নতুন স্নায়ুযুদ্ধ আমেরিকাকে লড়তে হবে দুই ফ্রন্টে
ইউরোপের মাটিতে আরও একবার শীতনিদ্রা ভেঙে জেগে উঠেছে স্নায়ুযুদ্ধের দৈত্য। একদিকে রাশিয়া, অন্যদিকে আমেরিকা ও তার ইউরোপিয় মিত্রদের নিয়ে গঠিত সামরিক জোট ন্যাটো—একে-অন্যকে টক্কর দিতে প্রস্তুত দুই পক্ষই। কিন্তু, এবারের স্নায়ুযুদ্ধ ২০ শতকের মতো নয়, এতে নিশ্চিতভাবেই থাকছে দ্বিতীয় ফ্রন্ট।
পশ্চিমাদের দাবি, পুতিন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে ইউরোপ মহাদেশে প্রভাব বলয়ের এ লড়াইকে ফিরিয়ে এনেছেন। অন্যদিকে, ক্রেমলিন বরাবর বলে আসছে, ন্যাটোর আগ্রাসী আচরণেই তারা আজকের অবস্থানে আসতে বাধ্য হয়েছে। সত্য এখানে আপেক্ষিক- আসল কথা, মস্কো এবার একা নয়। ক্রেমলিন-বান্ধব চীন একবিংশ শতকের স্নায়ুযুদ্ধে যোগ করছে নতুন সমীকরণ।
বেইজিং ও মস্কোর দ্বৈত চ্যালেঞ্জ নিয়েই এখন মাথা ঘামাচ্ছেন পশ্চিমা দেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশারদ ও নীতি-নির্ধারকরা। তারা ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জোট গড়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় উদ্যমী হয়েছেন। পশ্চিমাদের মিত্র কিছু এশীয় দেশও জোট গঠনে নিচ্ছে সাহসী সিদ্ধান্ত, যারা কিনা মার্কিন সমর্থনে এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করতে চায়। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে ইউরোশিয়া জুড়ে গড়ে ওঠা চীন-রাশিয়া মিত্রতা, একটি কর্তৃত্ববাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এশিয়ায় পশ্চিমাপন্থী এ জোটের শক্তিশালী সদস্য হিসেবে উদয় ঘটছে- দক্ষিণ কোরিয়ার।
গত সপ্তাহে দ. কোরিয়ায় জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ইয়ুন সুক-ইয়োল। কট্টর চীন-বিরোধী এ নেতার জয়ে উৎফুল্ল ওয়াশিংটন। ইয়োলের পূর্বসূরি মুন জায়ে ছিলেন মধ্যপন্থী। তিনি বরাবর আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি, চীনের সাথেও ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। 'কৌশলগত অস্পষ্টতা'র এ নীতি ছিল তার দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীনকে বিরূপ না করে তোলার জন্যই। ব্লু-হাউজে ইয়োলের পদার্পণ সে নীতি থেকে সিউলকে সরাবে, এমন আশাবাদ স্পষ্ট, পশ্চিমা গণমাধ্যমের নির্বাচন বিশ্লেষণে।
ইয়োল নিজেও তেমন বার্তা দিয়েছেন। তিনি "কৌশলগত স্বচ্ছতা"র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যার অর্থ- আমেরিকা ও জাপানের সাথে পররাষ্ট্রনীতির ঘনিষ্ঠ সমন্বয় এবং আরও হতে পারে চীন-বিরোধী কোয়াড জোটে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান। বর্তমানে কোয়াডের অপর দুই সদস্য- ভারত ও অস্ট্রেলিয়া।
ঘরের কাছের প্রতিবেশীদের বৈরিতা বাড়ায় চীনও সতর্ক হয়ে উঠছে। গণচীনের পার্লামেন্ট- ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের চলমান অধিবেশনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই অ্যামেরিকার প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, "নিজ আধিপত্য ধরে রাখতে ওয়াশিংটন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক জোট গড়ার চেষ্টা করলে, তার পরিণাম শুভ হবে না।"
দ. কোরিয়ার ডানপন্থী নতুন প্রেসিডেন্টের কথা বাদ দিলে, এশিয়ায় ন্যাটোর আদলে সমর জোট গঠনের আগ্রহ অধিকাংশ দেশের নেই। কেউই ওয়াশিংটন বা বেইজিং—সরাসরি এক শিবিরে নাম লেখাতে চায় না।
বেশিরভাগ এশীয় দেশ অ্যামেরিকার কাছে চায় নিরাপত্তা গ্যারান্টি; আবার অর্থনীতির বিকাশের স্বার্থে চায়- চীনের সাথে সুসম্পর্ক। আর না চাওয়ারও কিছু নেই; চীনের অর্থনীতি যে ভৌগলিক আয়তনে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়ার চেয়েও ১০ গুণ বড়।
সামরিক জোট গঠনে আমেরিকা চেষ্টায় কোনো কমতি রাখেনি। তবে তা চলছে অনেক আগে থেকেই। সেই ১৯৭০ এর দশকেই এশিয়ায় ন্যাটো আদলের সামরিক জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়ে প্রথমবার ব্যর্থ হয় আমেরিকা।
এই ব্যর্থতার বড় কারণ; ইউরোপের তুলনায় এশীয় জাতিগুলোর মধ্যেকার (রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির) আঞ্চলিক ভিন্নতাও প্রচুর। একে-অপরের সাথে তাদের সম্পর্কও বেশ জটিল সমীকরণে চলে।
তারপরও, ইয়ুন সুক-ইয়োলের বিজয়কে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা কাঠামোতে বড় রদবদল আসার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছে পশ্চিমা দুনিয়া। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা একে ইতিবাচক উল্লেখ করে দাবি করছেন, এশিয়ায় মাঝারি ধরনের শক্তির অধিকারী দেশগুলো, প্রতিবেশী বড় শক্তির দেশের 'দাদাগিড়ি' মানতে চায় না। দ. কোরিয়ার জনমতে তার প্রতিফলন দেখা গেছে।
চীনের আধিপত্য দমাতে আমেরিকা ও ব্রিটেন থেকে পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন কিনছে অস্ট্রেলিয়া। ক্যানবেরা- বেইজিং সম্পর্কও অবনতির দিকে। আবার শক্তিশালী প্রতিবেশীর হাত থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে নৌশক্তিতে বলীয়ান হচ্ছে ভিয়েতনাম। এখানেও পশ্চিমা কূটনীতি সফলতা পাচ্ছে বলা যায়। তাদের চাপেই ফ্রান্সের তৈরি রাফায়েল ও আমেরিকার এফ-১৫ ফাইটার জেট কেনার চুক্তি করেছে ইন্দোনেশিয়া।
মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা হাল ছাড়ার পাত্র নন। তারা কৌশলে এশিয়ায় চীনবিরোধী আঞ্চলিক জোটে অন্যান্য দেশকে ভেড়ানোর সব উপায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এশীয় দেশগুলোর সাথে আমেরিকার জোট গঠনের মডেলকে 'হাব অ্যান্ড স্পোক' কাঠামোর বলা হয়। যেখানে কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে, প্রত্যেক মিত্রের সাথে আলাদা আলাদাভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে ওয়াশিংটন। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এভাবেই দক্ষিণ কোরিয়ার একনায়ক পার্ক চুং-হি এবং তাইওয়ানের চিয়াং কাইশেকের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেছে। কিন্তু, দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রে এবার একনায়ক নির্ভরতা কমার ইঙ্গিত মিলছে।
এশিয়ার গণতন্ত্রগুলোকে সমর্থনের মডেল নিয়ে এগোচ্ছে আমেরিকা। একারণে তাইওয়ান নিয়ে চীনের সাথে উত্তেজনা বাড়ছে পশ্চিমা দেশগুলো ও তাদের এশীয় মিত্রদের। দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে উঠছে দুই পক্ষের নৌশক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র। চীনের প্রতি ঐতিহাসিকভাবে বিরূপ মনোভাবের অস্ট্রেলিয়া ও জাপানও সম্প্রতি একটি দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। চুক্তিটি আনুষ্ঠানিক জোট গঠনের না হলেও, এতে যোগ দিতে পারে সমমনা পশ্চিমাপন্থী অনেক এশীয় দেশ। আর সে আশাতেই আছে ওয়াশিংটন।
মার্কিন নীতি-নির্ধারকরা জানেন, দুই ফ্রন্টের নয়া-স্নায়ুযুদ্ধে জিততে প্রতিবেশীদেরই চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে হবে। আর ইউরোপে রাশিয়াকে ঠেকাতে তাদের সহযোগী হবে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো। এই কৌশলের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপরই বৈশ্বিক রাজত্বে জয়-পরাজয়ের বাজি ধরছে সাবেক স্নায়ুযুদ্ধের বিজয়ী শক্তিটি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ অবলম্বনে