খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রভাব পোশাকের বাজারে, কমেছে বিক্রি
তিন সপ্তাহ আগে রাজধানীর মৌচাক মার্কেটে পোশাক কিনতে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাজমুন নাহার। ওই মার্কেটের এক দোকান কর্মী তাকে জানান, সারাদিনে একটি পোশাকও বিক্রি হয়নি। এই ক্রেতাকে তিনি অনুরোধ জানালেন, লাভ নয়, ক্রয়মূল্যেই বিক্রি করতে চান কিন্তু তিনি যাতে অন্তত একটি থ্রি-পিছ কেনেন।
কেবল ওই প্রতিষ্ঠান নয়, রাজধানীর অন্যান্য মার্কেটেও পোশাক বিক্রেতাদের অবস্থা এমনই। রমজানের ঈদের পর পোশাকের বিক্রি কমে যায়, কিন্তু তাই বলে এত বাজে অবস্থা?
তিন সপ্তাহ পরও কোরবানীর ঈদের আগে এই সময়ে দেশের ক্লদিং মার্কেটে পোশাকের যে চাহিদা থাকে, বর্তমানে তা নেই। পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় এর কাঁচামাল - ফেব্রিক ও ইয়ার্নের চাহিদা ও দাম দুটিই কমতির দিকে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক মাস ধরে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের উপর প্রচন্ড চাপ পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে তারা পোশাক কেনার ব্যয় কমিয়ে দিয়ে তা খাদ্যপণ্যের যোগান ঠিক রাখতে সেখানে খরচ করছেন।
দেশে গত কয়েক মাস ধরেই পণ্যমূল্য বাড়তির দিকে। সরকারি হিসাবেই গত মে মাসে ইনফ্লেশনের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তা, বিশেষত স্বল্প আয়ের মানুষ খাদ্যপণ্যের ব্যয় ঠিক রাখতে গিয়ে পোশাক বা অন্যান্য আইটেম ক্রয় কমিয়ে দেয়।
রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছর ধরে পোশাকের মূল কাঁচামাল কটনের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। যার কারণে স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে ইয়ার্ন ও ফেব্রিকের দাম। এতে এমনিতেই বিক্রি কম ছিলো। এর মধ্যে ইনফ্লেশনের চাপ বাড়তে থাকায় এখন বিক্রি কমে গেছে।
স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারকদের বৃহত্তম বাণিজ্য সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ পোশাক প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন মালিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে কোরবানির ঈদের আগে এই সময়ে যে বিক্রি থাকে, এবার তা নেই।
এর পেছনে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করে তিনি বলেন, "মানুষ এখন পোশাকের চেয়ে খাদ্যপণ্য কেনায় খরচ করছে। পোশাক তিনটির জায়গায় দুটি হলেও চলে, কিন্তু খাবার না খেলে তো চলে না।"
এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতিও পোশাক কেনায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন রাজধানীর ইসলামপুরের ফাহিম নামে একজন বস্ত্র ব্যবসায়ী।
পোশাকের ক্রয় কমে যাওয়ায় এর কাঁচামাল ফেব্রিক ও ইয়ার্নের চাহিদাও কমে গেছে যথারীতি। স্থানীয় বাজারে বিক্রি হওয়া ক্লদিংয়ের মূল কাঁচামাল কেনাবেচা হয় মূলত নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনাসহ আরো কিছু এলাকায়।
এর মধ্যে নরসিংদীর মাধবদী হলো গ্রে ফেব্রিক বিক্রির সবেচেয়ে বড় বাজার। মাধবদী বনিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "স্বাভাবিক সময়ে এই বাজারে প্রতি হাটের দিন বিক্রি হতো ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকার। এখন তা ১০০ কোটি টাকার নিচে নেমেছে।"
এই এলাকার উইভিং মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছর বা তারও বেশি সময় আগে কটনের দাম যখন প্রতি পাউন্ড গড়ে ০.৭ ডলার ছিল, ওই সময়ে প্রতি গজ গ্রে ফেব্রিকের দাম ছিলো ৩০ থেকে ৩২ টাকা।
ইয়ার্নের দাম বাড়তে থাকায় সর্বশেষ দুই মাস আগে প্রতি গজ গ্রে ফেব্রিক (৪০ কাউন্টের সুতায় তৈরি) প্রায় ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়। তবে বর্তমানে চাহিদা কমে যাওয়ায় তা গড়ে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই কাপড়ে মূলত থ্রি পিছ, ব্লাউজ, পেটিকোট, স্কুল ড্রেস ও বাচ্চাদের জামা তৈরি হয়।
এছাড়া অন্যান্য কাউন্টের সুতায় তৈরি গ্রে কাপড়ে দামও মানভেদে কমতির দিকে।
