মার্কিন ডলারের চড়া মানের মূল্য উদীয়মান বাজার ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো দিচ্ছে
দুই বছর ধরে করোনা মহামারি উদীয়মান বাজার তথা উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনীতিকে প্রচণ্ড আঘাত করেছে। সেখান থেকে সবে উত্তরণ শুরু হয়েছিল- কিন্তু তার আগেই এখন পুঁজি বিদেশে চলে যাওয়ার সংকট দেখা দিল। এজন্য দায়ী বিশ্ববাণিজ্য ও আর্থিক খাতের প্রধানতম মুদ্রা ডলারের চড়া মান। এতে করে অনেক দেশের জন্য ঋণ খেলাপের ঝুঁকিও বেড়েছে। ডলারের চড়া মানের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা বিনিময় দর হারানোয়- তাদের আমদানি আর ঋণ পরিশোধের খরচ দুইই বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে।
অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, উদীয়মান বাজার অর্থনীতিতে দেখা দেওয়া আগের অনেক সংকটই কোনো না কোনোভাবে ডলারের শক্তিসামর্থ্যের সাথে সম্পর্কিত। ডলারের মান বাড়লে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের মুদ্রানীতিকে কঠোর করতে হয়। আর তা না করলে শোচনীয় রূপ নেয় মুদ্রাস্ফীতি। বেশিরভাগ বিদেশি ঋণ পরিশোধ মার্কিন ডলারে করতে হওয়ায়, এতে করে ঋণের কিস্তি মেটানোর চাপও বেড়ে চলে।
ঋণ ব্যবস্থাপনায় সাম্প্রতিক দশকগুলোয় বেশকিছু সংশোধন বা উন্নতি হয়েছে একথা ঠিক, কিন্তু তাতে উপরে আলোচিত এসব সমীকরণ সার্বিকভাবে তেমন বদলায়নি। আর সেজন্যই ডলার তার উত্থানের পথে রেখে চলেছে প্রলয়ের চিহ্ন।
মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মিলিয়ে বিশ্ববাজার এখন বেশ চড়া। প্রায় সকল কাঁচামাল ও নিত্যপণ্যের মূল্য অস্থিতিশীল। এই পরিস্থিতি জটিলতাকে বাড়াচ্ছে মাত্র। তার ওপর সম্পতি কমেছে এশিয়া ও কাঁচামাল রপ্তানি নির্ভর মুদ্রাগুলির অন্যতম সমর্থক চীনা ইউয়ানের দর। ইউয়ানের দর কমা একটি বড় বিপত্তি হওয়ার কারণ, চীন বিপুল কাঁচামাল আমদানি করে, বিভিন্ন দেশ চীনে রপ্তানি করে ইউয়ান অর্জন করে। মুদ্রাটির বিনিময় মূল্য হারানোর অর্থ তাদের বৈদেশিক রিজার্ভ আরও দুর্বল হয়ে পড়া। যদিও মার্কিন ডলারের তুলনায় অনেক কম রিজার্ভই ইউয়ানে রাখার চল রয়েছে।
দুর্বল মুদ্রার কারণে উৎপাদন খাতের জায়ান্ট চীন আরও বেশি রপ্তানির সুযোগ পাবে। চীনা পণ্যের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ এতে বিশ্ববাজারে পিছিয়ে পড়বে। বাজার কমা মানেই রপ্তানি হ্রাস, আর তা দৌদুল্যমান রিজার্ভকে আরও নিম্নমুখীও করবে অনেক দেশের ক্ষেত্রে।
"ব্যবধানগুলো দিন দিন বাড়ছে। শক্তিশালী ডলার ও উচ্চ পণ্যমূল্য একসঙ্গে হলে উদীয়মান বাজারে একের পর এক সমস্যার ঢেউ আঘাত হানা বিচিত্র কিছু নয়। তার উপর যখন ইউয়ান দুর্বল হয়, তখন মুদ্রাবাজারে কেউই জয়ী হতে পারে না।"- মন্তব্য করেন বৈশ্বিক আর্থিক সংস্থা ইউবিএস- এর হেড অব ইমার্জিং মার্কেট স্ট্র্যাটেজি মানিক নারাইন।
মুদ্রা নিয়ে প্রহেলিকা:
ডলারের বাড়তি মূল্য অর্জন উদীয়মান বাজারের মুদ্রা সূচককে চলতি বছর ৩.৫ শতাংশ কমিয়েছে, ১৮ মাসের মধ্যে যা সর্বনিম্ন। সবদেশে অবশ্য সমান হয়নি মুদ্রাস্ফীতি, উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত মুদ্রার মধ্যে ছিল পোলান্ডের জ্লোতি ও তুরস্কের লিরা। এপ্রিল মাসে ইউয়ানের সাথে এ দুটি মুদ্রার মান হারানো আরও বেড়ে যায়।
মুদ্রার নমনীয় বিনিময় হার অবশ্য উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে ১৯৯০ এর দশকের মতো সংকটের পুনরাবৃত্তি থেকে রক্ষা করে। ওই সময়, ১৯৯৪ সালে মার্কিন মুদ্রা এবং ট্রেজারির উচ্চ লভ্যাংশ প্রথমে মেক্সিকোতে 'তাকিলা সংকট' সৃষ্টি করে। এরপর সে অভিঘাতের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, রাশিয়া ও ব্রাজিলে। একে একে এসব দেশের মুদ্রার ডলারের বিপরীতে নির্ধারিত বিনিময় হার বা ডলার পেগ ধসে যায়।
