কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আরও ১,০০০ কোটি টাকা সহায়তা চায় সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক
সংকটে থাকা বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আরও ১ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়েছে। এর আগেও ব্যাংকটিকে ৪ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, '১০ শতাংশ সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এই তারল্য সহায়তা সাপোর্ট চাওয়া হয়েছে। তবে সহায়তা দেওয়া হবে কি না, এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।'
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু সহায়তা চাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদেরকে প্রথমে বলেছিল ৫-৬ হাজার কোটি টাকা দেবে। কিন্তু তারা ৪ হাজার কোটি টাকা দিয়েছিল। তাই আমরা আবার ১ হাজার কোটি টাকা চেয়েছি। গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করার জন্যই এই টাকা চাওয়া হয়েছে।'
যে ৪ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা কীভাবে ও কোন খাতে ব্যয় হয়েছে সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে চেয়েছে উল্লেখ করে এই শিল্পপতি বলেন, 'এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা দিতে আমরা ইতিমধ্যে একটি প্রেজেন্টেশন তৈরি করেছি। আগামী রোববার (১২ জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একটি সভা রয়েছে। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া টাকা কীভাবে খরচ করা হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করা হবে।'
ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে আশাবাদী এই ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বারস অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মিন্টু।
তিনি বলেন, 'ব্যাংকটির আগের পর্ষদ নানা মাত্রায় দুর্নীতি করেছে। এই দুর্নীতি শুধু অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নিয়ম না মেনে ঋণ ও ঋণের সুদ মওকুফসহ অনেক ধরনের দুর্নীতিই ঘটেছে। এখান থেকে বের হতে হলে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন।'
ব্যাংকটি ধীরে ধীরে উন্নতি করছে উল্লেখ করে মিন্টু বলেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ব্যাংক গড়ে প্রতিদিন ২০-৩০ কোটি টাকা আমানত পেয়েছিল। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সেটি বেড়ে প্রতিদিন গড়ে ৪০-৫০ কোটি টাকা হয়েছে। চলতি জানুয়ারি মাসে তা আরও বেড়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কাছাকাছি চলে এসেছে। অর্থাৎ
আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের নভেম্বরে তারল্য সংকট মোকাবিলায় ছয়টি ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে ২২ হাজার ৫০ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সহায়তা পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক।
দায়িত্ব নেওয়ার পর গভর্নর বলেছিলেন, কোনো ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দেওয়া হবে না। পরে সেই অবস্থান থেকে তিনি সরে আসেন। তখন তিনি বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে টাকা উঠিয়ে সেই টাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে। তাই এটাকে পুরোপুরি টাকা ছাপানো বলা যায় না।'
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, ব্যাংকগুলোকে দেওয়া তারল্য সহায়তা ছাপা টাকার মতোই প্রভাব ফেলবে অর্থনীতিতে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে টাকা যা পাওয়া গেছে, তার থেকে বহুগুণ বেশি টাকা ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে।
এই ছয় ব্যাংক ছাড়াও পদ্মা ব্যাংক ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ও জনতা ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা চেয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত সেগুলোর অনুমোদন দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'এভাবে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হলে দায় বাড়তেই থাকবে। তাতে স্বল্প মেয়াদে কিছু সমস্যার সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে।'
২০০৯ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সিকদার গ্রুপের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল। দীর্ঘদিনের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার ২০২১ সালে মারা যান।
সিকদার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিবাদের জেরে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে। তার সময়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার আলোচনা শুরু হয়। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জের ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই আলোচনা আর এগোয়নি। এর মধ্যে ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়মে ধুঁকতে থাকা ন্যাশনাল তীব্র তারল্য সংকটে পড়ে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় এবং চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের প্রভাব থেকে মুক্ত করে।