মহামারির মধ্যে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে কাগজ শিল্প
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প সংস্থা বসুন্ধরা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেড (বিপিএমএল)। বাজারে রয়েছে বিপিএমএলের বিভিন্ন ধরনের কাগজ, কাগজজাত পণ্য, টিস্যু এবং পরিচ্ছন্নতা পণ্যসহ বৈচিত্রপূর্ণ সব পণ্যের সমাহার।
কিন্তু, মহামারির কারণে কাগজ ও টিস্যু শিল্প বাজারের শীর্ষ অবস্থানে থাকা এই প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখে পড়ে। প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকায় বিপিএমএলের কাগজের বিক্রি ও চাহিদা কমে যায়।
বাজারে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি কাগজ উৎপাদন কমিয়ে দেয়। মহামারিতে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়তি সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি টিস্যু এবং পরিচ্ছন্নতা পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে বলে জানান বসুন্ধরা গ্রুপের ডিএমডি মোস্তাফিজুর রহমান। এছাড়া বিশেষায়িত কাগজজাত পণ্যের উৎপাদনও বাড়ানো হয়।
বিপিএমএলের তিনটি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে একটি ইউনিটে কাগজ ও কাগজজাত পণ্য উৎপাদন, দ্বিতীয় ইউনিটে নিউজপ্রিন্ট ও ডুপ্লেক্স বোর্ড উৎপাদন এবং অপর একটি ইউনিটে টিস্যু পণ্য উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
পাঁচটি উৎপাদন লাইনের মাধ্যমে টিস্যু উৎপাদনকারী ইউনিটে ডজনখানেক টিস্যু পণ্য তৈরি করা হচ্ছে।
গত বছর মহামারির প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লে টিস্যু পণ্যের চাহিদা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বাড়তে থাকা চাহিদার সাথে তাল মেলাতে প্রতিষ্ঠানটি কাগজ উৎপাদন সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে টিস্যু উৎপাদন শুরু করে।
কাগজ শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ কাগজ শিল্প সংকটে পড়েছে, যাতে এই শিল্পখাতের পণ্য বিক্রি কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) হিসাব মতে, করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর থেকে এ পর্যন্ত কাগজ শিল্পে ক্ষতি প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। এই খাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।
উৎপাদন বন্ধ, অবিক্রিত পণ্যে মজুদ বৃদ্ধি, পরিচালন ব্যয় ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন উদ্যোক্তারা।
দেশের কাগজ মিলগুলো অফসেট, নিউজপ্রিন্ট, লেখা ও ছাপার কাগজ, প্যাকেজিং পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়া পেপার, লাইনার, স্টিকার পেপার, সিকিউরিটি পেপার ও বিভিন্ন গ্রেডের টিস্যু পেপার উৎপাদন করে।
তবে উৎপাদিত পণ্যের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই লেখা এবং ছাপার কাগজ, যা শিক্ষার অন্যতম উপকরণ। মহামারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই পণ্য বিক্রিতে ধস নেমেছে।
চলমান শাটডাউনের আগে সরকারি-বেসরকারি অফিস চলমান থাকায় বিক্রি কিছুটা বাড়লেও এখন তা প্রায় শূণ্যের কাছাকাছি বলছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "হোয়াইট এবং প্রিন্টিং পেপারের চাহিদা কম থাকায় দেশের অধিকাংশ কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এখন একই রকম সংকটের মুখোমুখি। যেসকল মিলে শুধুমাত্র হোয়াইট, প্রিন্ট এবং নিউজপ্রিন্ট কাগজ উৎপাদন হতো, মহামারির কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে"।
"তন্মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান যাদের বিভিন্ন ধরনের কাগজের পণ্য রয়েছে, তারা সক্ষমতা সেসব পণ্যে স্থানান্তর করেছে। পেপার মিলগুলো উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ১০-২০ শতাংশ দিয়ে চলছে, সক্ষমতার বাকি অংশটুকু অব্যবহৃতই থাকছে", যোগ করেন তিনি।
এদিকে পেপার খাতের মতোই শিক্ষার সাথে জড়িত অন্যান্য খাতও সংকটে রয়েছে। কোনো খাত লোকসানে, কোনো খাতের উদ্যোক্তারা কমিয়েছে উৎপাদন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুললে, শিক্ষার সাথে জড়িত বিভিন্ন খাত ও উপখাতের পুনরুদ্ধারের কোনো আশা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষার উপকরণ যেমন- স্টেশনারী পণ্য, বলপেন, খাতা, পেন্সিল, জ্যামিতি বক্স, ক্যালকুলেটর, স্ট্যাপলার, হোল-পাঞ্চ, কলম, পেন্সিল, হাইলাইটার এবং ডায়েরি বিক্রি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সংকটে পড়েছে বলপেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও। কারণ বলপেনের কালি সাধারণত ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত গুণগত মান ধরে রাখতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে বিক্রি হওয়া বলপেন ফেরত দিচ্ছেন ডিলাররা।
