ঈদযাত্রা: মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধ করা সম্ভব?
মোটরসাইকেল খুব রোমান্টিক বাহন। শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের দিনগুলোয় মোটরসাইকেলের প্রেমে পড়েননি এবং মোটরসাইকেল কেনার শখ ছিল না—এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
তবে এই লেখা যিনি পড়ছেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনার পরিচিত কেউ না কেউ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হয় নিহত হয়েছেন, কিংবা গুরুতর আহত। হয়তো আপনি নিজেও এক বা একাধিকবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েছেন; হয় নিজে চালাতে গিয়ে, কিংবা অন্যের পেছনে চলতে গিয়ে।
খুব ব্যতিক্রম না হলে আপনি কোনো না কোনো সময়ে, রাজধানী ঢাকা তো বটেই, অন্য কোনো শহরে এমনকি গ্রামগঞ্জের রাস্তায়ও মোটরসাইকেলের কারণে কোনো না কোনোভাবে বিব্রত হয়েছেন; বিরক্ত হয়েছেন। না হয়ে থাকলে আপনি ভাগ্যবান।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) খোঁজ নিলে জানা যাবে, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে যারা এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের বিরাট অংশই মোটরসাইকেল চালক বা আরোহী কিংবা পথচারী—যাকে কোনো মোটরসাইকেল ধাক্কা দিয়েছে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিংয়ের চেষ্টা, বারবার লেন পরিবর্তন, উল্টো দিকে বা রঙ সাইডে যাত্রা, ট্রাফিক আইন না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেলমেট ব্যবহার না করা বা করলেও সেগুলো নিম্নমানের হওয়া এবং রাতে মহাসড়কে দ্রুতগামী অন্য গাড়ির ধাক্কা।
পরিসংখ্যান বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চালক ও আরোহীদের অর্ধেকের বয়সই ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালনার কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছেন এবং অন্যদেরও বিপদে ফেলছেন (বাংলা ট্রিবিউন, ৬ মে ২০২২)।
রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, গত রোজার ঈদে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মোটরবাইকে চড়ে বিভিন্ন জেলায় গেছেন। আর এই সময়ে ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জনের প্রাণ গেছে (বিডিনিউজ, ১২ মে ২০২২)।
গত ২৯ এপ্রিল ডেইলি স্টারের একটি শিরোনাম ছিলো: '২৪ ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়েছে ৫ হাজার মোটরসাইকেল।' খবরে বলা হয়, ২৮ এপ্রিল সকাল থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে প্রায় ৩৩ হাজার ৫৩৯টি যানবাহন পারাপার হয়েছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ছিল প্রায় ৫ হাজার। ওই সময়ে টেলিভিশনে চ্যানেলগুলোতেও যমুনা নদীর উপরে নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যেতে হাজার হাজার মোটরসাইকেলের দীর্ঘ সারি বা সেতুর টোল দিতে গিয়ে বিশাল জটলার ছবি প্রচারিত হয়; যে দৃশ্য দেশের মানুষ আগে কখনো দেখেনি।
এরকম বাস্তবতায় এবার ঈদুল আজহার ছুটিতে মানুষ যাতে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে, সেজন্য সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে যেসব জাতীয় মহাসড়কের পাশে 'সার্ভিস রোড' আছে, সেখানে মোটরসাইকেল চলতে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বিআরটিএ। তাদের এই সুপারিশ শুধু ঈদের সময়ে নাকি সারা বছরের জন্য, সেটি পরিস্কার নয়।
