চুইংগাম যুগে যুগে
চুইংগাম। সঠিক ইংরেজি উচ্চারণে বললে চিউয়িংগাম। মানে যে গাম চিবানো যায়। হাঁটতে হাঁটতে কিংবা বাসে ওঠার আগে চট করে একটা চুইংগাম মুখে চালান করে দেওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা। তারপর চাবানো। মিষ্টি বা মিন্ট ফ্লেভার একসময় মিলিয়ে যায়। তবু চাবানো থামে না। কেন? সে এক রহস্য। আসলে এ প্রশ্নের জবাব নেই, অন্তত আমার কাছে। ইতিহাসে এর চেয়ে অর্থহীন কয়টা কাজ মানুষ এত দিন ধরে করে আসছে, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। টেবিল বা চেয়ারের নিচে চিবানো চুইংগাম লাগিয়ে দেওয়া এ তালিকার শীর্ষে থাকতে পারে।
কীভাবে এল চুইংগাম? এর জন্মরহস্যটা কী? সব প্রশ্নের জবাব জানে সর্বজ্ঞানী গুগল মামা। প্রশ্ন করতেই নানান জবাব হাজির। জানা গেল, টমাস অ্যাডামসকে বলা হয় চুইংগামশিল্পের জনক। শিকল (Chicle, দক্ষিণ আমেরিকার একধরনের গাছের রস) থেকে রাবার বানানোর চেষ্টায় নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন তিনি। বারবার ব্যর্থ হয়ে ওটাই মুখে পুরে দেন একসময়। একটুখানি চিবিয়ে নিয়ে টের পেলেন জিনিসটা মুখের ভেতর বুদ্বুদ তৈরি করে। চাইলে ওটাকে ফোলানোও যায়। এই হলো চুইংগামশিল্পের ইউরেকা মুহূর্ত। অ্যাডামসের মাথায় কোটি টাকার 'বুদ্ধির বাত্তি' জ্বলে উঠল। কিছুদিনের মধ্যেই বাণিজ্যিকভাবে চুইংগাম বাজারে আনেন তিনি। ব্যস! সেই থেকেই মানুষ এ জিনিস চিবাচ্ছে।
উঁহু, কথাটা ভুল হলো। টমাস অ্যাডামস এর সত্যিকার বাণিজ্যিকীকরণ করেছিলেন সত্যি, কিন্তু চুইংগাম আরও অনেক প্রাচীন। না, ডায়নোসররা চুইংগাম চিবোতো, এ রকম কোনো ফসিল বা জীবাশ্ম পাওয়া যায়নি। তবে ৫,৭০০ বছর পুরোনো চুইংগাম পাওয়া গেছে! ডেনমার্কে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ করেছেন একদল বিজ্ঞানী। সেখানেই এক চুইংগামে পাওয়া গেছে এক তরুণীর দাঁতের ছাপ। ওটা মূলত বার্চগাছের জমাট রস।
কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, চুইংগামের গল্পটা আসলে কী? কত দিন ধরে এই অর্থহীন চিবানোর কাজ করছে মানুষ? সে এক লম্বা, সরস গল্প! একটা চুইংগাম মুখে পুরে চিবোতে চিবোতেই নাহয় শুনে ফেলুন গল্পটা।
২
নিওথিলিক যুগে বার্চের জমাট রস থেকে তৈরি চুইংগামের জীবাশ্ম যে পাওয়া গেছে, সে কথা তো বলেছি। পরবর্তী সময়ে শিকল থেকে চুইংগাম বানানো শুরু করে মূলত মায়ান ও আজটেকরা। পাশাপাশি গামের মতো একধরনের জিনিস বানাত তারা প্রাত্যহিক বিভিন্ন জিনিস জোড়া লাগানোর কাজে। পরবর্তী বিখ্যাত সভ্যতার নাম গ্রিক সভ্যতা। দেখা যায়, প্রাচীন গ্রিসেও ছিল চুইংগাম। মাস্টিকগাছের রস থেকে এই চুইংগাম বানাত তারা। বার্চগাছের মতো এ গাছেরও অ্যান্টিসেপটিক বা জীবাণুনাশক বৈশিষ্ট্য আছে। ধারণা করা হয়, দাঁত ও মুখের স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যবহৃত হতো এ চুইংগাম।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, প্রাচীন চৈনিক, এস্কিমো এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের জীবনেও ছিল চুইংগাম। তবে এর আধুনিকায়ন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে এসে। বার্চ বা মাস্টিকগাছের রস মূলত রেসিন বা রজন। আদিবাসী আমেরিকান-ইন্ডিয়ানরা এই রজনের গাম চিবোতো। ইংল্যান্ড যখন যুক্তরাষ্টের এই অঞ্চলটা দখল করে নেয়, তখন তারাও এ অভ্যাসটা রপ্ত করে ফেলে।
১৮৪৮ সালে জন বি কার্টিস প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চুইংগাম তৈরি করেন। এর নাম ছিল 'দ্য স্টেট অব মেইন পিউর স্পুস গাম'। তত দিনে যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হয়ে গেছে। শিল্প খাতে লেগেছে উন্নতির হাওয়া। কার্টিসের স্প্রুস গামের গায়েও সে হাওয়া লাগে। তবে এর স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র দুই বছর। ১৮৫০ সালে বাজারে আসে প্যারাফিন মোম থেকে বানানো নতুন ধরনের চুইংগাম। এই চুইংগামের জনপ্রিয়তার তোড়ে ভেসে যায় স্প্রুস গাম।
আদি এসব চুইংগামে আলাদাভাবে সে রকম মিষ্টি যুক্ত করা হতো না। যাঁরা চুইংগাম চাবাতেন, তাঁরা গুঁড়ো চিনিতে বারবার মাখিয়ে নিতেন চুইংগাম। ২০২১ সালে বসে চুইংগাম মুখ থেকে বের করে চিনি মাখিয়ে আবার মুখে দেওয়ার কথা ভাবলে অবশ্য গা রি রি করে ওঠা স্বাভাবিক!
১৮৬০ সালে প্রথম স্বাদ বা ফ্লেভার দেওয়া চুইংগাম তৈরি করেন জন ক্লোগান নামের এক ফার্মাসিস্ট। ভদ্রলোকের বাস কেন্টাকির লুইসভিলে। চিনিগুঁড়া আর টোলু নামের একধরনের সুগন্ধিযুক্ত রজনমতো গুঁড়ো মিশিয়ে তিনি যে চুইংগাম স্টিক তৈরি করেন, তার নাম দেন 'ট্যাফি টোল'। পাশাপাশি 'মানিলকারা শিকল' নামে একধরনের গ্রীষ্মম-লীয় গাছের রস বা শিকল থেকে চুইংগাম বানিয়ে তা প্যাকেট করে বাজারজাত করেন তিনি। মজার বিষয়, চুইংগাম স্টিক, মানে ছোট ছোট টুকরো চুইংগাম এবং চুইংগাম র্যাপার বা চুইংগামের প্যাকেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাটার বিষয়টি তিনি পেটেন্টও করে নিয়েছিলেন!
১৮৬০ সালেই বাজারে আসে আধুনিক চুইংগাম। তবে সেটা টমাস অ্যাডামসের হাত ধরে। মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আন্তোনিও লোপেজ খানিকটা শিকল নিয়ে এসেছিলেন অ্যাডামসের জন্য। উদ্দেশ্য ছিল, রাবারের বদলে ব্যবহার করা। এ গল্পটা আগেই বলেছি। রাবার বানাতে না পেরে এ শিকল মুখে পুরে দেন অ্যাডামস। তারপর ইতিহাস! কিন্তু সব করেটরে কারখানা খুলে এ চুইংগাম 'অ্যাডামস নিউইয়র্ক চুইংগাম' নামে ছোট ছোট প্যাকেটে বাজারে আসে ১৮৭১ সালে।
পরের দশ বছরে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে চুইংগাম নিয়ে। বিভিন্ন স্বাদের চুইংগাম বাজারে এসেছে। প্রাকৃতিক উপাদানের বদলে বুটান্ডিয়েনভিত্তিক কৃত্রিম রাবারমতো পদার্থ ব্যবহার করে বানানো শুরু হয়েছে চুইংগাম।
