ব্যয়ের চাপে নেই সরকার, বাজেট ঘাটতি কমতে পারে
সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধই করছে বেশি। এতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) গেল অর্থবছরের তুলনায় সরকারের নিট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে খুব সামান্য।
বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত 'মান্থলি রিপোর্ট অন গভার্নমেন্ট ডোমেস্টিক বোরোয়িং' প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
ব্যাংক থেকে সরকারের কম ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বলে দিচ্ছে, অর্থবছর শেষে বাজেট ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হতে পারে।
চলতি অর্থবছরের জন্য ৫.৬৮ লাখ কোটি টাকার যে বাজেট ধরা হয়েছে, তার মধ্যে ঘাটতির পরিমাণ ১.৮৫ লাখ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.৮ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোভিডের অভিঘাত থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে যেখানে বাজেট সম্প্রসারণ প্রয়োজন, সেখানে উল্টোটা হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'করোনার অভিঘাত মোকাবেলায় বাজেট সম্প্রসারণের দিকেই হাঁটতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের টাকার অভাব হবে না। কারণ বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম থাকায় ব্যাংকে পড়ে থাকা অলস টাকা সহজেই কাজে লাগাতে পারবে সরকার।'
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি গত জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত বাড়লেও অক্টোবর থেকে নিম্নমুখী ছিল। ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৮.৩৭ শতাংশে। ডিসেম্বরে এই লক্ষ্যমাত্রা ১১.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল।
সরকারি ব্যয় বাড়ালে মুদ্রা সরবরাহজনিত মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, 'ব্যক্তিখাতে চাহিদা দুর্বল থাকায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে না।'
চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর- এই ছয় মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ।
জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি সরবরাহজনিত। উদহারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'যদি কোনো কারণে সময়মতো চাল আমদানি না হয়, তাহলে সেটা মূল্যের ওপর প্রভাব ফেলবে।'
সরকারের খরচ কমার পেছনে অন্যতম বড় কারণ হিসেবে তিনি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন কম হওয়াকে উল্লেখ করেন।
গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়কালে যেখানে ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেশি এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এই বাস্তবায়নের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা।
করোনার অভিঘাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি হচ্ছে- সরকারের এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে জাহিদ হোসেন বলেন, 'বড় যেসব প্রকল্পে বিদেশিরা যুক্ত, সেগুলো বাস্তবায়ন কিছুটা শ্লথ হয়েছিল।'
তার মতে, 'সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন হারই কম।' এক্ষেত্রে কোভিডের চেয়ে বাস্তবায়ন সক্ষমতা কম থাকাই মূল কারণ বলে তার অভিমত।
করোনার ফলে নতুন ভবন নির্মাণ স্থগিত রাখা, কর্মকর্তাদের বাড়তি খরচ হ্রাস করা, বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখা, আপ্যায়ন ব্যয় কমানোসহ অনেক ক্ষেত্রে সরকারের খরচ কমে গেছে।
এছাড়া স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হওয়া এবং সামাজিক সুরক্ষাখাতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উপকারভোগীদের সহায়তা করতে না পারায় সরকারের ব্যয়ের চাপ কম বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, 'সরকারের অপচয়মূলক খরচ কমে গেলে অর্থনীতির জন্য ভালো। তবে উন্নয়ন ব্যয় কমে যাওয়া মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।'
সরকারের ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণের চাপও থাকবে না। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪ শতাংশের মতো, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮.৪২ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, 'যেহেতু সরকারের ব্যয় এখন কম, তাই রাজস্ব ঘাটতির ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার যে শঙ্কা ছিল, সেটা আর হবে না।'
ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে সরকারের সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে সঞ্চয়পত্র থেকে। চলতি অর্থবছরের ২০ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্য থাকলেও জুলাই-ডিসেম্বর- এই ছয় মাসেই সেটা পূরণ হয়ে গেছে।
ব্যাংক আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় সরকার না চাইলেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। এতে সরকারের সুদজনিত ব্যয় বাড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।