বর্জ্য কাগজ প্রক্রিয়াকরণে ১০০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ
ডলার সংকটে কাগজ তৈরির কাঁচামাল ও পাল্প আমদানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এখন বর্জ্য কাগজ রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার দিকে ঝুঁকছেন দেশের কাগজ শিল্প মালিকরা।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের শুরুতে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়লে দেশের কাগজ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটে। ওইসময় বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দামও বেড়ে যায়। ফলে দেশের কাগজ শিল্পে দেখা দেয় সংকট। বেশি দামে কাঁচামাল আমদানির কারণে দেশে কাগজ পণ্যের দামও বাড়তে থাকে।
এমন পরিস্থিতে এই শিল্পে নতুন বিনিয়োগ বড় ধরনের সুফল বয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি বর্জ্য কাগজ প্রক্রিয়াকরণে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে হোয়াইট প্রিন্ট পেপার তৈরি ও রপ্তানিকারক শিল্প প্রতিষ্ঠান লিপি পেপার মিলস লিমিটেড।
লিপি পেপার মিলসের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার হাসান খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "আমরা কাঁচামাল (পাল্প) আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে বর্জ্য কাগজ প্রক্রিয়াকরণে বিনিয়োগ করেছি। আমরা এখন সোনারগাঁয়ে আমাদের কারখানায় ফেলে দেওয়া কাগজ প্রক্রিয়াজাত করে নতুন ব্যবহারযোগ্য কাগজ তৈরির জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করছি।"
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে মাত্র কয়েকটি স্থানীয় পেপার মিলে বর্জ্য কাগজ পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো রয়েছে। বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেড, বেস পেপারস লিমিটেড ও মেঘনা পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি মিল পেপার মিল এই রিসাইক্লিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
কিন্তু এই মিলগুলোর যে পরিমাণ ফেলনা কাগজ রিসাইকেল করার সক্ষমতা রয়েছে, তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে মিলগুলোতে রিসাইকেল করার জন্য বর্জ্য কাগজের চাহিদা বাড়ছে। আর এদিকে বাড়ছে কাগজের দাম।
দেশের কাগজ শিল্প প্রথম আঘাতের মুখোমুখি হয় করোনা লকডাউনের সময়। এ সময় দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অফিস। মহামারি কমতে শুরু করলে অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় খুলে দেওয়ার সাথে সাথে দ্রুতই পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে দেশের কাগজ ব্যবসা। কিন্তু পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই শিল্পের ওপর হানে দ্বিতীয় আঘাত। যুদ্ধের প্রভাবে প্রধান সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন ঘটায় বেড়ে যায় কাঁচামালের দাম।
বাংলাদেশ কাগজ আমদানিকারক সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম ভরসা টিবিএসকে বলেন, "এখন কাঁচামালের জন্য এলসি খোলা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঁচামাল আমদানির জন্য যে পরিমাণ এলসি খোলা প্রয়োজন, আমরা তার ২০% খুলতে পারছি। এ কারণে স্থানীয় মিলগুলো চাহিদা অনুযায়ী কাগজ পণ্য উৎপাদন করতে পারছে না।"
কাগজের দাম বৃদ্ধি এবং পাল্প (কাগজ তৈরির কাঁচামাল) সংকটের কারণে বিনামূল্যে বই বিতরণের ক্ষেত্রেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সমস্যায় পড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ফলে পাল্পের ঘাটতি মেটাতে এনসিটিবি তার নিজস্ব পুরনো বই পেপার মিলগুলোতে সরবরাহ করেছে। এসব পুরনো কাগজ রিসাইকেল করে তৈরি হয়েছে নতুন কাগজ; আর তা দিয়েই ছাপা হয়েছে এনসিটিবির নতুন পাঠ্যবই।
কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংবাদপত্র শিল্পও লোকসান গুনছে।
টেক্সটবুক প্রিন্টিং অ্যান্ড মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় আট লাখ টন কাগজের প্রয়োজন হয়। এই চাহিদার সিংহভাগই পূরণ হয় স্থানীয় মিলগুলোর দ্বারা এবং বাকি অংশ আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। তবে কাগজ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সিংহভাগই আমদানিনির্ভর।
যে কারণে পেপার রিসাইক্লিংয়ে বিনিয়োগ করছে লিপি পেপার
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে বর্জ্য কাগজ প্রক্রিয়াকরণের একটি কারখানা স্থাপন করছে লিপি পেপার লিমিটেড।
পাল্পপেপার নিউজ জানায়, অ্যান্ড্রিজ গ্রুপের কাছ থেকে বর্জ্য কাগজ প্রক্রিয়াকরণের মেশিন কিনেছে লিপি পেপার। অ্যান্ড্রিজ আরসিএফ (রিসাইকেলড ফাইবার) লাইন হল বাংলাদেশের প্রথম পেপার প্রোসেসিং লাইন; চলতি ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এই কোম্পানির কাজ শুরু করার কথা রয়েছে।
সূত্র জানায়, দুটি আরসিএফ লাইনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করবে অ্যান্ড্রিজ, যার সক্ষমতা দিনে ১৫০ টন।
লিপি পেপার মিলসের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার হাসান খান টিবিএসকে বলেন, "আমরা বর্জ্য কাগজ প্রক্রিয়াকরণে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছি; মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এবং বাতিল কাগজ থেকে নতুন পণ্য তৈরি করতেই এই উদ্যোগ।"
"কাঁচামালের ঘাটতি এবং কাগজের দাম বৃদ্ধির কারণে এনসিটিবি সময়মতো বই ছাপতে পারেনি। ফলে অনেক চেষ্টা করে পুরনো কাগজ প্রক্রিয়াজাত করে বই ছাপানো হয়েছে। এসব বইয়ের মানও তেমন ভালো নয়," যোগ করেন তিনি।
শাহরিয়ার হাসান আরও বলেন, "এখন ১০০ টন কাগজ বিক্রি হলে ৪০ টন ফেলনা কাগজ পাওয়া যায়। ব্যবহারের পর বাকিটা চলে যায় ল্যান্ডফিলে (ভাগাড়)। এইসব কাগজ ল্যান্ডফিলে যাওয়া বন্ধ করে, পেপার মিলে আনা গেলে কাঁচামাল আমদানির ডলার খরচ অনেক কমবে।"
বাংলাদেশ ওয়েস্ট পেপার সাপ্লায়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, "গত দুই বছর ধরে পেপার মিলগুলোতে ফেলনা কাগজের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সংগ্রহ করা বর্জ্য কাগজের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অনেক কম। কারণ সঠিক চ্যানেলে এই কাগজ আসছে না এবং এর একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে ল্যান্ডফিলে।
দেশের অন্যতম কাগজ ও টিস্যু উৎপাদক বসুন্ধরা পেপার মিলসের মহাব্যবস্থাপক এম মাজেদুল ইসলাম বলেন, "আমাদের মিল দীর্ঘদিন ধরে বর্জ্য কাগজ প্রক্রিয়াজাত করে কাঁচামাল উৎপাদন করছে, যা স্থানীয় মিলের কাঁচামালের চাহিদার একটি অংশ পূরণে সক্ষম।"
"এখন ডলারের সংকট কাগজ শিল্পে কাঁচামালের ঘাটতিকে আরও খারাপ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বসুন্ধরা পেপারে এখনও তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। তবে ডলারের ঘাটতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমরাও সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি। সেক্ষেত্রে বর্জ্য কাগজ প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা ভাল কাজে আসতে পারে," যোগ করেন তিনি।