ব্যাংক ‘বাধ্যতামূলক’ করে একীভূতকরণের উদ্যোগে যেভাবে হিতে-বিপরীত হচ্ছে
দুর্বল ব্যাংকের সাথে শক্তিশালী ব্যাংকের একীভূতকরণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পরে এবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগ এখন হিতে-বিপরীত হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে, ব্যাংকগুলো এটিকে বলছে 'চাপ দিয়ে' একীভূতকরণ, তারা এর বিরোধিতাও করছে।
এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের যৌথ বসন্তকালীন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সাইডলাইনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের কাছে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ঋণদাতাটি তাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরে।
আইএমএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্তোয়েনেট মনসিও সায়েহ'র সাথে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের আলোচনার সময় ব্যাংকের একীভূতকরণের বিষয়টি উঠে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারও প্রতিনিধি দলে ছিলেন।
ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলো সম্পর্কে মন্ত্রিসভাকে জানাতে সারসংক্ষেপ তৈরির সাথে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, "আইএমএফের পক্ষ থেকে সবল ও দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় এবং এবিষয়ে কিছু উদ্বেগও তুলে ধরা হয়।"
মন্ত্রিসভার জন্য প্রস্তুতকৃত সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, আইএমএফের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একীভূতকরণের যৌক্তিকতা ও বর্ণনা করে জানানো হয়, "একীভুতকরণের জন্য কাউকে জোর করে বাধ্য করা হচ্ছে না এবং সম্পূর্ণ আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে একীভূত হতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।"
এর আগে ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে সম্পদের মান যথাযথভাবে নিরীক্ষা করে এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত। নাহলে অবিবেচনাপ্রসূত মার্জারের ফল ভালো হবে না।
দাতাসংস্থাটির 'বাংলাদেশ আপডেট, স্পেশাল ফোকাস: স্ট্রেংদেনিং ডমিস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন' শীর্ষক সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে বলা হয়, "এসব বিষয় সমাধানের আগে দ্রুত ব্যাংক একীভুত করা হলে — এই খাতের ওপর আস্থার আরো ঘাটতি তৈরি হবে, ব্যাংকের মধ্যস্ততা সক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হবে।"
এদিকে ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ শুরু হওয়ার এক মাসের মধ্যেই এটি বাধার মুখে পড়েছে।
সবল ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সাথে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকগুলোর পরে মার্জারের প্রস্তাবগুলো দেওয়া হয়। দুর্বল কোন ব্যাংকের সাথে তারা একীভূত হতে চায়– এসব ব্যাংককে তা বেছে নেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়। কিন্তু, একীভূতকরণের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা কিছু ব্যাংক এখন পিছু হটেছে।
ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার এবং আমানতকারীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হওয়ায়, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একীভূতকরণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ধীরে চলার নীতি নিয়েছে।
একীভূত করার জন্য নির্বাচিত কিছু ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যে আমানত তোলার হিড়িক পড়ে গেলে– তা দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরে একটি বিজ্ঞপ্তিও জারি করতে হয়েছে।
একীভূতকরণের প্রস্তাবসমূহ: সম্মতি ও আপত্তি
বেসরকারিখাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার নির্দেশ দেয়। এর দুই সপ্তাহ পরে গত শনিবার একীভূত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) শীর্ষ নির্বাহীদের গত ৯ এপ্রিল হঠাৎ ডেকে পাঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ইউসিবির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান চৌধুরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ কাদরীর সাথে অনানুষ্ঠানিক ওই বৈঠকে সংকট-কবলিত ন্যাশনাল ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ন্যাশনাল ব্যাংককে মৌখিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় বলে জানায় ব্যাংকটির একটি সূত্র।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনার পর ব্যাংকের বোর্ড সভায় একীভূত হওয়ার প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়। তবে বোর্ড সদস্যরা এতে সম্মতি দেননি।
এমন আরেকটি ঘটনা হলো বেসিক ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সিটি ব্যাংকের সাথে একীভূত হতে বললেও – বেসিক ব্যাংক তাতে রাজি হয়নি।
সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মাশরুর আরেফিনের সঙ্গে গত ৮ এপ্রিল আরেকটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। সেখানে তাদেরকে দুর্বল একটি ব্যাংকের সাথে একীভূত হতে নির্দেশনা দেন তিনি। তখন সিটি ব্যাংকের কর্তৃপক্ষ মার্জারের জন্য বেসিক ব্যাংককে বেছে নেয়।
তবে শেষপর্যন্ত একীভূত হতে আপত্তি জানিয়েছে বেসিক ব্যাংক।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ব্যাংকার বলেছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর 'টক্সিক' সম্পদ ও দায় থাকায় সবল ব্যাংকগুলো তাদের সাথে একীভূত হতে রাজি নয়।
তাঁরা আরো বলেন, মার্জারের জন্য নির্ধারিত ব্যাংকগুলোর পরিচালক বোর্ডের সদস্য ও শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূত হতে 'চাপ প্রয়োগ' করেছে।
যেভাবে এই উদ্যোগের শুরু
৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের অন্যতম শর্ত হিসেবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করতে বলে আইএমএফ। তারপরেই ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়টি সামনে আসে।
আবু ফারাহ মো. নাসের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরপরই গত ৩ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি একটি একীভূতকরণ নীতি জারি করেন, যেখানে একীভূতকরণের জন্য শর্টলিস্ট করা ব্যাংকগুলো যদি স্বেচ্ছায় একীভূত হতে ব্যর্থ হয় – তাহলে তাদের "বাধ্যতামূলক একত্রীকরণ" এর বিকল্প রাখা হয়।
এই নীতি দুর্বল ব্যাংকের পরিচালকের সেইফ এক্সিট দিয়েছে, এবং পাঁচ বছর পরে পুনরায় বোর্ডে ফিরে আসার সুযোগ খোলা রাখছে। এতে দুর্বল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্মীরা একীভূত হওয়া প্রতিষ্ঠানে চাকরিও সুযোগ পাচ্ছেন।
কোন ব্যাংকের সাথে তারা একীভূত হতে চায় এটা বেছে নিতে কিছু ভালো ব্যাংকের কাছে ১০টি ব্যাংকের তালিকা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানুয়ারির মধ্যে তারা স্বেচ্ছায় একীভূত না হতে পারলে– বাধ্যতামূলক একীভূতকরণে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব ব্যাংক হচ্ছে, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), এবি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
একীভূত হলে ১০টি দুর্বল ব্যাংক তাদের অন্তত ৮৪ হাজার কোটি টাকার দায়, ৫৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ও ৩০ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি –ভালো ব্যাংকগুলোর কাছে পার করে দিতে পারবে।
তবে এই একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাংকখাতের খেলাপি ঋণ বর্তমানের ৯ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশে নামবে। এবং ২০২৬ সাল নাগাদ দুর্বল ব্যাংকের স্থিতিপত্রের উন্নয়নে আইএমএফ ঋণ প্যাকেজের অংশ হিসেবে যে শর্ত দিয়েছে, তা পূরণের সহায়ক হবে।
গত ৭ এপ্রিল একত্রীকরণ নীতি ঘোষণার পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাঁচটি ব্যাংক। এরমধ্যে সোনালী ব্যাংক একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের সঙ্গে; বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক – রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে; সিটি ব্যাংক – বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে; ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক – ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে এবং এক্সিম ব্যাংক – পদ্মা ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু, মার্জারের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পরেই আমানতকারীদের মধ্যে যে ভীতি তৈরি হয় – তাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তখনই হঠাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দেয় যে, আপাতত নতুন করে আর কোনো একীভূতকরণের প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে না।
গত ১৫ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, "ব্যাংক একীভূত করতে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অডিটর নিয়োগ, সম্পদ ও দায় ঠিক করা, শেয়ার দর ঠিক করা, শেয়ার অংশ নির্ধারণ ও আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। এতে সময় লাগবে। এই পাঁচ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে আমরা (বাংলাদেশ ব্যাংক) অভিজ্ঞতা নেব। অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন আছে।"
এদিকে একীভূত হওয়ার প্রস্তাবগুলো গণমাধ্যমে আসতেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের আমানত তোলার হিড়িক পড়ে যায়।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসের ১১ শতাংশের তুলনায় গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক খাতের আমানত প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৪২ শতাংশে নেমে আসে। মার্চের আমানত প্রবৃদ্ধির হালনাগাদ তথ্য এখনও প্রকাশিত না হলেও – কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান তা পড়তিরই দিকে।
এই অবস্থায় গত ২৩ এপ্রিল ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের আশ্বস্ত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, একীভূত করার প্রক্রিয়ায় তাদের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে।
একীভূতকরণের উদ্যোগটি পুঁজিবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দুর্বল ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরে সিটি ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারের দরপতনও ঘটে।