বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জটিলতা যেভাবে চামড়া শিল্পের প্রবৃদ্ধি রুখে দিচ্ছে
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন ব্যবস্থায় ঘাটতির কারণে থমকে গেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্পের প্রবৃদ্ধি।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক অসঙ্গতির কারণে মূলত নিরুৎসাহিত হন বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীরা। ফলে, প্রচুর সুযোগ এবং সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ শিল্প বিশ্ববাজারে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি।
শনিবার এক সেমিনারে ট্যানার ও রপ্তানিকারকরা এসব অভিযোগ তুলে ধরে সাভার ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারকে পুরোপুরি কার্যকর করার ওপর জোর দেন। তাদের মতে, এ পদক্ষেপ বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করবে এবং এতে রপ্তানি বাড়বে।
সিইটিপির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে তারা একে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অধীনে আনার পরামর্শও দিয়েছেন।
এশিয়া ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে ঢাকার একটি হোটেলে 'বাংলাদেশ ট্যানারিজ: টুয়ার্ডস কমপ্লায়েন্স সেক্টর' শীর্ষক সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, "২০১৭ সালে যখন সিইটিপি চালু ছিল না তখন প্রায় ২২২টি ট্যানারি সাভার এস্টেটে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও তখন ছিল না।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা ভেবেছিলাম অবশেষে একটি সুপরিকল্পিত শিল্প এস্টেটের দিকে যাওয়া যাবে, যা হবে কমপ্লায়েন্ট এবং পরিবেশবান্ধব। কিন্তু সেই আশা এখনও পূরণ হয়নি।"
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি চামড়া উন্নয়ন বোর্ড গঠনের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নতুন কোম্পানি গঠন করা হয়েছে, তবে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সপ্তাহে একবার এস্টেট পরিদর্শন করেন।
সিইটিপি 'খুবই নাজুক অবস্থার মধ্যে' আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "নানা ধরনের নিয়ম-নীতি বিষয়ক জটিলতার কারণে আমরা ভুগছি। আমরা এ থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই। কমপ্লায়েন্ট হওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। আমাদের অন্তত ২০টি ট্যানারির এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশনের রিকোয়ারমেন্ট পূরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে।"
লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) একটি অলাভজনক সংস্থা। অডিট স্ট্যান্ডার্ডের মাধ্যমে আরও রেসপন্সিবল ও ট্রান্সপারেন্ট লেদার সাপ্লাই চেইন নিশ্চিতে কাজ করে তারা।
সেমিনারে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) ভাইস চেয়ারম্যান দিলজাহান ভূঁইয়া বলেন, "আমরা কখনই জানতাম না যে রপ্তানিকারকদের এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন প্রয়োজন। কিন্তু এখন আমরা দেখছি এটি আমাদের পণ্য রপ্তানির জন্য একটি প্রধান মান হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানি হয় ১.২২ বিলিয়ন ডলারের, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১.৭৪% কম।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি সম্পূর্ণ কার্যকরী সিইটিপি ও এ সংশ্লিষ্ট নানা পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা চললেও সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে।
এর ফলে, ধনী দেশগুলোর সাথে ব্যবসা-অনুকূল বাণিজ্য চুক্তি থাকা সত্ত্বেও, ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক ফুটওয়্যার মার্কেটে নিজেদের সম্ভাব্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিল্পটি।
সেমিনারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, সিইটিপিতে আসলেই কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে সরকার এর ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিকল্প চিন্তা করছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, "আমরা একে চামড়া খাত উন্নয়ন বোর্ড বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় নিয়ে আসা বা বেপজাকে দায়িত্ব দেওয়ার মতো বিকল্প পদক্ষেপ নিয়ে ভাবছি।"
"এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে আমরা আমাদের নিজস্ব সম্পদ থাকা সত্ত্বেও চামড়া রপ্তানি বাড়াতে পারছিনা। আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ১২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির কথা বলছি। আরএমজি ভালো করছে কিন্তু অন্যান্য খাত তা করছে না," বলেন তিনি।
সেমিনারে বক্তৃতাকালে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তাক আহমেদ বলেন, সিইটিপিকে সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করতে সংশোধন ও পরিবর্তন প্রয়োজন।
প্রাথমিকভাবে সিইটিপিতে ত্রুটি ছিল। ক্রোম পুনরুদ্ধার ইউনিট শুরু থেকেই কর্মক্ষম না। এটি সংশোধনের পাশাপাশি ১৮টি পাম্প ও ট্যাঙ্ক বদলাতে করতে হবে।
"সিইটিপি কমপ্লায়েন্সের বিষয়ে ত্রুটি রয়েছে," বলে তিনি। মুস্তাক আহমেদ আরো জানান, কোম্পানি সিইটিপি পরিবর্তনের বিষয়ে একটি বিদেশি সংস্থার সাথে আলোচনা করছে। সংস্থাটি বেশকিছু সুপারিশ করেছে।
"ছয় মাসের মধ্যে কমপ্লায়েন্স সম্ভব কিন্তু এর জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। যত তাড়াতাড়ি এটি করা হবে, ততই তা শিল্পের জন্য মঙ্গলজনক," বলেন তিনি।
মূল প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ বিলিয়ন ডলার।
"এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে ৪০% প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু আমরা ২০১৭ সালে যে পরিমাণ রপ্তানি ছিল, সে অবস্থানেই পড়ে আছি। কমপ্লায়েন্স সমস্যার কারণে চামড়া খাত উন্নত হচ্ছে না," বলেন তিনি।
এক্ষেত্রে তিনি কিছু পরামর্শ দিয়েছেন- একটি চামড়া উন্নয়ন বোর্ড গঠন, কার্যকর সিইটিপি, কমপক্ষে ১৫টি কারখানার এলডব্লিউজি সার্টিফিকেট অর্জন, উদ্যোক্তাদের ৫০০ কোটি টাকা সুদ-মুক্ত ঋণ দেওয়া (যারমধ্যে সিইটিপি'র জন্য ৩০০ কোটি টাকা এবং প্রত্যেক ইটিপির জন্য ২০০ কোটি টাকা) ও ট্যানারি শিল্প এস্টেটের জন্য কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউজ নির্মাণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চামড়া প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বিশ্বব্যাপী চামড়ার বাজারের মূল্য প্রায় ৩২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশ এর কাঁচামালের ৩% উৎপাদন করে। সেই হিসাবে, সমস্ত কাঁচামাল ব্যবহার করা হলে রপ্তানি কমপক্ষে ১২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
সিইটিপি নন-কমপ্লায়েন্স এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা- উল্লেখ করে তিনি বলেন, "সিইটিপি অকার্যকর রাখার জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় আনা উচিত।"