ব্যবসার অদক্ষতা ঢাকতে ৩৭৭ কোটি টাকার লোকসান গোপন করেছে জনতা ব্যাংক
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ঋণপ্রদানকারী সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে বাজে পারফরমার- জনতা ব্যাংক ব্যবসায় অদক্ষতা ঢাকতে বিনিয়োগে ৩৭৭ কোটি টাকা লোকসান গোপন করে আর্থিক বিবৃতিতে একে পরিচালন ব্যয় হিসাবে দেখিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, দুর্বল ট্রেজারি ব্যবস্থাপনার কারণে গত বছরের প্রথম নয় মাসে ট্রেজারি বিল এবং বন্ডে বিনিয়োগ পুনর্মূল্যায়নের ফলে ব্যাংকটি ক্ষতির মুখে পড়ে, কিন্তু পরবর্তীতে নিয়মভঙ্গ করে একে পরিচালন ব্যয় হিসাবে উপস্থাপন করেছে।
ব্যাংকগুলোকে প্রতি সপ্তাহে বাজারমূল্যের ভিত্তিতে ট্রেজারি বিল এবং বন্ডে তাদের বিনিয়োগ পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়।
ব্যাংকিং বিধিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো এই পুনর্মূল্যায়নের ক্ষতি পরিচালন ব্যয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না। বরং এ ধরনের বিনিয়োগ-জনিত লাভ বা ক্ষতি রুপে তাদের আয় হিসাবে দেখাতে হবে।
এই আর্থিক কারচুপি চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সেকারণে ব্যালেন্স শিটে অ্যাকাউন্টিং এন্ট্রি প্রবিধান লঙ্ঘনের জন্য সম্প্রতি জনতা ব্যাংককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে।
কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে জনতা ব্যাংকও স্বীকার করেছে যে, পরিচালন ব্যয় হিসাবে দেখানো ক্ষতির অঙ্কটি আসলে পরিচালন ব্যয় নয়।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জনতা ব্যাংক ইতোমধ্যে দুইবার কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিলেও তাদের বক্তব্য স্পষ্ট করতে পারেনি। দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এজন্য জনতা ব্যাংককে অনিয়মের দায়ে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা করতে পারবে।
ব্যালেন্স শিটে আরও কারসাজি থাকতে পারে, এই সন্দেহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন জনতা ব্যাংকের লাভ-লোকসানের হিসাব নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
এ বিষয়ে জানতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুস সালাম আজাদের সঙ্গে মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
আর্থিক হিসাবের কারসাজির মাধ্যমে ব্যাংকটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২১৫ কোটি টাকা অস্থায়ী নিট মুনাফা হিসাবে দেখিয়েছে বলে জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য।
গত বছরের নয় মাসে ব্যাংকটির পরিচালনা ব্যয় বেড়েছে ১৪ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সমঝোতা স্মারক চুক্তি অনুসারে, পুরো বছরের জন্য পরিচালন ব্যয়ের নির্ধারিত সীমা ছিল ৬ শতাংশ। পরিচালন ব্যয়ের হিসাবে ক্ষতির অঙ্ক যোগ হওয়াতেই সেটি বৃদ্ধি পেয়েছে।
পরিচালন ব্যয়ে সমঝোতা চুক্তি নির্দেশিত সীমা লঙ্ঘনের জন্যও ব্যাংকটিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে জনতা ব্যাংকের ব্যাখ্যা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
তার উপর আবার, চলতি বছরের জানুয়ারিতেই ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরিচালন ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা সংশোধিত করে ৯ শতাংশ করার অনুরোধ জানায়। কিন্তু, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষটি ওই আবেদন নাকচ করে দেয়।
সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগে লোকসানের পাশাপাশি ব্যাংকটি গত বছর সুদের উপার্জনেও লোকসান দিয়েছে। কারণ তারা উচ্চ সুদে অধিক আমানত সংগ্রহ করলেও- তার বিপরীতে ঋণ থেকে কম আয় করেছে। এটিও তাদের ব্যবসা পরিচালনার অদক্ষতার সাক্ষ্য দেয়।
২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য থাকার পরও ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসে জনতা ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে ২২ শতাংশ। অথচ একই সময়ে ব্যাংকিং খাতে গড় আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ।
অন্যদিকে, ব্যাংকটির প্রদত্ত ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯.২৯ শতাংশ, যা এই সময়ে ব্যাংকিং শিল্পের গড় ৯.৫১ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির দ্বিগুণেরও বেশি।
উচ্চ ঋণ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ঋণ থেকে ব্যাংকের আয় কম হয়েছে, কারণ ৮৪ শতাংশ ঋণই ফোর্সড লোনে পরিণত হয়।
ফলাফল; ব্যাংকটি আমানতকারীদের বেশি দিলেও ঋণগ্রহীতাদের থেকে কম আয় করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, এর জেরে গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুদের আয়ে ক্ষতি হয়েছে ২০৪ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ২০১৯ সাল থেকেই ক্রমাগত খারাপের দিকে গেলেও ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রকদের সহনশীলতার সুযোগে ব্যালেন্স শিটে আর্থিক সূচকগুলোকে 'পজিটিভ' দেখিয়েছে।
সাময়িক সহনশীলতার সুযোগ পেয়েও গত বছরের প্রথম নয় মাসে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়ায় ১,৪১৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রক সহনশীলতা বিবেচনায় না নিলে প্রকৃত ঘাটতি হবে ১০,৬৫৫ কোটি টাকা।
ব্যাংকটি ২০১৯ সালে ১২,২৯৭ কোটি টাকা লোকসান দেয়। কিন্তু নিরীক্ষিত আর্থিক বিবৃতিতে ২৪ কোটি টাকার মুনাফা দেখায়।
এই বিপুল লোকসান সত্ত্বেও ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড ১১২ কোটি টাকার প্রণোদনা বোনাস অনুমোদন করেছে, যা তাদের কর্মচারীদের তিন মাসের মূল বেতনের সমান।
২০২০ সালে ক্ষতির পরিমাণ বাড়লেও ব্যাংকটি কর্মীদের পুরস্কৃত করার ব্যয় বন্ধ করেনি।
২০২০ সালে প্রভিশন ডিফারেলের সুবিধা পেয়েও জনতা ৫,০৫৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রভিশন ডিফারেল নেওয়ার অনুমতি না পেলে ব্যাংকটির লোকসান হতো ১২,৫৬৭ কোটি টাকা।