লোকাল উইভিং মিলগুলোর কাছে যারা ইয়ার্ন সাপ্লাই করছেন, তারাও এখন লোকসানের মুখে পড়েছেন বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেড দেশের স্থানীয় বাজারের পোশাক তৈরির জন্য উইভিং মিলগুলোর কাছে ইয়ার্ন বিক্রি করে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম টিবিএসকে বলেন, দুই সপ্তাহে প্রতি পাউন্ড ইয়ার্নের (৪০ কাউন্ট) দাম ২২ থেকে ২৪ টাকা কমে গেছে।
তিনি বলেন, "স্থানীয় বাজারে ডিমান্ড কমে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পোশাকের ডিমান্ড কমার পেছনে ইনফ্লেশনারি প্রেশার অন্যতম কারণ বলে জানান তিনি।"
অপর একজন স্পিনিং মিলের উদ্যোক্তা অবশ্য ইনফ্লেশনারি প্রেশারের পাশাপাশি ইয়ার্নের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়াকেও (কটনের দাম বাড়ায়) কারণ হিসেবে দেখছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই স্পিনিং মিল উদ্যোক্তা টিবিএসকে বলেন, "এর পাশাপাশি চোরাচালানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ইয়ার্ন ও ফেব্রিক দেশে প্রবেশ করা ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা সুতা ও কাপড় স্থানীয় বাজারে বিক্রির কারণেও স্থানীয় টেক্সটাইলের চাহিদা কমছে।"
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে জানান, "বর্তমান ইনেফ্লেশনারি পরিস্থিতিতে পোশাকের ক্রয় কমে যাওয়ারই কথা। যারা কম আয়ের মানুষ, তারা খাবার কিনবে, কাপড় কিনবে না কোরবানি দেবে? যেহেতু তার আয় বাড়েনি, বাজেট তো তাকে ম্যানেজ করতে হয়। তখন কাপড় কেনা বা কোরবানির মত খরচ কমিয়ে আনতে হয়। এখন তা-ই হচ্ছে।"
এর সঙ্গে সিলেটসহ দেশের কয়েকটি অঞ্চলে বন্যার প্রভাবেও মানুষের পোশাকের ক্রয় কমবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে এগুলো ইকোনমিক একটিভিটি কমিয়ে দেয়।
দেশে ক্লদিং মার্কেটের আকার কত, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন পরিংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর এক সার্ভে অনুযায়ী, বছরের এই বাজারের আকার ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।
প্রফিট মার্জিন কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টায় ব্র্যান্ডেড পোশাক
দেশের মধ্য ও উচ্চবিত্তের পোশাকের অন্যতম নাম 'ইয়েলো' প্রতি উৎসবের ন্যায় নতুন কালেকশন এবারো সাজিয়েছে সব শো-রুম। তবে প্রত্যাশার তুলনায় ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত ভোক্তা কম দেখছে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় কেন্দ্রগুলো।
ইয়েলোর হেড অব রিটেইল অপারেশনস হাদী চৌধুরী বলেন, "সুতার দাম বাড়লেও আমরা কাপড়ের দাম বাড়াইনি, প্রফিট মার্জিন কমিয়েছি। তবুও স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বিক্রি কম।"
ইয়েলোর চেয়েও বিক্রি কমেছে স্থানীয় বাজারের বড় ব্র্যান্ড দেশি দশ, ওয়েস্টিন, আর্টিসান, ক্যাটস আই, সারা, ম্যানস ক্লাব, রেমন্ড, আড়ংসহ প্রায় সব ব্র্যান্ডের।
রাজধানীর বসুন্ধরা, বেইলি রোডসহ বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে দেখা গেছে, শো-রুমে ঈদুল ফিতরের জন্য তোলা পুরানো পোশাকই বিক্রি করছেন অনেকে। কাপড়ের দাম না বাড়লেও ক্রেতা নেই অধিকাংশ শো-রুমে। ২০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ও দিচ্ছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান।
বিক্রেতারা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অন্তত ৩০-৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বিক্রি কমেছে। যতটুকু বিক্রি হচ্ছে তাতেও মুনাফা কমাতে হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে মুনাফা ছাড়াই পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।
এসোসিয়েশন অব ফ্যাশন ডিজাইনার্স অব বাংলাদেশের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, "ঈদুল ফিতরের পর কোরবানীর ১০ দিন পূর্ব পর্যন্ত সময়টাতে সাধারণত বিক্রি কম থাকে। এটি এবার আরো কমেছে।"
"নতুন পোশাক তৈরিতে খরচ বেড়েছে। কিন্তু মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় আমরা দাম বাড়াতে পারছি না। ফলে কাপড়ে ডিজাইন ও হাতের কাজের
পরিমাণ কমিয়ে ব্যয় সমন্বয় করার চেষ্টা করছে কিছু তাঁতি। মুনাফা কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ," বলেন তিনি।