ডেল্টা প্লাস প্রকরণ: ভারত কি তৃতীয় ঢেউ প্রতিরোধ করতে পারবে?
এপ্রিল ও মে মাসে কোভিড মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলে পুনরায় স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে প্রতিবেশি দেশ ভারত। তবে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই দেশটিতে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজ্য সরকারগুলোর প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের আদালত। আগামী ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহের মধ্যেই তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানবে জানিয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছেন বেশ কয়েকজন গবেষক। এছাড়া, নতুন প্রকরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বিশেষত, বহুল আলোচিত ডেল্টা প্লাস প্রকরণের কারণে বিদ্যমান ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা হ্রাস পাবে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বছর ভারতে প্রথম চিহ্নিত হওয়া কোভিডের ডেল্টা প্রকরণকে প্রাণঘাতী দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে। ডেল্টা প্লাস ধরনটিও ডেল্টা প্রকরণের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
কিন্তু, নতুন এই আশঙ্কা কতটুকু বাস্তব? পরবর্তী ঢেউ আসার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু, তাদের তীব্রতা এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি একাধিক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল।
কোভিড সুরক্ষা প্রটোকল
মে মাসে ভারতে দৈনিক শনাক্ত সংখ্যা চার লাখ স্পর্শ করলেও সম্প্রতি দৈনিক শনাক্ত সংখ্যা গড়ে ৫০ হাজারে নেমে এসেছে। বিভিন্ন রাজ্যে কঠোর লকডাউনের কারণে মূলত সংক্রমণ সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাজার ও দোকানপাটে ভিড়, নির্বাচনী প্রচারণা, এবং ধর্মীয় উৎসবকে দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে। এর বাইরে, দুর্বল নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত, দুর্বল নজরদারি এবং পূর্ব সতর্কবার্তা এড়িয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণেই দ্বিতীয় ঢেউ তীব্রতা ধারণ করে। একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করা হলে, তৃতীয় ঢেউ শুরু হতে সময় লাগবে বলে মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পাবলিক পলিসি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ড. চন্দ্রকান্ত লাহারিয়া বলেন, ভারত পুনরায় ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে এবং পরবর্তী ঢেউয়ের পরিণতি কী হবে তা বহুলাংশেই মানুষের আচরণের ওপর নির্ভর করছে।
রাজ্যগুলোর ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় চালু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
"আমরা যদি হুট করে সব চালু করে দেই এবং মানুষ কোভিড সুরক্ষা বিধিমালা মেনে না চলে, তাহলে, ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ বৃদ্ধি লাভ আরও সহজ হবে," বলেন তিনি।
তিনি "স্থানীয় পর্যায়ে" সুরক্ষা বিধিমালা বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন। পাশাপাশি, কোনো বাজার বা ব্যবসায়ীরা নির্দেশনা না মানলে তাদের ওপর জরিমানা আরোপ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নতুন প্রকরণ কি ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে?
দ্বিতীয় ঢেউয়ের পেছনে ডেল্টা প্রকরণের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঝুঁকিপূর্ণ এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাইরাসের সঞ্চালন অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও নতুন সব প্রকরণের উদ্ভব হবে।
ভারত সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ডেল্টা প্লাস নামে নতুন কোভিডের নতুন ধরনটি, "চিন্তিত হওয়ার মতো একটি প্রকরণ"। তবে নতুন এই প্রকরণ তৃতীয় ঢেউ সৃষ্টি করবে কিনা, তা বলার মতো পর্যাপ্ত তথ্য এই মুহূর্তে নেই।
তবে, "কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে" দৃশ্যপট পাল্টে যাবে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
এপিডেমিওলজিস্ট ড. ললিত কান্ত বলেন, ভাইরাস যতক্ষণ ধরে ছড়াতে থাকবে ততক্ষণ নতুন প্রকরণের সৃষ্টির মাধ্যমে অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে।
"আমাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আগে থেকেই নতুন প্রকরণ শনাক্ত করতে সিকুয়েন্সিংয়ের প্রতি জোর বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ নিতে হবে," বলেন তিনি।
জুন অবধি ভারত ৩০ হাজার নমুনা নিয়ে সিকুয়েন্সের কাজ করেছে। তবে, বিশেষজ্ঞদের ধারণা গবেষণার ওপর আরও বেশি জোর প্রদান করা প্রয়োজন।
হাজারো কোভিড রোগির চিকিৎসা করেছেন ড. এ ফাতাহুদিন। তিনি বলেন, বর্তমানে বিদ্যমান ভ্যাকসিনগুলো পরিচিত প্রকরণের বিরুদ্ধে কাজ করে। তবে, নতুন প্রকরণের ওপর সেগুলো কাজ করবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এছাড়া, ভ্যাকসিন গ্রহণের পরেও বহু মানুষের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণ আছে। বিশেষ করে, প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণের পর বহু মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আরেকটি ঢেউয়ের আগমনকে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে করেন ফাতাহুদিন। "তবে, আমরা সিকুয়েন্সিংয়ের মতো যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে, ভাইরাসের অভিযোজনের প্রতি নজর রেখে এবং কঠোর নিরাপত্তা বিধান জারি করার মাধ্যমে বিষয়টিকে সীমিত রেখে বিলম্ব সৃষ্টি করতে পারি," বলেন তিনি।
"তা না হলে, তৃতীয় ঢেউ এতো দ্রুত আমাদের গ্রাস করবে, যা আমাদের কল্পনার বাইরে," মন্তব্য করেন তিনি।
ভ্যাকসিন সুরক্ষা এবং পূর্বে আক্রান্ত হওয়া কি যথেষ্ট?
ভ্যাকসিন এবং পূর্ববর্তী সংক্রমণের কারণে বর্তমানে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ ক্ষমতা কীরূপ তার ওপর তৃতীয় ঢেউয়ের ফলাফল নির্ভর করছে। গত ৯ জুন থেকে ২২ জুনের মধ্যে দেশটিতে দৈনিক গড়ে সাড়ে ৩২ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।
তবে, ২০২১ সালের শেষ নাগাদ নির্ধারিত জনগোষ্ঠীর টিকাদান সম্পূর্ণ করতে গড়ে দৈনিক ৮৫ থেকে ৯০ লাখ টিকাদান প্রয়োজন।
মাত্র ৪ শতাংশের কিছু বেশি ভারতীয় পূর্ণাঙ্গ টিকা গ্রহণ করেছেন। এছাড়া, এখন পর্যন্ত এক ডোজ গ্রহণ করা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ১৮ শতাংশ।
ড. লাহারিয়ার মতে, পূর্ববর্তী সংক্রমণ থেকে প্রাপ্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা মানুষকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেও দ্রুত টিকাদান বৃদ্ধি করা না হলে লাখো মানুষ ঝুঁকিতেই থেকে যাবে।
তবে, ভারতীয়দের মধ্যে কতজন ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে প্রাকৃতিক ভাবে সুরক্ষা অর্জন করেছে তা নির্ণয় করা কঠিন। শহর, মফস্বল এবং গ্রামে বহু মানুষ পরীক্ষা করতে হিমশিম খেয়েছে এবং তারা আক্রান্ত হয়েছিলেন কিনা তা জানার উপায় নেই। এমনকি কোভিডের মৃত্যুর রেকর্ডও পূর্ণাঙ্গ নয়। ড. লাহারিয়ার মতে, আক্রান্ত হয়ে প্রাকৃতিক সুরক্ষা অর্জনকারীর সংখ্যা ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ।
অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং গাণিতিক মডেলার গৌতম মেননের মতে, তা আরও বেশি। গৌতম মনে করেন এই সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের কাছাকাছি হবে। তার আত্মবিশ্বাস, ভারতকে দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বার যেতে হবে না ।
তবে, আত্মতুষ্টিতে ভোগা নিয়েও সতর্ক করেন তিনি।
"ইতোমধ্যে আমাদের জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আক্রান্ত হলেও এখনো ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হননি। এর মধ্যে, বয়স্ক কিংবা দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষও আছেন। সুতরাং, সংক্রমণ উত্থান দ্রুত চিহ্নিত করতে আমাদের নজরদারির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত," বলেন তিনি।
- সূত্র: বিবিসি