অবৈধ ডিও ব্যবসা: ৫০ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে উধাও খাতুনগঞ্জের এলাচ ব্যবসায়ী
ব্যবসায়ীদের প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ না করে ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম বাজার খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ীর গা-ঢাকা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মসলা পণ্য এলাচ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ডেলিভারি অর্ডার বা সংক্ষেপে ডিও বাণিজ্যের সুযোগে এই প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বাজারের সোনামিয়া মার্কেটের অভিযুক্ত নূর ট্রেডিং-এর মালিক নাজিম উদ্দিন ডিও ট্রেডিং সিস্টেমের অপব্যবহার করে বাজারে এলাচের ব্যবসা চালিয়ে আসছেন বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিআই) পরিচালক আলমগীর পারভেজ।
এ ঘটনা অবশ্য খাতুনগঞ্জের জন্য নতুন কিছু নয়। অবৈধ স্লিপ বা ডিও লেনদেনের জন্য এই বাজার দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত।
আইনি দিক থেকে ডিও কেনাবেচার বিষয়টি 'গ্রে জোন' এ কাজ করলেও বিনাশ্রমে অধিক মুনাফা অর্জনের লালসায় অনেকেই জড়াচ্ছেন জুয়া খেলার মতো এই অবৈধ লেনদেনে। ডিও স্লিপের অপব্যবহারে প্রায়শই আকাশচুম্বী হতে দেখা যায় পণ্যের দাম।
খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বাজারের সোনামিয়া মার্কেটে দীর্ঘদিন ধরে ভোজ্যতেল ও চিনিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা করে আসছেন নূর ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী নাজিম উদ্দিন। যেই মার্কেটটি ভোগ্যপণ্যের অবৈধ ডিও বা স্লিপ বাণিজ্যের জন্য আলোচিত।
মার্কেটটিতে গত কয়েক মাস থেকে এলাচ নিয়ে ডিও বাণিজ্য শুরু হলে নাজিমও এই ব্যবসা শুরু করেন।
এরমধ্যে গত বুধবার (৫ জুন) অনেক ব্যবসায়ীর কাছে এলাচের ডিও বিক্রি করে টাকা নগদায়ন করে হঠাৎ মোবাইল বন্ধ করে দেন নাজিম। ওইদিন কমপক্ষে ৫ কোটি টাকার এলাচের ডিও বিক্রি করলেও তার বিপরীতে ক্রেতাদের পণ্য কিংবা টাকা কোনোটাই দেননি এই ব্যবসায়ী।
এমনকি, ঘটনার তিন-চার দিন আগে থেকে যেসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি পণ্য কিংবা ডিও কিনেছেন, তাদের টাকাও পরিশোধ করেননি।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা জানান, বুধবার সন্ধ্যায় বিষয়টি আলোচনায় আসার পর পাওনাদার ব্যবসায়ীরা নাজিমকে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে নিয়ে যান। ওই সময় কমপক্ষে ৪০-৫০ জন পাওনাদার তাদের পাওনার বিষয়ে অভিযোগ দেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের কাছে। ঘটনার সুরাহা না হওয়ায় ওই দিন রাতে তাকে সমিতির কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়। পরদিন তার ভগ্নিপতি এসে সমিতির নামে ১০ কোটি টাকার চেক দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
এই বিষয়ে চিটাগাং চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক আলমগীর পারভেজ বলেন, "সোনামিয়া মার্কেটের একজন ব্যবসায়ীর কাছে টাকা আটকে যাওয়ায় অভিযুক্ত ব্যবসায়ীকে নিয়ে প্রায় ৪০-৫০জন ব্যবসায়ী গত বুধবার সমিতির কার্য়ালয়ে আসে। যার কাছে প্রায় অর্ধশত কোটি আটকে যাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা। মোট পাওনা কত, তা বের করতে আমরা তিনজনের একটি কমিটি করেছি।"
তিনি আরও বলেন, "একই সাথে পাওনদারদের পাওনা পরিশোধের আশ্বাসে অভিযুক্ত নাজিম উদ্দিনকে তার ভগ্নিপতির জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর থেকে গা ঢাকা দেন ওই ব্যবসায়ী।"