তবে ডলার শক্তিশালী হওয়ার আরেক অর্থ- আমদানিতে মূল্যস্ফীতি। এদিকটি আরও বেশি উদ্বেগজনক, কারণ এখন বিশ্ববাজারে খাদ্য ও তেলের মতো আবশ্যক পণ্যের মূল্য ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। স্থানীয় মুদ্রামান কমায় সাম্প্রতিক সময়ে উদীয়মান বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও বিদেশে চলে যাচ্ছে।
বিশ্ববাজারে এখন মন্দার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে কাঁচামাল রপ্তানি-নির্ভর লাতিন আমেরিকার মুদ্রাগুলি বছরের শুরুতে ভালো অবস্থানে থাকলেও এখন মলীন হতে শুরু করেছে তাদের উজ্জ্বল্য। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে চিলির মুদ্রা পেসো ৮ শতাংশ মান অর্জন করলেও, তারপর থেকে এটি ১০ শতাংশ পড়ে গেছে।
বেদনার ভার শুধুই বাড়ছে:
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ মৌল সুদহার বাড়াচ্ছে। এতে ট্রেজারি বন্ডের প্রিমিয়াম রিটার্ন এখন আরও লাভজনক হয়ে উঠেছে। বিনিময় মুল্যেও শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। নিজস্ব মূল্যস্ফীতি আর পুঁজি পাচার রোধে তাই এখন উন্নয়নশীল বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি শত শত বেসিস পয়েন্ট মৌল সুদহার বাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে রিজার্ভে সঞ্চিত ট্রেজারি বন্ডের মুদ্রাস্ফীতি-সামঞ্জস্যপূর্ণ লভ্যাংশও নিশ্চিত করতে চাইছে তারা।
ফলস্বরূপ, কমতে চলেছে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর প্রবৃদ্ধি। বিশ্বব্যাংক চলতি বছর উদীয়মান অর্থনীতিগুলো সার্বিকভাবে ৬.৩ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে পূর্বাভাস দেয়, যা এখন কমিয়ে ৪.৬ শতাংশ করা হয়েছে।
আর্থিক খাতের পরিস্থিতি আরও টানাটানির মধ্যে ফেলে ডলারের শক্তিও প্রবৃদ্ধির পায়ে কুঠারাঘাত করতে পারে। এতে সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমবে, যা ব্যবসাবাণিজ্য ও কর্মসংস্থান বাজারে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। এরমধ্যেই বিখ্যাত মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্স- এর উদীয়মান বাজারের আর্থিক খাত সূচক ২০০৮ সালের পর সবচেয়ে টানটান অবস্থার নির্দেশ করছে, চলতি বছর এটি বেড়েছে ৩০০ বিপিএস।
দেনায় ভরাডুবি:
মার্কিন ট্রেজারির লভ্যাংশ বাড়ার অর্থ- দুনিয়াজুড়ে পুঁজি সংগ্রহের উচ্চ খরচ; কিন্তু তা ডলার ঋণ নিতে অধিক নির্ভর দেশগুলোর জন্যই বেশি যন্ত্রণার কারণ।
এরমধ্যেই যুক্ত্রাস্ত্র-ভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যানের সার্বভৌম ডলার বন্ড সূচক এমবিআইজিডি'র লভ্যাংশ ৭ শতাংশের বেশি ছাড়িয়েছে।
উচ্চ দেনার খরচ, অর্থনৈতিক অব্যস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা এখন তাই পুরোমাত্রার এক ভয়াল সংকটের ঘূর্ণিপাকে, বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও এমনটি হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিনিয়োগকারীরা।
ঋণের উচ্চ সুদহার উদীয়মান বাজার অর্থনীতির সরকার ও কোম্পানিগুলোকেও আন্তর্জাতিক বন্ড বাজার থেকে দেনা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করছে। এ বাজারে নতুন বন্ড ইস্যুর ব্যস্ততা থাকে এপ্রিল মাসেই, কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলে বন্ড বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬৯০ কোটি ডলারের, ২০১৫ সালের পর এমন মন্দাবস্থা আর দেখা যায়নি।
জেপি মরগ্যানের উদীয়মান বাজার বিশ্লেষক ট্রাং নগুয়েন অবশ্য বন্ড বিক্রি বাড়ার আশা করছেন। "উচ্চ খরচে হলেও, বেশিরভাগ দেশকে তাদের অর্থায়নের ঘাটতি মেটাতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বন্ড কিনতেই হবে"- মন্তব্য করেন তিনি।
- সূত্র: রয়টার্স