৫ হাজার টন কাগজ বিক্রি না হওয়ায় বিপাকে কর্ণফুলী পেপার মিল
দেশের বৃহত্তম কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী পেপার মিলসের (কেপিএম) উৎপাদিত কাগজের মূল ক্রেতা সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সরকারি নিয়োগ, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে। ফলে, এক বছর আগে উৎপাদন করা ৫০ কোটি টাকা মূল্যমানের কাগজ অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে কর্ণফুলীর গুদামে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রি না হওয়ায় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ কেমিক্যাল করপোরেশনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না কেপিএম কর্তৃপক্ষ।
আর্থিক সংকটে কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ কেমিক্যাল করপোরেশনের (বিসিআইসি) কাছ থেকে ২৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে কাগজ উৎপাদনের পাল্প আমদানি করে কেপিএম।
আমদানিকৃত কাঁচামাল দিয়ে কাগজ উৎপাদন করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে জাতীয় নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি কার্যক্রমে কাগজের ব্যবহার কমে যাওয়ায় বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সংকটকালীন সময়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কেপিএম থেকে কাগজ ক্রয় বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে বিজি প্রেস সীমিত পরিসরে কাগজ ক্রয় করলেও প্রতিদিনই কেপিএমের উৎপাদিত কাগজের মজুদ বাড়ছে।
কাগজ অবিক্রিত থাকায় বড় ধরনের আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এক সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজ চাহিদার প্রায় শতভাগ পূরণ করতো কর্ণফুলী পেপার মিল। দুই দশক ধরে বেসরকারি খাতে কাগজকল স্থাপন ও আমদানিকৃত কাগজের কারণে ব্যবসায়িক ভাবে পিছিয়ে পড়ে পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ পেপার মিলটি।
সংকট এড়াতে সরকারি প্রয়োজনের সব ধরনের কাগজ কেপিএম থেকে ক্রয়ের নির্দেশনা দেয় সরকার। মুষ্টিমেয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এই অনুশাসন মানলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সেটি মানছে না। যার কারণে লাভের পরিবর্তে লোকসানের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে মানসম্মত কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি।
কেপিএম এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিসিআইসি, শিল্প মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে ধাপে ধাপে লোকসান কমানোর পাশাপাশি কাগজ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন তারা। করোনা মহামারির লকডাউন শেষে কারখানাটি আবারো কাগজ উৎপাদন শুরু করে।
কারখানা সচল রেখে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় কাগজ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিসিআইসি থেকে স¤প্রতি ২৭ কোটি টাকা ঋণ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এই টাকায় বিদেশ থেকে পাল্প আমদানি করে করা হয়। কিন্তু উৎপাদিত কাগজ বিক্রি না হওয়ায় গভীর সংকটে এশিয়ার বৃহত্তম ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত এই কাগজকল।
বর্তমানে মিলের উৎপাদিত সাদা কাগজ বিক্রি না হওয়ায় কাগজ স্তূপীকৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
কারখানার তথ্যমতে, কর্ণফুলী পেপার মিলের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭০ থেকে ৮০ টন।
কিন্তু, যথাসময়ে কাগজ বিক্রি করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটি এখন দিনে মাত্র ৮ থেকে ১০ টন কাগজ উৎপাদন করছে। সক্ষমতা কম হলেও উৎপাদন অব্যাহত থাকায় উৎপাদিত কাগজ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে।
কর্ণফুলী পেপার মিলের কমার্শিয়াল ম্যানেজার এইচ এম আনিসুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, কারখানাটি সচল রাখতে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু, উৎপাদন শেষে ক্রেতা না পাওয়ায় কেপিএমের প্রায় ৫ হাজার টন পেপার অবিক্রিত রয়ে গেছে।
নির্দিষ্ট সময়ে ক্রেতা না পেলে উৎপাদিত এসব কাগজ নষ্ট হয়ে কেপিএমের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
কর্ণফুলী পেপার মিলের সাম্প্রতিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ২০১৬ সালে। সে বছর প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ৮০ টন কাগজ উৎপাদন করে।
এসময় প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক কাগজ বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫-১৬ হাজার টন। কিন্তু দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, নির্ধারিত সময়ে কারখানা সংস্কার করতে না পারায় দীর্ঘদিনের পুরনো কাগজকলটির কার্যক্ষমতা কমে আসছে।
সক্ষমতার ৭ থেকে ৮ গুণ কম উৎপাদন হওয়ায় বাজার মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে প্রতিবছরই বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে রয়েছে সরকারি এই কাগজকলটি।
কারখানাটিতে বর্তমানে ২২৫ জন স্থায়ী শ্রমিক ও কর্মকর্তা কাজ করছেন। এছাড়া বাকি ৩০০ অস্থায়ী শ্রমিক কারখানায় নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের বেতনসহ কর্ণফুলী পেপার মিলের মাসিক খরচ কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা।
সেই হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির খরচ বাদে মুনাফায় থাকতে হলে মাসে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ টন কাগজ উৎপাদন করা দরকার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটি মাসে মাত্র ৩০০ থেকে ৩৫০ টন কাগজ উৎপাদন করছে।
এক সময় দেশে তুমুল জনপ্রিয় ছিল কর্ণফুলী পেপার মিলের উৎপাদিত কাগজ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে গত দশ-পনের বছর আগ পর্যন্ত দেশের ছাত্র-শিক্ষকের প্রথম পছন্দ ছিল কর্ণফুলী পেপার।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কাগজ উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের স্বায়িত্তশাসিত সংস্থা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন কর্তৃক পরিচালিত হয়।
১৯৫৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক রাঙামাটি জেলা কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী পেপার মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। কর্ণফুলি পেপার মিল শিল্প আইনের অধীনে নিবন্ধিত প্রথম কাগজশিল্প যা ত্রিশ হাজার শ্রমিক নিয়ে এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাগজ-কল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মিলটি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন এবং ইতালির সহযোগিতায় ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় স্থাপিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্যমাত্রা ছিল বার্ষিক ৩০ হাজার মেট্রিক টন।
১৯৫৩ সালের ১৬ই অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। শুরুতে ব্যবস্থাপনা ক্রটি থাকায় ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকার দাউদ গ্রুপের নিকট কোম্পানিটি বিক্রি করে দেয়। তারা কলের আধুনিকায়নের কাজ করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠানটিকে অধিগ্রহণ করে।