আমেরিকায় গর্ভপাতের অধিকার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
গত সোমবার (২ মে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ ওয়েবসাইট পলিটিকো-এর এক খবরে জানা গেছে, দেশটির সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতের অধিকার বিষয়ক ১৯৭৩ সালের রো বনাম ওয়েড মামলার রায় বদল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট একটি প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করেছেন। পুরনো রায় অনুযায়ী মার্কিন নারীদের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গর্ভপাতের অধিকার ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের গর্ভপাত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই সুপ্রিম কোর্টের নতুন সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে আসার পর দেশটিতে এ্রর প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। কিন্তু তার আগে জেনে নেওয়া যাক রো বনাম ওয়েড মামলার বিষয়ে।
রো বনাম ওয়েড মামলা
১৯৭৩ সালের রো বনাম ওয়েড মামলার রায়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ওই রায়ের মাধ্যমে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের মধ্যে গর্ভপাতকে নারীর সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা দেন তৎকালীন সুপ্রিম কোর্ট। রায়টি কেবল 'রো' হিসেবেও পরিচিত।
টেক্সাসে নর্মা ম্যাককর্ভি নামক ২২ বছর বয়সী একজন বেকার গর্ভবতী তরুণী গর্ভপাতের চেষ্টা করেন। কিন্তু টেক্সাসে তখন ভ্রূণহত্যা অবৈধ ছিল। কেবল মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য হলে গর্ভপাত করা যেত। ম্যাককর্ভি তখন জেন রো ছদ্মনামে আদালতের দ্বারস্থ হন।
রো'র আইনজীবীরা আদালতকে জানান, রো'র পক্ষে টেক্সাসের বাইরে গিয়ে গর্ভপাত করানো সম্ভব নয়, এবং গর্ভপাত নিষিদ্ধ বিষয়ক টেক্সাসের আইনটি অতি অস্পষ্ট এবং এটি রো'র সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থি।
হেনরি ওয়েড ছিলেন টেক্সাসের ডালাস কাউন্টির ডিসট্রিক্ট অ্যাটর্নি, ও এ মামলার বিবাদী। সেজন্য মামলাটি রো বনাম ওয়েড নামে পরিচিতি পায়। সেবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার দল রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হ্যারি ব্ল্যাকমানের আদালতে জেন রো'র পক্ষে ৭-২ ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রায় প্রকাশ করা হয়।
জেন রো-এর ওই মামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের কেবল চারটি রাজ্যে গর্ভপাত বৈধ ছিল। ১৬টি রাজ্যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে গর্ভপাতকে বৈধতা দেওয়া হতো। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর বাকি ৩০টি রাজ্যে গর্ভকালের প্রথম তিনমাসের মধ্যে গর্ভপাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
তবে ওই রায়ে নারীর স্বাস্থ্যের যেন ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার কথাও উল্লেখ ছিল। তাই কোনো রাজ্য চাইলে গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক সময়ে গর্ভপাতের ক্ষেত্রে নারীর স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ আরোপ ও তৃতীয় ত্রৈমাসিক সময়ে ভ্রূণের জীবন বাঁচাতে পদক্ষেপ নিতে পারত।
কেন এত বিতর্ক?
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যামুয়েল অ্যালিটো '১ম ড্রাফট' নামের এই খসড়াটি লিখেছেন। সেখানে বলা হয়েছে ১৯৭৩ রো বনাম ওয়েড রায়টি 'শুরু থেকেই গুরুতরভাবে ভুল' ছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আদালতের এ খসড়ার যদি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়, তাহলে নাগরিকদের আরও অনেক স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। 'আমাকে বেশি ভাবাচ্ছে এ বিষয়টি যে ৫০ বছর পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি পছন্দ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর কোনো অধিকার থাকবে না,' বলেন তিনি।
তবে এটিই চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নয়। আদালতের এ বিষয়ক মতামত পরিবর্তিত হতে পারে। তবে রো বনাম ওয়েড রায়ের বদল ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেকের মতো রাজ্য গর্ভপাত নিষিদ্ধ করতে পারে।
দেশটির প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস এক বিবৃতিতে খসড়াটি ফাঁস হওয়ার ঘটনাকে 'একটি একক ও গুরুতর লঙ্ঘন' বলে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের মার্শালকে তদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন।
যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা প্রদান করা মার্কিন অলাভজনক সংস্থা প্ল্যানড প্যারেন্টহুড জানিয়েছে তারা 'নিরাপদ ও বৈধ গর্ভপাতের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে'। এ সংস্থার দেওয়া গবেষণা-তথ্যমতে, বর্তমান রায়ের পরিবর্তন হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ নারী গর্ভপাত করানোর সুযোগ হারাবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লিবারেল শীর্ষনেতারা বলছেন রো বনাম ওয়েড রায়ের ব্যত্যয় ঘটালে তাতে আমেরিকান সমাজব্যবস্থায় 'বৃহত্তর' পরিবর্তন আসবে। এই পরিবর্তনকে কনজার্ভেটিভদের ডানপন্থী মতবাদের জন্য বিজয় হিসেবে দেখা হবে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী প্রতি ১০ জন আমেরিকানের মধ্যে ছয় জন (৫৯ শতাংশ) চান সব বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভপাত বৈধ হোক। গর্ভপাত নিয়ে এ বিতর্ক মার্কিন রাজনৈতিক মহলেও দ্বিধাবিভক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে অনেক আগে থেকেই। এর পাশাপাশি রয়েছে বিষয়টি নিয়ে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা।
রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিকদের মধ্যে অনেকেই আবার গর্ভপাত বিষয়ক তাদের সমর্থিত দলের আদর্শের সাথে একমত্য নন। ২০১৯ সালের একটি জরিপে জানা যায়, ১০ জনের মধ্যে সাত জন মার্কিনী চান না সুপ্রিম কোর্ট রো বনাম ওয়েড মামলার রায়ে কোনো পরিবর্তন আনুক।
গর্ভপাত বৈধকরণে সক্ষম কংগ্রেস?
যদি সুপ্রিম কোর্ট রো বদলে দেন, তাহলে মার্কিন কংগ্রেসেে পক্ষে এমন একটি আইন তৈরি করা সম্ভব যার দ্বারা গর্ভপাত আইনত বৈধ করা যাবে। তবে এরকম আইন পাশ করা কিছুটা কঠিন হবে।
গত বছর ডেমোক্রেটিক পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এক ভোটাভুটিতে রো মামলার রায়কে আরও আইনগতভাবে শক্তপোক্ত করার পদক্ষেপ নেয়। ২১৮ জন ওই বিলের পক্ষে ও ২১১ জন বিপক্ষে ভোট দেন।
পরে সিনেটে বিলটি পাঠানো হয়। সেখানে ডেমোক্রেট সদস্য জো মাঞ্চিন ওই বিলকে ভোটে পরাস্ত করতে রিপাবলিকানদের পক্ষে যোগ দেন। ওই বিল পাশ করানোর জন্য ১০০টির মধ্যে ৬০টি ভোটের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অতগুলো ভোট পাওয়া যায়নি।
তাই সুপ্রিম কোর্টের খসড়ার কথা জানাজানি হওয়ার পরে ডেমোক্রেটরা এখন চাইলে আবারও ওই বিলকে পাশ করানোর চেষ্টা করতে পারে। তবে এই চেষ্টা যে সফলতা পাবে তার আশা খুবই ক্ষীণ।
গর্ভপাত অবৈধ হলে কারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন?
গর্ভপাত নিষিদ্ধ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক শ্রেণীর মানুষ বৈষম্যের শিকার হতে পারেন। এই পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে তরুণী, দরিদ্র নারী, আফ্রিকান-আমেরিকান নারীদের ওপর। কারণ সরকারি তথ্যমতে, এ শ্রেণীর নারীদের মধ্যে গর্ভপাতের হার বেশি লক্ষ্য করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের গর্ভপাত করানো নারীদের বেশিরভাগের বয়ই ২০-এর কোটায়। গর্ভপাত পদ্ধতি গ্রহণ করা নারীদের ৭৫ শতাংশ দরিদ্র অথবা স্বল্প আয়কারী। তবে গত এক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমশ কম সংখ্যক নারী গর্ভপাতের আশ্রয় নিচ্ছেন। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গর্ভপাতের হার ১৮ শতাংশ কমে গেছে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, পিবিএস, বিবিসি, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ও পিউ রিসার্চ সেন্টার