রাষ্ট্রীয় এই সংস্থার যুক্তি হলো, রোজার ঈদের চেয়েও কোরবানির ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেলের ঝুঁকি বেশি। কারণ এই সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে পশুবাহী যানবাহন চলাচল করবে। এসব যানবাহনের ফিটনেসে ঘাটতি থাকে। অদক্ষ চালকরাও এ সময় মহাসড়কে নেমে পড়েন। সব মিলিয়ে মহাসড়কের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। ফলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ঈদুলে আজহার আগে এইসব পশুবাহী যানবাহনের কারণে মোটরসাইকেলের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে। তাছাড়া, একসঙ্গে হাজার হাজার মোটরসাইকেল মহাসড়কে উঠে গেলে সেটি শুধু মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীই নয়, অন্য যানবাহন ও পথচারীদের জন্যও ঝুঁকি তৈরি করবে।
তবে মহাসড়কে মোটরসাইকেলে নিষিদ্ধের এই সুপারিশ কতটা বাস্তবতসম্মত এবং সুপারিশটি শেষপর্যন্ত সরকারি সিদ্ধান্তে পরিণত হবে কি না এবং হলেও মহাসড়কে মোটরসাইকেল কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে- তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বরং প্রশ্নটি করা দরকার তা হলো, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিয়ে একা তো বটেই, পরিবার-পরিজন নিয়েও বাড়ি যাওয়ার প্রবণতা কেন বাড়ছে? মোটরসাইকেল কেন গণপরিবহনের বিকল্প হয়ে উঠছে? যদি ঈদযাত্রায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে যারা মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়া-আসার পরিকল্পনা করেছেন তাদের জন্য আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী গণপরিবহন নিশ্চিত করা যাবে কি না? তাদের ঈদযাত্রা স্বস্তির হবে কি না? তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে মোটরসাইকেলের পরিমাণ এত বাড়লো কেন? বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে মোটরসাইকেলের পরিমাণ এত বেশি কেন?
বিআরটিএর ওয়েবসাইটে (http://www.brta.gov.bd/) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত মে পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৫৫ হাজার। তার মানে গত সাড়ে ১০ বছরে দেশে মোটরসাইকেল বেড়েছে ৩০ লাখের বেশি। বাংলাদেশের মতো এত ছোট আয়তনের আর কোনো দেশে এত মোটরসাইকেল যে চলে না, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া সম্ভব। তবে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধনের প্রবণতা যেহেতু কম, ফলে নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত মিলিয়ে সারা দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা যে আরও অনেক বেশি, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া সম্ভব। সুতরাং ঈদের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার প্রবণতা কেন বাড়ছে—তার একটি কারণ হচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মোটরসাইকেলের এই 'বাম্পার ফলন'।
এই বাম্পার ফলনের পেছনে আছে মোটরসাইকেল উৎপাদন ও আমদানির ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা। এটি ঠিক যে, মোটরসাইকেল বেশি বিক্রি হলে ব্যবসায়ীদের লাভ। সেটা দেশের অর্থনীতির জন্যও ভালো। কিন্তু প্রতিটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে কী পরিমাণ জনসম্পদ ধ্বংস হয় এবং এর আর্থিক মূল্য কত—সেই প্রশ্নটিও তোলা দরকার। যেভাবে সস্তায় এমনকি কিস্তিতেও মোটরসাইকলে বিক্রির মধ্য দিয়ে এই বাহনটিকে স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে, সেটি সরকারের ভুল নীতি কি না—সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে আপনি হয়তো পাল্টা প্রশ্ন করবেন যে, অন্য যানবাহনে কি দুর্ঘটনা হয় না? হয়। কিন্তু গবেষণা বলছে, মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের চেয়ে ৩০গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ (ডয়েচেভেলে, ২৭ এপ্রিল ২০২২)।
বাস্তবতা হলো, নকশার কারণেই যেকোনো যানবাহনের চেয়ে মোটরসাইকেল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং যারা মোটরসাইকেল চালান, তাদের বিরাট অংশেরই প্রশিক্ষণ নেই। কোনো না কোনোভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স জোগাড় করে নেয়া যায়। লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ যে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান, সেটি গোপন কোনো বিষয় নয়। আর গবেষণাও বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই কিশোর-তরুণ—যারা তারুণ্যের উন্মাদনায় বেপরোয়াভাবে চালান। কিন্তু মোটরসাইকেল কেনা কঠিন হলে, এর দাম স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের মধ্যে না থাকলে এর বিক্রি কম হতো। বিক্রি কম হলে রাস্তায় এই বাহনটির সংখ্যাও কম হতো।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ রাইড শেয়ারিং। যেহেতু এখনও দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা অনেক এবং তাদের মধ্য বিরাট অংশই শিক্ষিত—ফলে তারা সস্তায় কিংবা সহজ কিস্তিতে মোটরসাইকেল কিনে যাত্রী আনা-নেয়ার কাজ করছেন। এর মধ্যে দিয়ে তাদের আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
২০১৮ সালের ৩মে দৈনিক যুগান্তরের একটি খবরে বলা হয়, গণপরিবহনে নৈরাজ্য বেড়ে যাওয়ায় জনপ্রিয় হচ্ছে বাইক শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম। আর সে কারণে নগরীতে বাড়ছে রাইড শেয়ারিংয়ের সংখ্যা। বর্তমানে শুধু ঢাকা মহানগরীতেই ৫৫ লাখ ট্রিপ হয়। অর্থাৎ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মানুষ ৫৫ লাখ বার যাতায়াত করে। এটি ২০১৮ সালের তথ্য। গত চার বছরে এই সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে।
রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেল জনপ্রিয় হওয়ার বড় কারণ- সকালে ও সন্ধ্যায় মানুষের অফিসে যাওয়া-আসার সময় গণপরিবহনের তীব্র সংকট ও যানজট। রাজধানীর মতিঝিলে যার অফিস এবং বাসা মিরপুরে, তিনি বাসে রওনা হলে সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ ও পল্টন মোড়ে তাকে কতক্ষণ বা কত ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে, সেটি আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না। যে কারণে টাকা বেশি লাগলেও অনেকেই অন্তত অফিসে যাওয়া-আসার সময় মোটরসাইকেলের উপর নির্ভর করেন। আবার যাদের সক্ষমতা আছে এবং বাসা ও অফিস কাছাকাছি নয়, তারা মোটরসাইকেল কিনে নেন।
অর্থাৎ একদিকে মোটরসাইকেলের সহজলভ্যতা, অন্যদিকে রাজধানীতে পর্যাপ্ত গণপরিবহন না থাকা ও ভয়াবহ যানজটের কারণে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে। তার মানে মানুষ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য সঠিক সময়ে গণপরিবহন পেলে এবং সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলে মোটরসাইকেল-নির্ভরতা অনেক কমে যেত। সুতরাং গণপরিবহন উন্নত, সহজ ও সাশ্রয়ী করা এবং রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ বা নিরুৎসাহিত করা কঠিন। তবে অপ্রাপ্তবয়স্করা যাতে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে, সেজন্য ট্রাফিক পুলিশের কঠোর হওয়া দরকার।
যে কারণে রাজধানীর ভেতরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, সেই একই কারণে ঈদের সময় মহাসড়কে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ মোটরসাইকেল নিয়ে গন্তব্যে যেতে চায়। যেহেতু এই সময় বাস ও ট্রেনের টিকিট পাওয়া কঠিন বা পেলেও বাড়তি টাকা গুনতে হয়; আবার আকাশপথে যাতায়াত ব্যয়বহুল এবং দক্ষিণবঙ্গ ছাড়া অন্য রুট নৌযান চলে না—সব মিলিয়ে ঈদের সময় মহাসড়কে মোটরসাইকেলের চাপ বাড়ে। কিন্তু চাপ যত বাড়ে, ঝুঁকিও তত বাড়ে। সুতরাং গণপরিবহন সংকটের সমাধান না করে মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করা কঠিন। সেইসাথে সরকারের পরিবহন নীতিমালাও সংশোধন করা দরকার। একজন মানুষ চাইলেই মোটরসাইকেল বা ব্যক্তিগত গাড়ি কিনে রাস্তায় নামিয়ে দিতে পারবেন—এটি কোনো নীতি হতে পারে না।
- লেখক: আমীন আল রশীদ, নেক্সাস টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর।