ভ্যাট বাড়ানোর পরিকল্পনা এনবিআরের; বিমানভাড়া, সিগারেট, হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাড়তে পারে খরচ
ভোক্তাদের শীঘ্রই বিমান ভ্রমণ, সিগারেট, এলপিজি, পোশাক, রেস্তোরাঁর খাবার এবং হোটেল খরচে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হতে পারে। কারণ সরকার এসব পণ্য ও পরিষেবার ওপর কর বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। এর ফলে দেশে ইতোমধ্যেই ১১ শতাংশ ছাড়ানো মূল্যস্ফীতি আরও তীব্র হতে পারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রেস্তোরাঁয় ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। নন-এসি হোটেলের ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে।
এছাড়া অভ্যন্তরীণ, সার্কভুক্ত দেশে এবং আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান ভাড়াও বাড়তে পারে। বিমান টিকিটে আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় ফ্লাইটে শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা, সার্ক দেশগুলোর ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকা এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ৩,০০০ টাকা থেকে ৪,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে এনবিআর ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য স্থির করেছে।
পোশাক খাতে ব্র্যান্ডেড ও নন-ব্র্যান্ডেড উভয় ধরনের পণ্যের ওপর ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি, ট্রেডিং কার্যক্রমে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ করা হতে পারে। এলপিজির ট্রেডিং পর্যায়ে ভ্যাটও ৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। মোট ৪৩টি পণ্য ও পরিষেবার ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তামাকজাত পণ্যের দাম ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করে অর্থবছরের বাকি সময়ের মধ্যে ৪,০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া মোবাইল টক-টাইমে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ এবং ওষুধের ওপর ভ্যাট ২.৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর ওষুধ ও মোবাইল টক-টাইম শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব আপাতত স্থগিত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে এনবিআর শিগগিরই একটি নির্দেশনা জারি করতে পারে।
এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, 'এনবিআরের প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হয়েছে। বুধবার কিছু সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশোধনের পর একটি অধ্যাদেশ জারি করা হবে।' তবে তিনি সংশোধনের বিস্তারিত বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
আইএমএফের নতুন রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অংশ হিসেবে এনবিআর ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে ১২,০০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এটি দেশে মধ্যবছরে ভ্যাট বৃদ্ধির নজিরবিহীন ঘটনা।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এমন পদক্ষেপ ভোক্তাদের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. লুৎফর রহমান বলেন, 'অতীতে অর্থবছরের মাঝামাঝি ভ্যাট বৃদ্ধি খুবই সীমিত ছিল। তবে এত বড় মাত্রার হঠাৎ বৃদ্ধি আমি আগে দেখিনি। ১০ টাকা ভ্যাট বাড়লে পণ্যের দাম বাজারে ৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।'
আইএমএফের পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, 'দেশীয় সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব অন্যদের ওপর ছেড়ে দিলে উন্নতি সম্ভব নয়।'
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, 'এত বড় হঠাৎ ভ্যাট বৃদ্ধির ঘটনা আমরা আগে কখনো দেখিনি। এটি সাধারণ জনগণের ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।'
তিনি বলেন, 'পণ্যের দাম দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে কর বাড়ালে ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতির চাপও আরও তীব্র হতে পারে।'
তামাক ও অন্যান্য পণ্যে কর বাড়তে পারে
ডিটারজেন্ট, সাবান এবং পেইন্টের মতো সাত ধরনের পণ্যের আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হতে পারে।
তামাকজাত পণ্যের দামও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৬০ টাকা হলেও এটি ১৭০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। উচ্চ, মাঝারি এবং নিম্ন স্তরের সিগারেটের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) যথাক্রমে ১৩০, ৮০ এবং ৫৫ টাকায় নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকার বার্ষিক ব্যবসা টার্নওভারে ভ্যাট হার ৪ শতাংশ। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, ৫০ লাখ টাকার বার্ষিক টার্নওভার অতিক্রম করা ব্যবসার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। এছাড়া, ৫০ লাখ টাকার নিচে টার্নওভারের ব্যবসাগুলোর জন্য ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক ছিল না, যা এখন কমিয়ে ৩০ লাখ টাকায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। ফলে, ৩০ লাখ টাকার বেশি টার্নওভার থাকলেই ভ্যাট নিবন্ধন করতে হবে।
'ব্যবসায়ীরা ১৫% ভ্যাট মেনে নেবেন না'
ব্যবসায়ীদের একটি অংশ প্রস্তাবিত ১৫ শতাংশ ফ্ল্যাট ভ্যাটের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, তারা এটির বাস্তবায়ন মেনে নেবেন না। বিশেষ করে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ফয়সাল পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সিইও সোলায়মান পারসি ফয়সাল টিবিএসকে বলেন, '১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর হলে অনেক ব্যবসায়ী রিবেট [ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট] নিতে পারবেন না, যা ব্যবস্থাটিকে তাদের জন্য অকার্যকর করে তুলবে।'
তিনি আরও বলেন, 'জোরপূর্বক এ নিয়ম চাপিয়ে দিলে ব্যবসায়ীরা আন্দোলনে যেতে পারেন।' তিনি পূর্বে চালু থাকা প্যাকেজ ভ্যাট ব্যবস্থাটি পুনর্বহালের দাবি জানান।
বর্তমানে ব্র্যান্ডেড পোশাকের ভ্যাট হার ৭.৫ শতাংশ।
টিম গ্রুপের অধীনস্থ ব্র্যান্ড টুয়েলভ ক্লোথিং-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব টিবিএসকে বলেন, 'হঠাৎ করে ভ্যাট ১৫ শতাংশ করা হলে এ খাত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এ হার অত্যন্ত বেশি। এটি বিক্রয় কমিয়ে দেবে, বিদ্যমান ব্যবসাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং ব্যবসায়িক লেনদেনকে অনানুষ্ঠানিক খাতে ঠেলে দেবে। ফলে সরকারকে আদতে কম ভ্যাট সংগ্রহ করতে হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমলারা ব্যবসার বাস্তবতা না বোঝার কারণেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।'
প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পরামর্শ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য ভ্যাট বাড়ানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সব গ্রাহকের ওপর প্রভাব ফেলে। এর বদলে ফাঁকি রোধে ভ্যাট আদায়ের দক্ষতা বাড়ানো জরুরি।'
তিনি আরও বলেন, ভ্যাটের হারে একীভূত একটি পদ্ধতি প্রবর্তন করা উচিত।
এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনা উচিত।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, এনবিআরের উচিত রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা করা।
'যদি কর বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, তাহলে তা লক্ষ্যভিত্তিক হওয়া উচিত। কিন্তু, বর্তমান পদ্ধতি শুধু সহজ উপায়ে রাজস্ব সংগ্রহের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে হচ্ছে,' বলেন তিনি।