এ তো শুধু মার্কিন মুলুকের কথা। পৃথিবীজুড়ে চুইংগামের এত জনপ্রিয়তা তৈরি হলো কখন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়! মার্কিন সেনাদের রেশন হিসেবে চুইংগাম দেওয়া হতো। তাঁরা সেটা স্থানীয়দের সঙ্গে বিনিময় করত অন্যান্য জিনিসের বদলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পেছনেও আছে এ যুদ্ধের ভূমিকা। চুইংগামের মতো নিরীহ জিনিসের জনপ্রিয়তার পেছনেও এটি। সত্যি বলতে, লোভ-যুদ্ধ-ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এ সভ্যতাকে যতটা এগিয়েছে, শান্তি তার সিকি ভাগও পারেনি। প্রজাতি হিসেবে আমাদের ব্যাপারে এই একটি বাক্যই অনেক কিছু বলে দেয়।
৩
বর্তমানে চুইংগাম বানানোর মূল উপাদান তিনটি। চাবানোর জন্য দেওয়া হয় রজন, নরম থাকার জন্য মোম আর ইলাস্টোমার নামে একধরনের জৈব পদার্থ। শেষটির কাজ এর ইলাস্টিসিটি বা স্থিতিস্থাপকতা। কী এটা? ইলাস্টিক বিষয়টা তো সবারই পরিচিত। টেনে ছেড়ে দিলে আগের জায়গায় ফিরে যায়। রবারের বৈশিষ্ট্য আরকি। বর্তমানে এই তিনটির সবই কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়। কারণ, খরচ কমানো। পাশাপাশি দেওয়া হয় ফ্লেভার বা স্বাদ। ব্যস, হয়ে গেল চুইংগাম। এবার মেশিনে টুকরো করে, প্যাকেটজাত করে বাজারে ছাড়লেই হলো।
মজার একটা বিষয় বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ২০০২ সালের এক গবেষণা বলছে, চুইংগাম স্মৃতিনির্ভর কাজে সহযোগিতা করে। দেখা গেছে, যাঁরা নিয়মিত চুইংগাম চাবান, তাঁদের স্মৃতিশক্তি ভালো কাজ করছে। মনে রাখতে পারছেন ভালো। এর কারণ কী, তা অবশ্য এ গবেষণায় উঠে আসেনি। দাঁতের ডাক্তাররা আবার বলেন, চিনিবিহীন চুইংগাম লালা নিঃসরণে সাহায্য করে। পাশাপাশি, মুখ থেকে খাদ্যের অবশেষ ও ব্যাকটেরিয়া সরিয়ে ফেলা, দাঁত শক্ত করা, দাঁতের এনামেল ক্ষয়কারক অ্যাসিডকে দুর্বল করে দেওয়া ইত্যাদিতে ভূমিকা রাখে। তবে চিনিযুক্ত চুইংগাম বেশি চাবানো দাঁতের জন্য ক্ষতিকর। তবে দাঁতের উপকার বা কোনো বিশেষ সুফল পেতে যে মানুষ সাধারণত চুইংগাম খায় না, সে কথা বোঝার জন্য রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই।
৪
চুইংগাম আজও জনপ্রিয়। তবে এ জনপ্রিয়তা ২১ শতকে কমে গেছে অনেকখানি। দোকানের একদম সামনে চকলেট, চুইংগাম ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস সাজিয়ে রাখা হয় কেন? ইংরেজিতে এর নাম 'ইম্পালস বাই'। ক্ষণিকের তাড়নায় কিছু কিনে ফেলা। ঢুকেছেন বিস্কুট কিনতে, কিন্তু বের হওয়ার আগে চুইংগাম দেখে মনে হলো, পাঁচটা নিয়ে যাই, এ রকম। এই ইম্পলাস বাই এখন কমে গেছে অনেক। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন মুঠোফোন ও সোশ্যাল নেটওয়ার্ককে। দোকানে ঢুকলেও মনযোগ যে থাকে ওর ভেতরে! আরেকটি কারণ, কৈশোর বা টিনএজে পা রেখে খানিকটা বিদ্রোহীভাব, খানিকটা সামাজিক নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখানোর ইচ্ছা থেকে অনেকেই স্কেটিং করতে করতে বা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চুইংগাম অথবা বাবলগাম ফুলাত। সে জিনিস এখন নেই হয়ে গেছে বলতে গেলে। বিদেশের কথা থাক। হাল আমলের বাংলাদেশের কথা ভাবুন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এখন আর কাউকে চুইংগাম ফুলাতে দেখা যায় আদৌ?
তবু চুইংগাম আছে। প্রায় অকারণেই। থাকবে আরও দীর্ঘদিন, এ কথা বলে দেওয়া যায় চোখ বুজে।