কীভাবে দ্রুত প্রসারমান একটি জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পতন ঘটল
১৯৯৯ সালের ব্যবসায় আসেন বরিশালের জহির উদ্দিন তারিক। পাপেলা লিমিটেড নাম দিয়ে জুতার ব্যবসা শুরু চট্টগ্রাম ইপিজেডে। ব্যবসায় নেমে দ্রুত প্রসার পায় তার প্রতিষ্ঠান। এরপর গড়ে তোলেন ইউএফএম (বিডি) লিমিটেড নামে আরও একটি জুতার কারখানা।
প্রতিষ্ঠান দুটি বিদেশি একাধিক বিখ্যাত ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্য জুতো উৎপাদন ও রপ্তানি করেছিল দীর্ঘদিন।
এরপর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে জীলস ওয়্যার লিমিটেড, প্রাইম ফুট ওয়্যার লিমিটেড ও চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকা পাদুকা সুজ লিমিটেড নামে আরও তিনটি কারখানা গড়ে তোলেন। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির আগেই হঠাৎ সিইপিজেডের কারখানা দুটিসহ পাঁচটি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এতে পাঁচ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৫৪ কোটি পাওনা আদায় ঝুঁকিতে পড়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংক ও বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, ব্যবসার জন্য ঋণ নিলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান এবং সিইও জহির উদ্দিন তারিক ব্যাংকের টাকায় প্রচুর জমি কিনেছেন। টাকা পাচার করে কানাডায় বাড়ি করেছেন। মূলত ফান্ড সরিয়ে নেওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর দুরাবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
তারা বলেন, জহির উদ্দিন তারিক এক সময় লন্ডনে থাকতেন। লন্ডন থেকে এসে প্রথমে সিইপিজেডে তার মামার কারখানায় চাকরি নেন। এরপর নিজে ব্যবসা শুরু করে একের পর এক কারখানা গড়ে তোলেন। জার্মানির বিখ্যাত ব্র্যান্ড ডাইসম্যান, ফ্রান্সের ক্যারিফোর, ড্যাকা ফোলন, ওল ওট-সহ বিশ্বের নামী দামি প্রতিষ্ঠান পাপেলা, ইউএফএমবিডি, জীলস ওয়্যার ও প্রাইম ফুট ওয়্যারের ক্রেতা ছিল।
প্রথম কয়েক বছর বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ভালো ব্যবসা করে জহির উদ্দিন তারিকের প্রতিষ্ঠানগুলো। পরবর্তীকালে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সময়মতো পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জীলস, পাপেলা ও ইউএফএমবিডি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে বিদেশি ক্রয়াদেশের বিপরীতে সময়মতো এক্সেসরিজ সংগ্রহে বিলম্ব হওয়ায় শিপমেন্ট পিছিয়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশও বাতিল হয়।
এক সময় বাটা সু'র মতো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জুতা সরবরাহকারী ছিল জীলস। তবে ২০১০ সালের দিকে বাটার সঙ্গে জীলসের সম্পর্ক নষ্ট হয়। চুক্তি অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ না করা, অর্থাৎ গুনগত মান ঠিক না রাখার কারণে বাটা চুক্তি বাতিল করে।
এরপর ২০১২ সালে জীলস শপ নামে একটি নিজস্ব দেশীয় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গ্রুপটি। দেশের নাম করা ব্র্যান্ডশপগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীলস ব্র্যান্ড স্থাপন করা হলেও ব্যবসায় তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে ব্র্যান্ডটি। এরমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্র্যান্ড শপটির প্রায় ৩০টি বিক্রয় শপ স্থাপনের পরও সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি জীলস। ফলে রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানটি জীলসের মাধ্যমে শুরু থেকেই লোকসানে পড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউএফএমবিডির সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, 'শুরুতে প্রায় এক দশক দেশে রপ্তানিমুখী জুতো কারখানা হিসাবে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করেছে জীলস। কিন্তু ২০১০ থেকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায় সমস্যা তৈরি হয়। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চুক্তি অনুযায়ী যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ না করা এবং গুণগত মান বজায় না রাখায় একের পর এক বিদেশি ক্রেতা হাতছাড়া হয়ে যায়। এই সময় জহির উদ্দিন তারিকের বিরুদ্ধে জুতা রপ্তানির চেয়ে নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি এবং ব্যাংকের টাকা দিয়ে প্রচুর জমি কেনার অভিযোগ উঠে।'
এদিকে অনিয়মিত বেতন ভাতার কারণে ২০১৯ সালের বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (সিইপিজেড) ও কুমিল্লায় শ্রমিকরা বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের শেষ দিকে শ্রমিকদের কিছু বেতন-ভাতা দিয়ে চট্টগ্রামের তিনটি ও কুমিল্লার দুটি কারখানা বন্ধ করে দেয়।
গত বুধবার সরেজমিনে সিইপিজেড এলাকায় দেখা যায়, সিইপিজেড এলাকার ৪ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর সেক্টরে পাপেলা লিমিটেড ও ৪/এ সেক্টরের ইউএফবিডি লিমিটেড কারখানা দুটি বন্ধ রয়েছে। কারখানা দুটির সিকিউরিটি গার্ডরা জানান, প্রতিষ্ঠান দুটি দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।
জহির উদ্দিন তারিকের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থায়ন করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের নামে জহির উদ্দিন তারিক প্রায় ২৫৪ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে ইউএফএমবিডির কাছে ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের ৬৫ কোটি টাকা ঋণ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে।
উক্ত ব্যাংক ছাড়াও জহির উদ্দিন তারিকের প্রতিষ্ঠান জীলস ওয়্যারের কাছে বেসিক ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার ১০০ কোটি টাকা, পাপেলা লিমিটেডের নামে উত্তরা ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার ৫৫ কোটি টাকা, লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স আগ্রাবাদ শাখার ২৯ কোটি টাকা ও জীলস শপের কাছে এনআরবি ব্যাংকের প্রিন্সিপ্যাল ব্রাঞ্চের ৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া পাপেলা ও ইউএফএমবিডির কাছে সিইপিজেড, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ওয়াসা মিলে প্রায় ৫ কোটি টাকা সরকারি পাওনা বকেয়া রয়েছে।
লংকাবাংলা ফিন্যান্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব ব্রাঞ্চ (আগ্রাবাদ শাখা) মো. সোলায়মান হোসাইন জানান, ২০১৫ সালে জহির উদ্দিন তারিকের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লংকাবাংলা ব্যবসা শুরু করে। ইউএফএমবিডি, প্রাইম ফুট ওয়্যার, জীলস শপ ও জীলস ওয়্যারের নামে লংকাবাংলা থেকে ঋণ সুবিধা নেন তিনি। বর্তমানে এই চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে লংকাবাংলা ফিন্যান্সের মোট লিমিট প্রায় ৭০ কোটি টাকা। এরমধ্যে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ২৯ কোটি টাকা। ২০২০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করেনি বলে জানান এই কর্মকর্তা। এই ঋণের বিপরীতে কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামে ৪০ শতক জমি বন্ধক রয়েছে।
ডাচ বাংলা ব্যাংক চট্টগ্রাম করপোরেট ডিভিশনের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ইউএফএমবিডি ডাচ বাংলা ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। প্রথমদিকে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন ভালো ছিল। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে। বর্তমানে ইউএফবিডির কাছে ডাচ বাংলা ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার প্রায় ৬৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এই পাওনা এখন ওভার ডিও'তে পরিণত হয়েছে। ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যাংক খুব শিগগিরই আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
সিইপিজেডের জেনারেল ম্যানেজার মসিহউদ্দিন মেজবাহ বলেন, 'বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠান পাপেলা লিমিটেড ও ইউএফবিডি লিমিটেডে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজে নিয়োজিত ছিল। প্রতিষ্ঠান দুটির কাছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসা ও সিইপিজেড মিলে প্রায় ৫ কোটি টাকার বেশি সরকারি পাওনা বকেয়া আছে। সাধারণত বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠান নিলামে তুলে এসব পাওনা পরিশোধ করা হয়।'
এদিকে জহির উদ্দিন তারিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড সুবিধায় পণ্য (কাঁচামাল) আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে তার দুটি প্রতিষ্ঠান জীলস ওয়্যার এবং পাদুকা সুজের নামে একাধিক মামলা রয়েছে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনাররেটের কার্যালয়ে।
বন্ড কমিশনারেটের তথ্যমতে, সাড়ে ১৭ কোটি টাকার পরিমাণ বন্ড সুবিধায় আনা পণ্য কারখানা থেকে গোপনে সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে জীলস ওয়্যারের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালের শেষের দিকে কমিশনারেটের তদন্তে পণ্য অপসারণের দায়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির মামলা করে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট।
এর আগে, ২০১৭ সালে জীলস ফুটওয়্যারের বিরুদ্ধে বন্ডের পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ করবে না বলে মুচলেকা দেয় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। কিন্তু ২০১৮ সালে জীলসের কর্ণধার একই ধরনের ঘটনা ঘটান।
পাপেলা লিমিটেড ও ইউএফএমবিডিসহ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও সিইও জহির উদ্দিন তারিক বলেন, 'করোনা মহামারির আগের কয়েক বছর রপ্তানি খাতে ভালো ব্যবসা হয়নি। এরমধ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। এতে যে পরিমান খরচ বেড়েছে, সেই পরিমান মুনাফা আসছে না পণ্য রপ্তানি করে। এরপর করোনা মহামারি শুরু হলে পুঁজি সংকটে প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করা যায়নি। এতে ব্যাংকের টাকাও আটকে রয়েছে।'
তবে বিদেশে টাকা পাচার এবং কানাডায় বাড়ি করার কথা অস্বীকার করেন তিনি।