ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ না হলে কী হবে?
ইউক্রেনে যুদ্ধ সহসা শেষ হওয়ার লক্ষণ নেই। বরং আরও দীর্ঘসময় বা একাধিক বছর ধরেও চলতে পারে। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে এমন আভাসই দিচ্ছেন সমর কৌশলবিদ ও বিশ্ব নেতারা।
গত রোববার ন্যাটো জোটের সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে।
এর আগে গত এপ্রিলের শুরুতে এমন সতর্কবাণী শুনিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা। তার আভাসটিকে এখন আমেরিকায় রাজনৈতিকভাবেও গ্রহণ করা হয়েছে। ইউক্রেনের সহায়তায় আমেরিকা শত শত কোটি ডলারের যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করেছে। ওয়াশিংটন আরও বিপুল অংকের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইউরোপের নেতারাও হাত গুটিয়ে বসে নেই। ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁখো ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ কিয়েভ সফরের সময় ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দিয়েছেন ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আনুষ্ঠানিক প্রার্থীর স্বীকৃতি দানের আশ্বাস।
অন্যদিকে, এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার অন্ত ঘোষণা করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। এসব ঘটনাবলী একটি দীর্ঘায়িত যুদ্ধের বাস্তবতাকে ইঙ্গিত করছে। এক মাস আগে ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট অনুমান করে, ২০২২ সাল জুড়ে অব্যাহত থাকবে ইউক্রেনে লড়াই; আসছে বছরগুলোতে আরও তীব্র বা মৃদুলয়ে যুদ্ধ চলতেই থাকবে।
তাই নিজেদের তাৎক্ষণিক আর দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগগুলি মোকাবিলায় সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছে অধিকাংশ দেশ। পশ্চিমা দেশগুলির জন্য মূল উদ্বেগ নিরাপত্তা পরিস্থিতি; আর সে অনুসারে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে সঙ্গে খাদ্য ও জ্বালানির জন্য বিকল্প উৎসমুখী হওয়ার চেষ্টা তো রয়েছেই তাদের।
বাকি বিশ্বের জন্য অবশ্য অর্থনৈতিক উদ্বেগই অগ্রগণ্য। যুদ্ধের কারণে এরমধ্যেই ব্যাঘাত ঘটেছে বৈশ্বিক খাদ্য, সার, জ্বালানি ও কাঁচামাল সরবরাহে। এতে উৎপাদন ও ব্যবসার খরচ বেড়েছে, জীবনধারণ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। প্রায় সকল পণ্যেরই দাম আকাশ ছুঁতে চাইছে। খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহের ভবিষ্যৎ ঘিরেও দেখা দিচ্ছে অনিশ্চয়তা।
উন্নত জাতিগুলো এখন কয়েক দশকের মধ্যে রেকর্ড মূল্যস্ফীতির কবলে, তাই ব্যয় নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিচ্ছে । এতে কমবে ভোক্তা চাহিদা। রপ্তানির জন্য এসব বাজারের উপর নির্ভরশীলতা থাকায় তা বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগের কারণ।
আরেকদিকে জ্বালানি সরবরাহের ব্যাঘাত বিশ্বকে ১৯৭০ সালের তেল সংকটের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ওই সময়ে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়েছিল, একইসঙ্গে বাড়ছিল মূল্যস্ফীতি- অর্থনিতিতে এ পরিস্থিতি 'স্ট্যাগফ্লেশন' নামেই পরিচিত।
বাংলাদেশের ওপর বিপুল ভর্তুকির বোঝাও বাড়ছে।
মূলত সার ও জ্বালানি কিনতে ভর্তুকির বড় অংশ বরাদ্দ করে বাংলাদেশ। গত ৯ জুন জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত নয়া অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হতে চলা নতুন অর্থবছরের এ বরাদ্দ থাকলে তা হবে চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৫৪ শতাংশ বেশি। মোট ভর্তুকির ৪৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বিদ্যুৎ, এলএনজি ও কৃষি খাতে, যা অচিরেই শেষ হতে চলা বর্তমান অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বেশি।
প্রতিবেশী ভারতের মতো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে সার কেনার অবস্থা নেই বাংলাদেশের। এজন্য কানাডা থেকে '৩০০ থেকে ১,২০০ ডলার মূল্যে' সার কেনার কথা গত রোববার জানান কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
মন্ত্রী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছে মন্তব্য করেন, "আগামী বোরো মৌসুমে কী হবে তা আমাদের জানা নেই। কারণ এসময় সারের বিপুল সরবরাহ দরকার হয়।"
চারিদিকে বিপদ সংকেত
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি প্রাক্কলন করছে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ২০২২ সালে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৭০ লাখ বাড়বে।
খাদ্যের বৈশ্বিক এ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর শঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি জ্বালানি ও জীবনযাপনের ব্যয় নিয়েও একই রকম উদ্বেগ তুলে ধরেন, যা থেকে কোনো দেশ বা সমাজ মুক্ত থাকবে বলে উল্লেখ করেছেন।
এরমধ্যেই রেকর্ড উচ্চতায় থাকা জ্বালানি মূল্য অনেক দেশে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের জন্ম দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে জ্বালানির তেলের সংকটও। এ দুর্দশা দুনিয়াজুড়ে দেখা দিলেও বেশি হচ্ছে আফ্রিকায়।
