কোভিড সংকটে বিপর্যস্ত ব্র্যান্ড ‘মোদি’
যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমস পত্রিকা সম্প্রতি এক শিরোনামে লিখে, "ভারতকে লকডাউন থেকে বের করে কোভিড মহাপ্রলয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন মোদি।"
অস্ট্রেলিয়ার একটি পত্রিকা কঠোর ভাষার সারাংশ যুক্ত করে সংবাদটি পুনরায় ছাপে। পত্রিকাটি লিখে, "দম্ভ, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং অদক্ষ আমলাতন্ত্র মিলিতভাবে একটি বড় ধরনের সংকটের সৃষ্টি করেছে। জনগণের দম যখন আক্ষরিকভাবেই বন্ধ হয়ে আসছে তখন ভিড়-প্রেমী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রোদ পোহাচ্ছেন বলে মন্তব্য সমালোচকদের।"
ভারতে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে এই সংবাদ। তবে, প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির সযত্নে লালিত ভাবমূর্তিতে যে কালিমা লেগেছে তা অনস্বীকার্য।
কোভিড-১৯ মহামারির আঘাতে বিধ্বস্ত ভারত এখন বিশ্ব সংবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দখল করেছে। নিবিড় পরিচর্যা ও চিকিৎসার অপেক্ষায় ধুঁকতে থাকা মানুষ বাঁচার জন্য সামান্য নিঃশ্বাস নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে শুরু করে ডাক্তারের সাক্ষাৎ পর্যন্ত সবকিছুর জন্যই মরিয়া হয়ে ছুটছেন স্বজনরা। মৃতের সংখ্যা এত বেশি যে অন্তিম ক্রিয়ার ব্যবস্থা করতে পার্কগুলোকে শ্মশানে রূপান্তর করে চলছে গণদাহ।
ভারতের চলমান বিপর্যয়ের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে মোদিকেই দায়ী করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি প্রায়শই নিজেকে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তুলে ধরতেন। অথচ এখন ভারতের দৈনিক সংক্রমণ সংখ্যা যখন রোজ পূর্বের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে তখন নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করতেই হিমশিম খাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি।
'চিড় ধরেছে মুখোশে'
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিলন বৈষ্ণব বলেন, "দক্ষতা মোদির সবথেকে বড় গুণ হয়ে থাকলেও অনেকেই এখন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সরকার যে কেবল অদক্ষ এবং কোনো কিছুই আমলে নেয়নি তা নয়, বরং সক্রিয়ভাবে তারা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।"
বিশ্ব নেতাদের মধ্যে মোদি একাই কোভিড ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়েছেন এমন নয়। কিন্তু মোদির পতন হয়েছে সশব্দে। মিলন বৈষ্ণব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেয়ার বোলসোনারোর মতো তিনি কোভিডকে অস্বীকার করতেন না। কিন্তু, বহু সতর্কবার্তা সত্ত্বেও তিনি বর্তমান বিপর্যয়কে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন।
গঙ্গার ধারে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা কুম্ভমেলায় মোদি লাখ লাখ মানুষকে জমায়েতের অনুমতি দেন। তিনি পশ্চিম বাংলায় এক মাস ব্যাপী দীর্ঘমেয়াদী নির্বাচনের প্ররোচনা দেন। পাশাপাশি মাস্ক পরিধান ব্যতীত বিশাল জনসমাগমপূর্ণ নির্বাচনী পরিচালনা চালান।
জনপ্রিয় নেতা এবং দক্ষ প্রশাসক হিসেবে মোদির সুপরিচিতির ক্ষয় শুরু হয় ২০১৬ সালে। সেবছর কালো টাকা দূর করতে তিনি ভারতীয় রূপি বাতিল করেন। নগদ অর্থে লেনদেনের উপর নির্ভরশীল লাখো মানুষ হঠাৎ করেই সংকটের সম্মুখীন হয়। এছাড়া, গত বছর তিনি কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে ঘোষণা ছাড়াই হুট করে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেন। কিন্তু ফলস্বরূপ লাখ লাখ মানুষ কাজ হারায়। মানুষের প্রাণহানিও থেমে থাকেনি। ভারতের অর্থনীতি এখন পর্যন্ত এই ধাক্কা সামলে উঠেনি।
প্রতিবারই মোদির যুক্তি ছিল তিনি বৃহত্তর স্বার্থে এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সর্বশেষ দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে তিনি যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার ব্যখ্যা দেওয়া কঠিন বলে মন্তব্য করেন ফরেন পলেসির এডিটর ইন চিফ রবি আগারওয়াল।
"আপনি জিডিপির মতো সংখ্যা সম্পর্কে ব্যখ্যা দিতে পারে, কিন্তু আপনি ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে কোনো ব্যখ্যা দাঁড় করাতে পারবেন না," বলেন তিনি।
আগারওয়াল আরও বলেন, "ভারতীয়রা সবসময় বিশ্বাস করে এসেছে যে মোদি ভুল করলেও সর্বদা তাদের পক্ষে লড়াই করেন।" কিন্তু এবার মানুষ মোদির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
"একটা চিড় দেখা দিয়েছে। এই চিড় সহজেই দৃশ্যমান। চিড়টা হলো মোদির মুখোশে," বলেন তিনি।
মোদির ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধার কি সম্ভব?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিলন বৈষ্ণব বলেন, "মোদি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ব্যতিক্রমী ও আগেও নিজের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন।"
"এই লোক এর আগেও কাদা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তার বিষয়ে আমি নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারব না," বলেন দ্য ইকোনমিস্টের ভারত বিষয়ক সংবাদদাতা অ্যালেক্স ট্রাভেলি।
সরকার ইতোমধ্যে ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধারের কাজে লেগে গেছে। নেতিবাচক সংবাদ প্রচারকারী গণমাধ্যমগুলোর প্রতি সরকার ক্ষুদ্ধ। বিরোধীদলীয় নেতাদের সাথেও বিবাদে জড়িয়েছে তারা। সরকারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে যারা টুইটারে সমালোচনা করেছে তাদের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মোদি প্রশাসন।
সরকারের দাবি অনুযায়ী, ভারতকে হেয় প্রতিপন্ন করতে সবই 'বিদেশি ষড়যন্ত্র'। নেতিবাচক পোস্টগুলোকে ইতোমধ্যেই তারা টুইটার থেকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। এরপর টুইটার ব্যবহার করেই সমর্থকরা মোদির নেতৃত্বের গুণগান খেয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে।
ট্রাভেলি বলেন, "মহামারির শুরুতে মোদি জানতেন যে তিনি ভারত এবং বিশ্বের সামনে কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চান। তিনি নিজেকে গণমানুষের নেতৃত্ব দানকারী জেনারেলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সেরকম কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরিস্থিতি তার নেই। এমনকি ক্ষমা কিংবা সাহায্য প্রার্থনা করার মতো কোনো ইচ্ছাও নেই মোদির।"
ক্ষমতায় আসার পর মোদি মাত্র কয়েকবার সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি কোনো প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করেননি। এমনকি করোনা পরিস্থিতিতেও নয়।
"তিনি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চান না," বলেন সাংবাদিক ও মোদির জীবনী লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু ভারতের দরিদ্র, বিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত এমনকি সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ যারা কেউ স্বাস্থ্যখাতের এই বিশাল ফাঁদ এড়িয়ে বাঁচতে পারেননি, তাদের সবার মনে এখন একই প্রশ্ন। এমনকি, মোদির দলের বিশ্বস্ত কর্মীরাও এই প্রশ্নের উত্তর চান। যে প্রশ্নটি কাউকে সস্তি দিচ্ছে না তা হলো- প্রধানমন্ত্রী এরকম একটি বিপর্যয় কীভাবে ঘটতে দিলেন?
সূত্র: বিবিসি