জানা যায়, সারাদেশে ১০৬টি কাগজ মিল আছে, যার মধ্যে ৭৯টি বন্ধ। তবে সবগুলোই মহামারির কারণে বন্ধ হয়নি। ছোট কিছু মিল বড় গ্রুপের আধিপত্য ও বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে করোনার আগে বন্ধ হয়েছে।
মহামারির পর কোনো কাগজমিল সক্ষমতার আংশিক চালু রেখেছে। তবে পেপার ও পেপারজাত পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় ছোট মিলগুলো উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। গত এক বছরে কতগুলো মিল বন্ধ হয়েছে, সে হিসাব দিতে পারেনি পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন।
এদিকে অবিক্রিত পণ্যের মজুদ বৃদ্ধি ও উৎপাদন বন্ধের কারণে কাগজ মিলগুলোর আয় কমায় বিপাকে পড়েছেন পেপার শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা।
এই অবস্থায় ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারা ও পেপার শিল্পখাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপি বাড়ার শঙ্কা জানিয়ে গত ২১ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ)।
পদ্মা পেপার মিলস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পেপারে কার্টুন তৈরিতে ব্যবহৃত মিডিয়াম পেপার উৎপাদন করে। এই পেপার মিলসের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "মহামারির আগে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি হতো, এখন তা অনেক কমেছে। দফায় দফায় লকডাউনের কারণে রপ্তানিমুখী শিল্পসহ অন্যান্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমরাও ক্ষতির মুখে। উৎপাদন ব্যহত হয়েছে, পণ্যও বিক্রি করা সম্ভব হয়নি।"
চাহিদার চেয়ে দেড় থেকে দুইগুণ বেশি উৎপাদন সক্ষমতা
বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়ে প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে কাগজ মিলগুলোর। দেশে বিভিন্ন ধরনের কাগজের চাহিদা প্রায় নয় লাখ টন।
তবে দেশীয় কাগজ মিলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। কাগজ মিলগুলোর মধ্যে ২০ থেকে ৩০টি মিল বড়। বাকিগুলো ছোট কারখানা।
দেশের পেপার মার্কেটের আকার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা্র। যার মধ্যে মোট বাজারের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লেখা ও ছাপার কাগজ পণ্য। আর অবশিষ্ট ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ অন্যান্য পণ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক দশক আগেও বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি হতো। আশির দশকে দেশীয় কাগজ শিল্পের বিকাশ শুরু হলেও নব্বইয়ের দশকে বড় বড় শিল্পগ্রুপ এই খাতে বিনিয়োগে আসায় কাগজ শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়।
অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে পেপার ও পেপারজাত পণ্য। কাগজ শিল্পখাতে প্রত্যক্ষভাবে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে।
বিপিএমএ'র মতে, দেশের পেপার শিল্পখাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যার সাথে ৩০০ উপ-শিল্প তথা সহায়ক শিল্প যেমন মুদ্রণ, প্রকাশনা, কালি প্রস্তুত, ডেকোরেশন, প্যাকেজিং ও বাঁধাই শিল্প জড়িত।
পেপার শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপির শঙ্কা
বিপিএমএ'র মতে, পেপার শিল্প খাতে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা।
ঋণ শ্রেণীকরণে ডেফারেল সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেওয়া সংগঠনটির চিঠিতে বলা হয়, জুলাই মাস থেকে ঋণ শ্রেণীকরণ করা হলে দেশের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ঋণ গ্রহীতা ঋণ খেলাপি হিসাবে গণ্য হবেন, ফলে সামগ্রিক ব্যবসা ও ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে।
তবে ঋণ শ্রেণীকরণ সময়সীমা জুলাইয়ের পরিবর্তে আগস্ট পর্যন্ত বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই সংকটকালে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি না করে চলমান ও বকেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধে কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়।
ঋণের খেলাপী কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ৫ বছর নির্ধারণ পূর্বক বেলুনিং পদ্ধতিতে প্রতি প্রান্তিকে ৫ শতাংশ ক্রমবৃদ্ধি হারে ২০ প্রান্তিকে পরিশোধের সুযোগ অথবা সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ১০ বছর নির্ধারণ পূর্বক বেলুনিং পদ্ধতিতে প্রতি প্রান্তিকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ক্রমবৃদ্ধি হারে ৪০ প্রান্তিকে পরিশোধের সুযোগ চাওয়া হয় ওই চিঠিতে।
এছাড়াও উল্লিখিত পদ্ধতিতে অক্টোবর ২০২১ থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সুযোগ প্রদান, অক্টোবর পর্যন্ত ঋণ শ্রেণীকরণ না করা ও ঋণগ্রহীতা পরপর চারটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণ শ্রেণীকরণ করার দাবি জানানো হয় ওই চিঠিতে।