খাদ্যের মূল্যও রেকর্ড উচ্চতার কাছাকাছি। সারের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। এতে শঙ্কার ছায়া পড়েছে সবখানেই। কারণ সার ছাড়া চাল, গম, ভুট্টা থেকে শুরু করে সকল প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিবে। এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার শত শত কোটি মানুষের ওপর যার মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
যুদ্ধ সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে ইউক্রেনের উৎপাদিত খাদ্যশস্য ও রাশিয়ার সারের যোগান নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে তিনি সতর্ক করে বলেন, "এই বছরের খাদ্য সংকট প্রধানত সরবরাহ পাওয়ার সুযোগ না থাকার কারণে। কিন্তু, আগামী বছর খাদ্যের ঘাটতির কারণেই তা হতে পারে।"
ধনী দেশগুলোয় এরমধ্যেই ভোক্তা মূল্যস্ফীতি বার্ষিক ৯ শতাংশ হারে বাড়তে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮০'র দশকের পর যা সর্বোচ্চ। দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক এক তথ্যও উঠে এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে- এসব দেশের মানুষও প্রতিনিয়ত মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা করছে।
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সিংহভাগ রপ্তানি বাজার থাকায়–এতে করে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমার নতুন শঙ্কা যোগ হয়েছে। পোশাক রপ্তানিকারকরা এখন তেমন কথাই বলতে শুরু করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, গত মে মাসে তা ছিল ৮.৬ শতাংশ। সেখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
১৯৭০ এর দশকের মতো ধর্মঘট ও মূল্যস্ফীতির দ্বৈত সমস্যায় ভুগছে যুক্তরাজ্য। মন্দার ঝুঁকি ও জীবনযাপনের উচ্চ ব্যয় সেখানকার ভোক্তাদের আস্থায় চিড় ধরাচ্ছে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯২৬ সালের পর প্রথমবারের মতো দেশটির শ্রমিক ইউনয়ন নেতারা দেশজুড়ে ধর্মঘটকে সমর্থন দিয়েছেন।
এশিয়ার খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে আরও খারাপ সময় আসা এখনও বাকি। নোমুরা হোল্ডিংস ইনকর্পোরেশনের সাম্প্রতিক এক পূর্বাভাস অনুসারে, আগামী মাসগুলোয় এশিয়ায় খাদ্যমূল্যে নতুন করে আগুন লাগতে চলেছে।
গত মে মাসে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭.৪২ শতাংশ, যা ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু খাদ্যমূল্য বাড়ছে আরও উচ্চ হারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি হিসাবের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হতে পারে কারণ বেশিরভাগ মানুষ যেসব পণ্য ভোগ করেন তার সবগুলো আনুষ্ঠানিক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
যুদ্ধ ও ভালোবাসায় সবই চলে
যুদ্ধের এই সময়েও চিরন্তন এ বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। রাশিয়ার সারের চালান ট্র্যাক করেছে ব্লুমবার্গ। তাদের প্রতিবেদন অনুসারে, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে পণ্যটিকে এবং তা যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলোয় প্রবেশেও করছে। মার্কিন সরকারও কোম্পানিগুলোকে আরও রাশিয়ান সার কেনা ও পরিবহনে উৎসাহ দিচ্ছে। এতে উত্তর আমেরিকার সারের দাম কমার প্রবণতার কথাও উল্লেখ করা হয় সেখানে। এরমধ্যেই ভেনিজুয়েলার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও শিথিল করেছে মার্কিন সরকার। ফলে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি ইতালিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ক্রুড) চালান পাঠাতে পারছে। অন্যদিকে, জার্মানিতে সরাসরি গ্যাসের যোগান দেওয়া নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে গ্যাস প্রবাহ ৬০ শতাংশ কমিয়েছে রাশিয়া।
নিজ স্বার্থেই রাশিয়ার গ্যাজপ্রমব্যাংককে কঠোর নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত রেখেছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন।
রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ কর্তন করায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সচল করার পরিকল্পনা করছে জার্মানি। ব্লুমবার্গ দেশটির একজন মন্ত্রীর বরাতে জানিয়েছে, ইউরোপীয় দেশটি কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুতে আরও বেশি ঝুঁকবে।
এদিকে মূল্যছাড়ে রাশিয়া থেকে তেল কিনে চলেছে ভারত। রাশিয়া থেকে দেশটির কয়লা কেনাতেও দেখা যাচ্ছে উল্লম্ফন। চীনও রাশিয়া থেকে কয়লা কিনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত মে'তে রাশিয়া থেকে চীনের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি বার্ষিক হিসাবে ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। ফলে এসময় সৌদি আরবকে টপকে চীনের শীর্ষ ক্রুড সরবরাহক হয়ে ওঠে রাশিয়া।
কিন্তু, বাংলাদেশের জন্য উপায় সীমিত। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আমাদের রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে জ্বালানি তেল বা সার কেনার উপায় নেই- যেভাবে গত রোববার উল্লেখ করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
তাই জ্বালানি সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশকে। কমাতে হবে সারের অপচয়, ফসল উৎপাদনে আনতে হবে বৈচিত্র্য এবং স্থানীয়ভাবে গ্যাসের মজুদ অনুসন্ধানে আরও চেষ্টা চালাতে হবে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে এসব পরামর্শই দিয়েছেন বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা।