আরও কঠোর কৃচ্ছ্রতা সাধনের পথে সরকার
ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও রাজস্ব কমে যাওয়া মোকাবেলা করতে কৃচ্ছ্রতা সাধনের সর্বাত্মক চেষ্টা হিসেবে সরকার এবার চলতি অর্থবছরের জন্য পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে থোক হিসেবে বরাদ্দ রাখা ৩৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা ছাড় করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
পরিচালন বাজেটের থোক বরাদ্দের ১১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ছাড় করা স্থগিত রাখা এবং উন্নয়ন বাজেটের থোক বরাদ্দের ২৩ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করে অর্থ বিভাগ শিগগিরই নির্দেশনা জারি করবে বলে আশা করা হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
এছাড়া যেসব প্রকল্পের মূল কাজ বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষতার উন্নয়ন, সেসব প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে অর্থ বিভাগ।
কর্মকর্তারা বলেন, বাজেট ঘাটতি কার্যকরভাবে সামলাতে এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সম্ভাব্য বাড়তি তহবিলের প্রয়োজন মেটানোর জন্য হাতে টাকা রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তারা বলেন, তহবিল অব্যবস্থাপনার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও থোক বরাদ্দের ওপর আগে কখনও এমন বিধিনিষেধ দেওয়া হয়নি।
বিশ্লেষকরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, রাজস্ব সংগ্রহ ও বিদেশি অর্থায়নের প্রবাহ প্রত্যাশার চেয়ে কম হওয়ায় আর্থিক চাপের সময় এ উদ্যোগের ফলে টাকা বাঁচতে পারে।
এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে থোক বরাদ্দ রাখার বিপক্ষে, কারণ মন্ত্রণালয়গুলো এই টাকা বেহিসেবি খরচ করে।
'এবার সরকারের আর্থিক টানাপোড়েন আছে। রাজস্ব আদায়ও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জিত হবে না। অন্যদিকে, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় থোক বরাদ্দের অর্থ ছাড় না করার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক বলে আমি মনে করি।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, থোক বরাদ্দ ব্যয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ভালো সিদ্ধান্ত। 'কারণ এসব বরাদ্দের অর্থ রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যয় হয়। রাজনীতিবিদরা নিজের এলাকায় প্রকল্প নিয়ে থোক থেকে অর্থ ব্যয় করেন।'
তবে বিধিনিষেধ আরোপ করে নির্বাচনী বছরে থোক বরাদ্দের অর্থ কতটা সাশ্রয় করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
'বিশেষ করে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় এক্ষেত্রে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা কম,' বলেন তিনি।
গত বছরের কৃচ্ছ্রতা পদক্ষেপ থেকে সঞ্চয়
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরপরই সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা বাঁচানোর লক্ষ্যে ধারাবাহিক কৃচ্ছ্রতা সাধনের পদক্ষেপ নেয়। তবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে, এসব উদ্যোগের ফলে প্রকৃতপক্ষে মোট ১৫ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো গেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম।
নির্বাচনের প্রস্তুতি
জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত অর্থ বিভাগের অভ্যন্তরীণ এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিশ্চিত করেছেন।
ওই সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, 'নির্বাচনকালীন চলমান অর্থবছরে কয়েকটি মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত আর্থিক চাহিদা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।'
এরকম অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে অপ্রত্যাশিত খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এর বাইরে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হলে তা পরিচালন খাতে থোক হিসেবে বরাদ্দ রাখা অর্থ থেকে জোগান দেওয়া হবে।
তবে সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, নির্বাচনের ব্যয় মেটানোর জন্য নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে ইতিমধ্যে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
'তারপরও বাড়তি অর্থের দরকার হলে অর্থ বিভাগের অপ্রত্যাশিত খাতে বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করা যাবে। তাই থোক বরাদ্দের অর্থ নির্বাচনে ব্যয় করার প্রয়োজন হবে না। তবে থোক বরাদ্দ থেকে ব্যয় কমাতে পারলে বাজেট ঘাটতি কমবে,' বলেন তিনি।
থোক বরাদ্দের ধারা
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বাজেট প্রণয়নের সময় প্রকল্প নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ততা থাকায় বরাদ্দের অর্থ কোথায় কত ব্যয় হবে, তা চূড়ান্ত করা খুব কঠিন হয়।
সে কারণেই উন্নয়ন ও পরিচালন বাজেটে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এই অর্থ অপব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, 'বাজেট সংশোধনের সময় থোক বরাদ্দের অর্থ কোথায় কী পরিমাণ ব্যয় হবে, তা চূড়ান্ত করে ব্যয় করা হয়। তাই সংশোধিত বাজেটের আগে উন্নয়ন বাজেটে থোক বরাদ্দের অর্থ সাধারণত ব্যবহার হয় না।'
ওই কর্মকর্তা জানান, সাধারণত প্রতি বছর ডিসেম্বরে বাজেট সংশোধনের কাজ শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়।
তবে এ বছর ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে জানুয়ারিতে বাজেট সংশোধনের কাজ শুরু হয়ে মার্চে শেষ হবে। ফলে মার্চের আগে উন্নয়ন বাজেটে থোক বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা নেই।
সেজন্য এখন অর্থ ছাড় করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে নির্দেশনা জারি করা হবে বলে জানান তিনি।
চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটের থোক বরাদ্দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা থোক। এ খাতে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ৪ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা।
বাকি ১৯ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অননুমোদিত প্রকল্পে থোক বরাদ্দ হিসেবে রাখা হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে উন্নয়ন খাতের জন্য থোক বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই থোক বরাদ্দ কমে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকায়।
চলতি অর্থবছরে পরিচালন খাতে যে ১১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে অর্থ বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে পরিচালন বাজেটে থোক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে এটি দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা।
অন্যান্য পদক্ষেপ
কুচ্ছ্রতা সাধনের অংশ হিসেবে ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশ নেওয়াসহ সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণে ইতোপূর্বে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে এমন কিছু প্রকল্প রয়েছে, যাতে প্রকল্পের প্রধান কাজ হলো বিদেশ ভ্রমণ করা। এবার ওইসব প্রকল্পের আওতায়ও বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ বিভাগ।
অর্থ বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব প্রশিক্ষণধর্মী প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণসূচিতে ইনবিল্ট বৈদেশিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, সেসব বৈদেশিক প্রশিক্ষণ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিবেচনা করা হবে না।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভূমি অধিগ্রহণ খাতে ১৩ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। গত ২ জুলাই কৃচ্ছ্রতা সাধন-সংক্রান্ত এক পরিপত্রে অর্থ বিভাগ বলেছে, ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে এ খাতে বরাদ্দের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।
এতে উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি স্পষ্ট করে আরেকটি পরিপত্র জারি করে উন্নয়ন বাজেটের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণের অচলাবস্থা দূর করা হবে।
এছাড়া, পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশে ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার।