৫ পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধি, মসলা ও শুকনো খাদ্যপণ্যের বাজার অস্থির
এক সপ্তাহ আগে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি জিরার দাম ছিল সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা। কিন্তু মাত্র পাঁচ দিনে ৭০০ টাকা বেড়ে এখন জিরা বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়।
একইভাবে প্রতি কেজি কালো এলাচের দাম ৭০০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ১৪০০ টাকা এবং ৫৫০ টাকা থেকে বেড়ে ক্যারাওয়ে সিড বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়।
শুধু জিরা, কালো এলাচ কিংবা ক্যারাওয়ে সিড নয়, গত পাঁচদিনে বাজারে প্রায় প্রতিটি মসলা ও শুকনো পণ্যের দাম অস্থির হয়ে উঠেছে।
এরমধ্যে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হচ্ছে পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, সয়াসিড, মিষ্টি জিরা ও আলুবোখারা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চাহিদার তুলনায় এসব পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারেও দামের খুব বেশি হেরফের হয়নি।
কিন্তু হঠাৎ করে গত রোববার থেকে পাঁচটি পণ্যের উপর কাস্টমসের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধি করায় মসলা ও শুকনো খাদ্যপণ্যের পুরো বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
আমদানি পণ্যের উপর ১৮৯ থেকে ৯৩৩ শতাংশ পর্যন্ত অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু (কাস্টমস নির্ধারিত আমদানিকৃত পণ্যের ক্রয়মূল্য) বৃদ্ধি কোনভাবেই যৌক্তিক নয় বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
মসলা ও শুকনো খাদ্যপণ্যের আমদানিকারক ও চট্টগ্রাম কাস্টমস এর তথ্যমতে, এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি পেস্তাবাদামের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ছিল ১৬৫ টাকা। প্রায় ৯৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে এখন তা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫৪০ টাকা। এতে আগে প্রতি কেজি পেস্তাবাদামে ১০০ টাকার ডিউটি থাকলেও এখন তা দাঁড়িয়েছে ৯০০ টাকায়।
একইভাবে প্রতি টন ক্যারাওয়ে সিডের আমদানি মূল্য প্রতি কেজি ৫৫ টাকা অ্যাসেসমেন্ট করা হলেও বর্তমানে করা হচ্ছে ৩৩০ টাকা। সেই হিসেবে ৬০০ শতাংশ বেড়ে আগে প্রতি কেজিতে ১৮ টাকার জায়গায় এখন ডিউটি গুনতে হচ্ছে ১০৮ টাকা।
আগে প্রতি টন কাঠবাদামে প্রতি কেজি ২০০ টাকা অ্যাসেসমেন্ট হলেও এখন ৬৬০ টাকা আমদানি মূল্য হিসাব করে ডিউটি আদায় করা হচ্ছে। এতে ৩৩০ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি কাঠবাদামে আগের ১১৭ টাকার স্থলে এখন ৩৮৬ টাকা ডিউটি আদায় করা হচ্ছে।
রোববারের আগে প্রতি টন আলুবোখরার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কেজিপ্রতি ১৬৫ টাকা থাকলেও এখন তা করা হয়েছে ৩৮৫ টাকা। ২৩৩ শতাংশ বেড়ে আগে ৫৪ টাকার স্থলে এখন কেজিপ্রতি ৮৩ টাকা ডিউটি গুনতে হচ্ছে।
আগে প্রতি কেজি জিরার অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ছিল ২০৩ টাকা, যা ১৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি করে করা হয়েছে ৩৮৫ টাকা। এতে প্রতি কেজি জিরা আমদানিতে আগের ১২০ টাকা ডিউটির স্থলে বর্তমানে গুনতে হচ্ছে ২২৫ টাকা।
এদিকে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধির কারণে অস্থির হয়ে উঠেছে মসলা ও শুকনো পণ্যের পুরো বাজার। খাতুনগঞ্জের মসলা ও শুকনো খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক সপ্তাহে মসলা ও শুকনো খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জিরা, মিষ্টি জিরা, ক্যারাওয়ে সিড ও কালো এলাচের দাম।
স্বাভাবিক সময়ে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হয় ৩০০-৩৫০ টাকায়, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়।
একইভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে ক্যারাওয়ে সিডের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫৫০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি ক্যারাওয়ে সিড বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা দামে, যা স্বাভাবিক সময়ে ১৫০ টাকার নিচে বিক্রি হয়।
প্রতি কেজিতে ৭০০ টাকা বেড়ে বর্তমানে কালো এলাচ বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ টাকা দামে।
কেজিতে ৩০০ টাকা বেড়ে পেস্তাবাদাম ২৯০০ টাকা, ২০০ টাকা বেড়ে কাঠবাদাম ৮২৫ টাকা, ২০০ টাকা থেকে বেড়ে মিষ্টি জিরা ৩৫০ টাকা, ১৩০ টাকা বেড়ে সয়াসিড ৪৫০ টাকা, ১০০ টাকা বেড়ে কাজুবাদাম ১২৭০ টাকা, ১০০ টাকা বেড়ে টক আলুবোখারা ৪৮০ টাকা, ৮০ টাকা বেড়ে ধনিয়া ২১০ টাকা এবং ৭০ টাকা বেড়ে হলুদ ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া মানভেদে এলাচ ও শুকনো খেজুরের দামও কেজিতে কমপক্ষে ২০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
মসলা ও শুকনো খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ী মেসার্স ইসহাক সওদাগরের স্বত্বাধিকারী সেকান্দার হোসেন বলেন, এক সপ্তাহে প্রায় প্রতিটি মসলা ও শুকনো খাদ্যপণ্যের দাম কেজিতে ৫০-২৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকটি পণ্যেরে উপর কাস্টমস এর অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধির ঘটনায় এসব পণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।
বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকায় অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধির কারণে পণ্য আমদানির ফাঁকে মুদ্রা পাচার হওয়ার আশঙ্কা করেন সেকান্দার সহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
আমদানিকারকরা জানান, গত এক সপ্তাহে ৫টি মসলা ও শুকনো খাদ্যপণ্যের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধি করেছে কাস্টমস। এতে তাদের আমদানিকৃত পণ্যের উপর বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে, যে কারণে বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
শুকনো খাদ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এবি ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অমর কান্তি দাশ বলেন, ডলার সংকটের কারণে এমনিতেই গত এক বছর থেকে বিলাসপণ্য হিসেবে মসলা ও শুকনো খাদ্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। যার প্রভাবে আগে থেকেই আমদানি কমে পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এরপর এবার হঠাৎ করে পাঁচটি পণ্যের ৫০ থেকে ১০০০ শতাংশ পর্যন্ত এসেসম্যান্ট ভ্যালু বৃদ্ধি পুরো বাজারকে অস্থির করে তুলেছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার ফায়জুর রহমান বলেন, সাধারণত আমদানিকারকরা বিশ্ববাজার থেকে যে দামে পণ্য বুকিং দেয় কিংবা ক্রয় করে তার উপর ভিত্তি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত ডিউটি আদায় করে কাস্টমস। তবে আমদানি পণ্যে ঘোষিত দামের চেয়ে বিশ্ববাজারের ক্রয়মূল্য এবং দেশীয় বাজারে বিক্রয়মূল্য কম-বেশি হলে (এনবিআরের ভ্যালুয়েশন রুলস-২০০০ অনুযায়ী) তখন বাজার বিশ্লেষণ করে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধি করে তার উপর ডিউটি আদায় করতে পারে কাস্টমস।
তিনি আরো বলেন, দেশীয় বাজারে অনেক বাড়তি দামে বিক্রি হলেও আমদানিকারকরা এসব পণ্যের আমদানি মূল্য ঘোষণা দিতো কম। যেখানে সরকার অনেক টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতো। তাই কাস্টমস বাজার বিশ্লেষণ করে এসব পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধি করেছে।
টিআইবি-সনাক (সচেতন নাগরিক কমিটি) সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, কোনো পণ্যের উপর হঠাৎ করে ১৮৯-৯৩৩ শতাংশ অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধি সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করে যৌক্তিক ভ্যালু নির্ধারণ করতে হবে। তাছাড়া আমাদের দেশে কোনো ভ্যালু বৃদ্ধি করা হলে তা আর কমানো হয় না। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যের বুকিং দর কমে গেলেও কাস্টমস এর নির্ধারিত বাড়তি ভ্যালুর কারণে বিনা বাধায় অর্থ পাচারের সুযোগ থাকে।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশি বাজারে বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। তার উপর এই মুহূর্তে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বাড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করা কোনোভাবে কাম্য নয়। কোন পণ্যে ভ্যাট ফাঁকির ঘটনা ঘটলে তাতে যৌক্তিক হারে ভ্যালু বাড়াতে হবে। একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের নির্ধারিত অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালুও কমিয়ে আনতে হবে। তাছাড়া কয়েকটি পণ্যের ভ্যালু বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট সব পণ্যের দাম বৃ্দ্ধিও কোনোভাবে উচিত নয়।
বাজার মূল্যের চেয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে ভোক্তাদের চেয়ে আমদানিকারক ও টাকা পাচারকারীদের স্বার্থরক্ষা হবে বলে মনে করছেন টিআইবি-সনাক (সচেতন নাগরিক কমিটি) সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী।