২০২২-২৩ অর্থবছর বাজেট: বিশ্বব্যাপী সংকট সত্ত্বেও উচ্চতর প্রবৃদ্ধির দিকে নজর সরকারের
রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যু্দ্ধ পরিস্থিতিতে খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা এবং দেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে মন্দার পূর্বাভাস সত্বেও আগামী অর্থবছরে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
একই সঙ্গে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখনকার তুলনায় নতুন অর্থবছর বেশ কমে আসবে বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৫ শতাংশ নির্ধারণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ হলে এবং নতুন করে দেশে কোভিড পরিস্থিতির অবনতি না হলে লক্ষমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা অর্জনে এক্সপেনশনারি ফিসক্যাল পলিসি অনুসরণ করার পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কমর্সূচিতে বাড়তি ব্যয়ের পরিকল্পনা করছেন তারা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে, যা সংশোধিত বাজেটেও অপরিবর্তিত থাকছে। মূলত, আমদানি-রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবাখাতে চাঙ্গাভাব ফিরে আসা, কৃষিখাতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকার পাশাপাশি বাড়তি রাজস্ব আয়ের কারণে এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এছাড়া, নতুন অর্থবছরে রপ্তানির প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি দেশের শিল্প ও কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। চলতি অর্থবছর জনশক্তি রপ্তানিতে ৩৭৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ায় খুব শীঘ্রই রেমিটেন্স প্রবাহেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি আশা করছেন তারা।
তবে যুদ্ধ প্রলম্বিৎ হলে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বড় প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি লক্ষমাত্রার তুলনায় কম হওয়ার আশঙ্কার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে তেল ও খাদ্যপণ্যসহ পণ্যবাজার সার্বিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী থাকায় সামনের দিনগুলোতে উন্নয়ন ব্যয়সহ সরকারের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
তবে গত নভেম্বরে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষমাত্রা বাড়িয়ে ৫.৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন ছিল ৫.৩ শতাংশ।
তবে, অর্থমন্ত্রণালয়ের এই প্রক্ষেপণের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান হলে আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বাড়বে, তবে ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন তারা।
এমনকি চলতি অর্থবছরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা খুবই কম উল্লেখ করে তারা বলেন, গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৪ শতাংশ, দুই মাস পরে তা কিভাবে বেড়ে ৬.৯৪ শতাংশে উন্নীত হলো, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, ফেব্রুয়ারি শেষে ১২ মাসের গড় ভিত্তিক সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৫.৬৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছর শেষে ৫.৭ শতাংশে সীমিত রাখতে হলে আগামী মাসগুলোতে ইয়ার টু ইয়ার ইনফ্লেশন রেট ৬ শতাংশের নিচে রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক মূল্য পরিস্থিতিতে জ্বালানি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি ও কাঁচামালও খাদ্যপণ্যের দাম সাহসাই কমবে- এমন ধারণা করার ভিত্তি নেই।
পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট, গ্যাস, ইলেকট্রিসিটিসহ বাংলাদেশে কিছু ডমেস্টিক স্স্ট্র্যাটেজিক আইটেম রয়েছে, যা ইনফ্লেশন বাড়াতে ভূমিকা রাখে। ইতোমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে গণশুনানী হয়েছে এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোরও প্রস্তাব রয়েছে। এসবের ট্যারিফ বাড়লে মূল্যস্ফীতি কিভাবে কমবে?- প্রশ্ন রাখেন তারা।
চলতি অর্থবছর ৬ শতাংশের কাছাকাছি এবং আগামী অর্থবছর ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে উল্লেখ করে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "রপ্তানি বাড়ার পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে বাড়তি প্রবৃদ্ধি হবে, এমনটি আশা করা যায় না।"
"আবার ফেব্রুয়ারিতে ক্রেডিট গ্রোথও কমে গেছে। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আগামী বছর বিনিয়োগ থেকে বড় ধরণের প্রবৃদ্ধি আসবে বলে মনে হয় না। ভোক্তা ব্যয় বাড়ছে মূলত ইনফ্লেশনের কারণে। তাই ভোক্তার প্রকৃত ব্যয় বাড়েনি। সরকারি ব্যয়ও খুব একটা বাড়েনি। রেমিটেন্স প্রবাহও আগের অর্থবছরের তুলনায় এবার কমে গেছে, যা ভোক্তার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করছে। এ পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছর অ্যারাউন্ড ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং কোভিড পরিস্থিতির অবনতি না হলে আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হওয়া স্বাভাবিক।
"রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান হলেও ইউরোপের মন্দার ঝূঁকি রয়েছে, যা আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে। এবছর জনশক্তি রপ্তানি অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন বছর রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়বে। সার্বিক পরিস্থিতিতে ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে," যোগ করেন জাহিদ হোসেন।
আগামী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন সম্পর্কে তিনি বলেন, আগামীতে টাকার আরও অবমূল্যায়ন প্রয়োজন হতে পারে, যা ইনফ্লেশন উস্কে দেবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান হলে জ্বালানি তেলের দাম কমবে।
কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কমে গেলেও সরকার দেশে দাম সমন্বয় করেনি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমবে, তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়বে।
"আগামী অর্থবছর ইনফ্লেশন ৫.৫ শতাংশে এ নামবে কি-না, তা নির্ভর করে ইন্টারব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেট ও সরকারের নেওয়া নীতি-সিদ্ধান্তের উপর," জানান তিনি।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলন সম্পর্কে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "এখনও অনেক সময় আছে। সামনে কি হয়, তা তো বুঝা যায় না। পরিস্থিতি যদি এরকম থাকে, তাহলে এসব লক্ষমাত্রা কোনমতেই অর্জন করা সম্ভব হবে না। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে লক্ষমাত্রা অর্জন করা মোটেও অসম্ভব হবে না।"
যুদ্ধের প্রভাব ছাড়া ভবিষ্যতের সামগ্রিক চিত্রই ইতিবাচক
রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া ও রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির আশঙ্কা ছাড়া অর্থনীতির বাকি সব সূচকই ইতিবাচক বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে যে মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, তাকে 'উদ্বেগজনক' বলে উল্লেখ করেছে অর্থ বিভাগ।
'রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট দীর্ঘায়িত হলে এবং নতুন করে বিশ্বব্যাপী করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হলে আমাদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও শ্রমবাজার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে'- এমন এক আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে অর্থবিভাগের তৈরি করা এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।
উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা তুলে ধরে অর্থবিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'চাহিদার দিক থেকে প্রবৃদ্ধি সঞ্চালকগুলোর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি, কৃষিঋণ বিতরণ ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানিসহ সার্বিক ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি রয়েছে। বেসরকারিখাতে ঋণপ্রবাহ, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে'।
অর্থবিভাগ বলেছে, দেশে কোভিড সংক্রমণের প্রথম ওয়েভ (এপ্রিল-মে ২০২০) এর সময়ে শিল্প উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। কিন্তু ওই বছরের জুলাই থেকেই পরিস্থিতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়।
২০২১ এর মে-জুলাই সময়ে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ওয়েভের সময় শিল্প উৎপাদন কিছুটা স্তিমিত হলেও প্রি-প্যান্ডেমিক লেভেলের উপরে ছিল। এখন ম্যানুফ্যাকচারিংখাত কোভিডের ক্ষতি সামলে নিয়ে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে এসেছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পের উৎপাদন সূচকে উল্লেখযোগ্য উলম্ফন ঘটেছে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় জিডিপির প্রবৃদ্ধির ঊধ্বর্মুখী বর্তমান অর্থবছরে এবং আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে উল্লেখ রয়েছে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে।
চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০.৮৬ শতাংশের বেশি, এই সময়ে আমদানি বেড়েছে ৪৬.২১ শতাংশ। তবে আমদানি ব্যয়ের মধ্যে পেট্রোলিয়াম ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামীতে বাড়তি প্রবৃদ্ধির আশা করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ৪২.৮১ শতাংশ ও জুলাই-জানুয়ারি সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার বেড়েছে ৫১ শতাংশেরও বেশি।
গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪৮ শতাংশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রায় ২৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের বাকি সময়েও প্রধান দুই বাজারে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
মুদ্রা বিনিময় হারের সাম্প্রতিক প্রবণতা তুলে ধরে অর্থবিভাগ বলেছে, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের কিছুটা ডিপ্রেসিয়েশন হয়েছে। গত মার্চ শেষে এই হার ছিল ডলার প্রতি ৮৬.২০ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৪.৮০ টাকা; তবে এটি উদ্বেগজনক নয়।
বর্তমান অর্থবছরে ইউরোর বিপরীতে টাকা কিছুটা শক্তিশালী হচ্ছে। চলতি মার্চ শেষে ইউরোর বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ৯৪.৬৫ টাকা, গতবছর একই সময়ে এটি ছিল ১০১.০৬ টাকা।