ভুক্তভোগী তানিশা এন্টারপ্রাইজের আব্দুল মান্নান জানান, গত মঙ্গলবার নূর এন্টারপ্রাইজ থেকে তিনি ১১ টন এলাচের ডিও কিনেন। কিন্তু এর বিপরীতে এলাচ কিংবা চেক কোনোটাই দেননি নাজিম।
"আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে নাজিমের দেওয়া চেক পাস না হওয়ায় তার প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসে। এরপর আমরা তাকে ব্যবসায়ী সমিতির অফিসে নিয়ে যাই। সমিতি থেকে পাওনা পরিশোধের সময় নিয়ে এখন তিনি বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছেন," বলেন আব্দুল মান্নান।
তানিশা এন্টারপ্রাইজ ছাড়াও নাজিম উদ্দিনের কাছে এসকে ট্রেডার্সের কফিল উদ্দিনের ২০ টন এলাচ বাবদ সাড়ে আট কোটি টাকা, দীন কোম্পানির কামাল উদ্দিনের ৮৪ লাখ টাকা, মেহের স্টোরের মো. আলীর ৮০ লাখ টাকা এবং এএম ট্রেডার্সের মো. লিটনের এক কোটি টাকাসহ ৪০-৫০ জন ব্যবসায়ীর অর্ধ শত কোটি টাকা পাওনা আটকে গেছে।
দেশের ভোগ্যপণ্যের প্রাচীন বাজারটিতে যুগের পর যুগ ধরে বিশ্বাসের ভিত্তিতে পণ্য বিকিকিনি হয়ে আসছে। যেখানে দিন, সপ্তাহ, মাস এমনকি বছরান্তে টাকা পরিশোধের শর্তেও পণ্যের লেনদেন হয়। কিন্তু গত চার দশকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার লেনদেনে ভাটা পড়ে। মূলত পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ না করে ব্যবসায়ীদের গা ঢাকা দেওয়ার প্রবণতায় এই আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
যদিও দেশে মসলাপণ্য এলাচের বার্ষিক চাহিদা ৮,০০০ টনেরও কম, তবে বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) কেনাবেচার মাধ্যমে এই চাহিদা কৃত্রিমভাবে দৈনিক ১,০০০ টনের বেশি বানানো হয়েছে। এতে করে অস্থির হয়ে উঠেছে এলাচের বাজার।
ডিও হলো পণ্য বিক্রির বিপরীতে দেওয়া ডেলিভারি অর্ডার। এলাচের ক্ষেত্রে ডিও ট্রেডিংয়ের মধ্যমে সাথে সাথে এলাচের ডেলিভারি না নিয়ে ভবিষ্যতে নেওয়ার জন্য মসলাটির কেনা-বেচার চুক্তি করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময়ে পণ্যটির মূল্য ওঠানামা থেকে মুনাফা অর্জনের লোভে প্রায়ই বড় অঙ্কের চুক্তিতে যান। তাদের এই কারসাজিতে অস্থির হয়ে ওঠে পণ্যের বাজার। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন ভোক্তা, ব্যবসায়ী উভয়ই।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী সেকান্দার হোসেন জনান, "এটি এক ধরনের জুয়া খেলার মতো। যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা পণ্যের ডিও বা স্লিপ বিক্রি হয়। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতারা জানেন না এই পণ্য কোথায়। এই ডিও বেচাকেনায় কোনো একটি পণ্যের দাম সর্বোচ্চ হয়ে হঠাৎ বড় দরপতন হয়। তখন ডিও বা স্লিপগুলো যাদের হাতে থাকে, তারা বড় লোকসানে পড়ে মার্কেট থেকে উধাও হয়ে যান।"
গত দুইমাস যাবত খাতুনগঞ্জে ডিও কেনাবেচার চাপে অস্থির হয়ে উঠেছে মসলাপণ্য এলাচের বাজার।
এক হাত থেকে আরেক হাতে ডিও বেচাকেনার মাধ্যমে ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে গত দুইমাসে এলাচের দাম বেড়ে বর্তমানে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৩,৯০০ টাকায়। অথচ বাজারে বিক্রি হওয়া এসব এলাচ আমদানি করতে প্রতিকেজিতে খরচ পড়েছে ১,২০০-১,৫০০ টাকা।
ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, ১৯৮৬ সালের পর থেকে ২০১৯ সাল পর্য়ন্ত কমপক্ষে ৬৮ জন ব্যবসায়ী বাজারে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ না করে গা ঢাকা দিয়েছেন। যারা বাজার থেকে নিয়ে গেছেন কমপক্ষে ৯০০-১০০০ কোটি টাকা।