রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের রাইট-অফ ঋণের লক্ষ্যমাত্রার ৮.৮৯ শতাংশ আদায়
অনিয়ম, দুর্নীতি প্রভৃতির মাধ্যমে ঋণ দেয়ায় দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নাজুক অবস্থা। নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও বছরের পর বছর আদায় হচ্ছে না ঋণ। দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ফলে খেলাপি ঋণের বোঝা কাগজে–কলমে কমাতে ঋণ অবলোপন বা 'রাইট-অফ' পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর রাইট-অফ এর মাধ্যমে ঋণ আদায় খুবই নাজুক অবস্থা।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংক চলতি বছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবলোপন বা 'রাইট-অফ' ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে ১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক আদায় করেছে মাত্র ১৫১ কোটি টাকা। যা শতাংশ হিসেবে ৮.৮৯।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, অর্থঋণ আদালতে ঋণের অধিক পরিমাণ মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে। এছাড়া চাহিদার তুলনায় দেশে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম। একই সঙ্গে আদালতগুলোর বিচারক সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। নানা কারণে অর্থঋণ আদালতের মামলাজট তৈরি হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়রানিও বাড়ছে। মামলা ঝুলে থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়া অবলোপন করা ঋণ আদায়ে সংশ্লিষ্ট শাখা কর্মকর্তাদের দায়িত্ব কমে যায়। যার কারণে শাখা কমর্কতার্রা যেসব খেলাপি ঋণের অর্থ আদায় করতে তেমনটা তৎপর থাকেন না। এরই কারণে ঋণ অবলোপন থেকে আদায়ের পরিমাণ কম।
বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা টাকার পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি বছরের জন্য রাইট-অফ ঋণের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় ৬৯৬ কোটি টাকা, তার মধ্যে চলতি বছরের নয় মাসে আদায় করেছে মাত্র ৮১ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের অর্থঋণ আদালতে আটকে আছে ৩৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি বছর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫২ কোটি টাকা অথচ ব্যাংকটি চলতি নয় মাসে আদায় করেছে মাত্র ৩৭ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকের অর্থঋণ আদালতে আটকে আছে ৫ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটি চলতি বছরের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে ৫৫৪ কোটি টাকা। কিন্তু আদায় করেছে নয় মাসে মাত্র ২৮ কোটি টাকা।
একইসঙ্গে রূপালী ব্যাংকের অর্থঋণ আদালতে আটকে আছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করে দিয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটি আদায় করেছে মাত্র ৪ কোটি টাকা। এছাড়া বেসিক ব্যাংক চলতি বছরের ৩৫ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১ কোটি টাকা আদায় করেছে।
কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, হাইকোর্টের আদেশের মাধ্যমে অর্থঋণ আদালতের মামলা বছরের পর বছর আটকে আছে। এছাড়া চলমান মামলার বিচারকাজ অযৌক্তিকভাবে মুলতবী রাখা হয়। বিচারকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের আদেশে যে মামলাগুলো স্থগিত রয়েছে, সেগুলো বাতিলের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। স্থগিত মামলাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির কাছে দিতে হবে। আইন মন্ত্রণালয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করে এসব স্থগিতোদেশের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। এছাড়াও অর্থঋণের আদালত ও বিচারক বৃদ্ধি এবং দক্ষ বিচারক দিয়ে এসব মামলার বিচার পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে মোট ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হলো ১ লাখ ১,১৫০ কোটি টাকা। যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংকের খেলাপি রয়েছে ৪৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৪২.৯৬ শতাংশ।
এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি রয়েছে ১০,২৯৩ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ১৩,৮৩৭ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৩৮৩৪ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৭,৮৭১ কোটি টাকা ও বেসিক ব্যাংকের ৭,৬১৯ কোটি টাকা।
কোভিডের মধ্যে গত বছর কেউ এক টাকাও ফেরত না দিলেও কাউকে খেলাপি করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই সুবিধা আর না বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। তবে কেউ যেন ঋণ পরিশোধে সমস্যায় না পড়েন, সে জন্য চলমান ঋণের ওপর ২০২০ সালে আরোপিত অনাদায়ী সুদ একবারে পরিশোধ না করে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত ছয়টি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়।
আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ চলতি বছরের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আটটি কিস্তিতে পরিশোধ করতে বলা হয়। পরে গত ২৭ আগস্ট শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলার দিয়ে জানায়, এসব ছাড়ের পর চলতি বছর যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তার ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলে তিনি আর খেলাপি হবেন না।