার্ম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিস্টোফার স্যাভই। নিজের ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় তিনি জাপানে কাটিয়েছেন। স্যাভই মনে করেন, বিশ্বে প্রাযুক্তিক উন্নয়ন সবসময় যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক হয়ে এসেছে। কিন্তু এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে এশিয়ার দেশগুলো আর পিছিয়ে থাকতে চাচ্ছে না।
'ভারত, চীন, জাপানের মতো দেশগুলো এখন আর বসে থাকার মনোভাব পোষণ করে না। তারা চায় না কেবল মার্কিন বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে প্রযুক্তির একছত্র আধিপত্য থাকুক,' যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস, মাইক্রোসফট আজুর ইত্যাদির মতো বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন স্যাভই।
কোয়ান্টাম প্রযুক্তির জ্ঞানের ক্ষেত্রে বড় অবদান রয়েছে চীনের। এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে কিছুকিছু ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে চীন। এদিকে ভারত এ বছরের শুরুতে ঘোষণা দিয়েছে তারা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানোর জন্য এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্স-এর বিশ্লেষক জেমস স্যান্ডার্স বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছে।
গত মার্চ মাসে স্যান্ডার্স-এর প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখি যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার প্রায় ৪২০ কোটি মার্কিন ডলার কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু উদাহরণ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার ৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ, সিঙ্গাপুরের শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দ্য সেন্টার ফর কোয়ান্টাম টেকনোলজি নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা।
কোথায় ব্যবহার করা হবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি?
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তির ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী। তবে সব দেশ যে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি থেকে সমান সুবিধা পাবে, তা কিন্তু নয়। স্যান্ডার্স-এর মতে, সবার জন্য কোয়ান্টাম প্রযুক্তির সুফলগুলো তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান হবে না।
স্যান্ডার্স বলেন, 'মাঝেমধ্যে আমি মানুষজনকে বোঝাতে চেষ্টা করি যে কোয়ান্টাম মোবাইল ফোন নিয়ে বেশি মাথা না ঘামাতে, কারণ এমন কিছু বাস্তবে কখনো হবে না।'
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় প্রয়োগ দেখা যাবে দুইটি খাতে- শিল্পখাত ও প্রতিরক্ষা খাত।
'যেসব স্থানে উচ্চ কার্যক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার থাকবে, সেসব স্থানেই প্রভাব রাখতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ থাকবে ম্যাটেরিয়াল সিমুলেশন, অ্যারোডিয়নামিক সিমুলেশন ইত্যাদির মতো খুবই উচ্চমানের ও কঠিন গাণিতিক হিসাব। এছাড়া থাকবে মেশিন লার্নিং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স,' বলনে স্যাভই।
ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে গতানুগতিক কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে ঔষধের অণুর আচরণ হিসাব করার কাজটি খুবই সময়সাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর মাধ্যমে এ কাজের দ্রুতি বাড়ানো সম্ভব হবে, যার ফলে কোনো নতুন ঔষধ তৈরি ও তা বাজারে ছাড়ার ক্ষেত্রে মোট প্রয়োজনীয় সময়ের পরিমাণ অনেক কমে যাবে।
নিরাপত্তা ঝুঁকি
এত সুবিধা থাকার পাশাপাশি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তির কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এ প্রযুক্তি নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে। কারণ, যেহেতু কম্পিউটারের কাজ করার ক্ষমতা বাড়বে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এ, তার ফলে একই সাথে বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলোও আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তির কারণে আরএসএ সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়বে বলে জানান স্যাভই। আরএসএ হচ্ছে একপ্রকার পাবলিক-কি ক্রিপ্টোসিস্টেম। এটি ডেটার নিরাপত্তার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এনক্রিপশন পদ্ধতিগুলোর একটি। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের দ্রুতির কাছে আরএসএ আর কার্যকরী থাকবে না।
আরএসএ অ্যালগরিদম ১৯৭৭ সালে তৈরি করা হয়। এটির নামকরণ করা হয়েছে এর তিন আবিষ্কারকের নামের অংশ নিয়ে। এরা হলেন রন রিভেস্ট, অ্যাডি শামির, ও লিওনার্ড আডেলমান।
'বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা গোষ্ঠী চায় না, তারা সবার পরে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি হাতে পাক। কারণ, অন্য কারও কাছে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি থাকলে তারা সহজেই এসব দেশের তথ্যে দখল নিতে পারবে,' বলেন স্যাভই।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাইবারনিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান রেসপন্সিবল সাইবার-এর প্রধান তথ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা মাগদা লিলিয়া চেলি বলেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তির পাশাপাশি একই সাথে এনক্রিপশন ব্যবস্থা নিয়েও গবেষণা ও উন্নয়ন ঘটাতে হবে যাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেতাল হয়ে না পড়ে।
চেলি বলেন, 'কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো সবধরনের এনক্রিপশন ভেঙে ফেলতে সক্ষম হবে। আবার আরেকদল মনে করেন, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর উন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন শক্তিশালী এনক্রিপশন ব্যবস্থা তৈরি হবে যেগুলো ভাঙা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পক্ষেও সম্ভব হবে না।'
'সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, গবেষকেরা চাইছেন কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ব্যবহার করে বড় বড় গাণিতিক হিসাব দ্রুততার সাথে সম্পাদন করতে। আর বর্তমানের এনক্রিপশন পদ্ধতিগুলো বড় বড় সব গাণিতিক হিসাবের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে,' বলেন চেলি।
তাই, যদি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সফল হয় তাহলে এখনকার বেশিরভাগ এনক্রিপশন ব্যবস্থাগুলো ভেঙে ফেলার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যার ফলে যেকোনো এনক্রিপটেড বার্তার অর্থ উদ্ধার করা খুব সহজ হয়ে যাবে।
থেমে থেমে অগ্রগতি
স্যান্ডার্স বলেন, কোয়ান্টাম প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বাণিজ্যিকীকরণ এক ধাক্কায় বা নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্ভব নয়।
এনক্রিপশনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার মতো সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন সরকার কোয়ান্টাম প্রযুক্তি নিয়ে জলঘোলা করতে পারে। এছাড়া এ সংশ্লিষ্ট গবেষণা, সাফল্য, মূলধারার আগ্রহ সৃষ্টি ইত্যাদিও থেমে থেমে (স্টপ-স্টার্ট) হবে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করলেও তার ফলাফল খুব তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে না। তাই এ খাত নিয়ে বিনিয়োগকারীর আগ্রহ সবসময় এক থাকবে না; তারা মাঝপথে আগ্রহ হারাতে পারেন, বিনিয়োগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারেন। এর ফলে এ প্রযুক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
'কোয়ান্টাম প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এমনও হতে পারে, দেখা যাবে কোনো কোম্পানি কোনো সমস্যার একটি উপায় খুঁজে পেল, তার রেশ ফুরাতে না ফুরাতে আরেকটি কোম্পানি নতুন কোনো সাফল্যের দেখা পেল। এরপর অনেকদিনের জন্য সবকিছু আবার চুপচাপ হয়ে গেল,' বলেন স্যান্ডার্স।
কোয়ান্টাম প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো এটি নিয়ে গবেষণার জন্য যথোপযুক্ত মেধাবী মানুষ খুঁজে পাওয়া, যাদের এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দক্ষতা রয়েছে।
'কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বিষয়ক বিজ্ঞানী এবং একই সাথে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে কাজ করতে পারেন, এমনটা একদম সহজলভ্য কিছু নয়,' বলেন স্যাভই। তিনি মনে করেন, এ প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দেশকে সব স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একত্রে কাজ করতে হবে।
- সূত্র: সিএনবিসি