‘চুইংগামকে ঘৃণা করি, আমাকে চুইংগামের মতো ব্যবহার করা হয়েছে’
টাকা গাছে ধরে কি না, এ প্রশ্নটি অনেক পুরোনো। কিন্তু চুইংগাম গাছে ধরে কিনা, এ প্রশ্নের জবাব না শোনার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে চুইংগাম গাছেই ধরত, এখনো ধরে। কিন্তু যন্ত্রপাতি ও সিনেথেটিক দ্রব্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়াতে গাছকে এড়িয়েও চুইংগাম বানানো হচ্ছে এখন।
৯০০০ হাজার বছর আগেকার যে চুইংগাম একালের বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করেছেন, তা গাছ থেকে পেড়ে কিংবা খুঁচিয়ে বের করা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় ছিল না। মায়া ও আজটেক সভ্যতা চুইংগাম ভক্তদের সাক্ষ্য দেয়। আমাজনাঞ্চলের গাছ থেকে চুইংগাম সংগ্রহ করতে গিয়ে এ কালের মানুষ অরণ্যের কম সর্বনাশ করেনি। এটি বাস্তবিকই গাছ নিঃসৃত রস বা আঠা, যা জমে রাবার কিংবা স্পঞ্জের মতো হয়। সেকালে এটাই তুলে নিয়ে সরাসরি মুখে দিয়ে চিবোতো মানুষ। এ কালে এর সাথে হরেক রকম স্বাদ-ঘ্রাণ ও অন্যান্য উপাদান মেশানো হয়।
এস্কিমোদের চুইংগামের উৎস ছাড়া আর সব প্রাচীন সভ্যতা ও ভৌগলিক স্থানে গামের উৎস গাছ। প্রাচীন গ্রিস- মাস্টিক বৃক্ষের বাকল, প্রাচীন মায়া- চিকল, চীনা সভ্যতা- জিনসেংয়ের মূল, ইন্ডিয়ান আমেরিকান- সুগার পাইন ও স্প্রুস রস, দক্ষিণ আমেরিকা- কোকাপাতা, দক্ষিণ এশিয়া- সুপারি, উষ্ণমণ্ডলীয় পশ্চিম আফ্রিকা- কোলা নাট, যুক্তরাষ্ট্র- তামাকপাতা।
একালে যেসব সিনথেটিক উপাদান যোগ হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বিউটাভিন, আইসোবিউটাইলিন (দুটোই ভিন্ন ধরনের রাবার) প্যারাফিন পেট্রোলিয়াম ওয়াক্স, পেট্রোলিয়াম সিনথেটিক ওয়াক্স, পলিইথালিন, পলিআইসোবিউটালিন, পলিভিনাইল অ্যাসিটেট। আর বিভিন্ন ধরনের স্বাদ। চুইংগাম আসলেই গাছে ধরে।
প্রাসঙ্গিক তুলনা: তোষামোদি হচ্ছে চুইংগামের মতো, উপভোগ করবেন, কিন্তু গিলবেন না। (হ্যাঙ্ক কেচাম)
হাজার বছর ধরে আমি চিবোচ্ছি গাছের আঠা
হাজার হাজার বছর আগেও মানুষ প্রাকৃতিক উৎস বৃক্ষ থেকে নিঃসৃত আঠা চিবিয়ে খেত; বিভিন্ন ধরনের ঘাম, পাতা শস্যদানা এবং মোমও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চিবোতো। প্রতœাত্ত্বিকেরা সুইডেনের একটি দ্বীপে ৯০০০ বছর আগে মানুষের চিবোনো, বার্চবৃক্ষের রজনের সন্ধান পেয়েছেন। ২৪০০ বছর আগে গ্রিসরা মাস্টিক বৃক্ষের আঠা চিবোতো, এটাই চুইংগামহিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয় শতকে সেন্ট্রাল আমেরিকার মায়া সভ্যতা অঞ্চলে ম্যাপোডিলা বৃক্ষের নিঃসৃত জমাটবাঁধা রস মানুষ চিবিয়েছে। উত্তর আমেরিকান ইন্ডিয়ানরা চিবোতো স্প্রুস বৃক্ষের অনুরূপ রস। পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক চুইংগাম বাজারে নিয়ে আসেন জন ব্যাকন কার্টিস। স্প্রুস বৃক্ষের রজন ব্যবহার করে আঠালো রাবারের মতো দ্রব্য তিনি আবিষ্কার করেন। ১৮৫০ সালে তিনি এতে গামের সাথে যোগ করলেন। কোমল ও রাবারের অনুভূতি দেবার জন্য প্যারাফিন যোগ করলেন ১৮৬৯-এর ডিসেম্বরে উইলিয়াম ফিনলে সেম্মল সর্বপ্রথম চুইংগাম বানানোর পেটেন্ট রাইট পেলেন। চুইংগামের জন্য ১৮৬৯ সালে মেক্সিকোর ক্ষমতাহারা জেনারেল আন্তানিও গোমেজ কাঁচামাল হিসেবে চিকল ব্যবহারের পরামর্শ টমাস অ্যাডামকে দিলেন। ১৮৬৯ সাল টমাস অ্যাডামস চিকলের সাথে কেবল সুঘ্রাণ যোগ করে 'অ্যাডামস নিউইয়র্ক চুইংগাম' নাম দিয়ে বিপুল পরিমাণ বাজারজাত করলেন। ১৮৭৯ সালে চুইংগাম বানানোর একটি মেশিনেরও পেটেন্ট নিলেন তিনি। ১৮৭০ দশকে টক কমলা স্বাদের ডিনার-পরবর্তী মিঠাই: নাম স্টক অরেঞ্জ, এটাও চুইংগাম, ১৮৮০-এর দশকে উইলিয়াম হোয়াইট চিকলের সাথে পিপারমিন্ট স্বাদ যোগ করলেন। ১৮৮৮ সালে ভেন্ডিং মেশিন থেকে প্রথম টুট্টি ফ্রুটি ব্র্যান্ডের চুইংগাম বিক্রি করা হয়। ১৮৯২ উইলিয়াম রিগলি জুনিয়র একটি বেকিং পাউডার কিনলে ২ প্যাকেট চুইংগাম ফ্রি দেবার ঘোষণা দেন। তা ব্যাপক সাড়া পায়। ১৮৯৩ সালে ডা. বিম্যান এর সাথে পেপসিন পাউডার মিলিয়ে চুইংগামকে পরিপাকসহায়ক দ্রব্যে পরিণত করেন এবং এ ধরনের গাম এখনো পাওয়া যায়। ১৯০০ শতকের শুরুতেই রিবালির চুইংগাম ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ১৯২৬ সালে ফ্রাঙ্ক ফ্রিয়ার প্রথম বাবলগাম তৈরি করেন, কিন্তু বেশি আঠালো হবার কারণে তা বাজার পায়নি। ১৯১৪ রিগলির ডাবলমিন্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সৈন্যরা খেতে শুরু করে, আমেরিকার বাইরে কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে রিগলি ডাবলমিন্টের কারখানা স্থাপন করে। ১৯৫০ দশকে আসে সুপারলেস গাম আর ১৯৬০ দশকে সুগার-ফ্রি বাবলগাম। বিভিন্ন বর্ণে এ স্বাদের চুইংগাম বেশ রাজত্ব করে যাচ্ছে।
এটা জানা আবশ্যক সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে চুইংগাম দেরিতে প্রবেশ করেছে। ১৯৫৭-এর আগে পূর্ব ইউরোপে চুইংগাম নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৫৭ সালে চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড ও পূর্ব জার্মানিও তা অনুসরন করে। ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চুইংগামের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।
কেবল যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিমাণ চুইংগাম খেয়ে ছুড়ে ফেলা হয়, তা জোড়া লাগাতে থাকলে যে বিশাল দড়ি হবে, তা দিয়ে কমপক্ষে ৭ বার পৃথিবী থেকে চাঁদ পর্যন্ত এবং ৭ বার চাঁদ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত দড়ি টানানো যাবে।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ই সৈন্যরা চুইংগাম খেতে শুরু করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কোনো কোনো ব্যাটালিয়নকে রেশন হিসেবে চুইংগাম দেওয়া হয়। সৈন্যরা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্যান্য জায়গায় উপহার হিসেবে নতুন পরিচিতদের হাতে চুইংগামের প্যাকেট তুলে দেয়। একালে যত চুইংগাম পাওয়া যায়, তার মধ্যে তিনটি স্বাদ দারুচিনি, স্পিয়ারমিন্ট এবং পিপারমিন্ট বেশি জনপ্রিয়। চুইংগাম ঘণ্টায় ১১ ক্যালরি শক্তি পোড়ায়। বাবলগাম ফুলিয়ে গোলক তৈরির প্রতিযোগিতায় ১৯৯৪ সালে ২৩ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের একটি গোলক বানিয়ে রেকর্ড করেছেন সুমান মন্টগোমারি উইলিয়ামস।
রিগলি জুনিয়র চুইংগাম শিল্পপতি
উইলিয়াম মিলস রিগলি সিনিয়রের একটি ছোট সাবানের দোকান ছিল। বেচাকেনা খুব কম। একসময় দোকানদারি করতে ছেলে রিগলি জুনিয়রকেও টেনে আনলেন। বাবার ব্যবসায়ের স্টাইলটাই আর পছন্দ হলো না রিগলি জুনিয়রের। এত খাটাখাটনি করলে লাভের অঙ্ক কেন এত কম হবে? মেধা না খাটিয়ে মজুর খেটেই তো এর চেয়ে বেশি কামাই করা যায়।
ছোট রিগলির জন্ম রবীন্দ্রনাথের জন্মবছর ১৮৬১ সালে। ১৮৯১ সালে ঠিক ৩০ বছর বয়সে ৩২ ডলার হাতে নিয়ে নিজস্ব ব্যবসায় নামলেন, এবারও সাবানেরই ব্যবসা। সাবানের নাম রিগলিস স্কাউয়ারিং সোপ। সাবান কিনলে বেকিং পাউন্ডার ফ্রি। ফ্রি বেকিং পাউডারের জন্য খদ্দের বেড়ে গেল। তার দোকান আমেরিকার ফিলডেলফিয়াতে। রিগলি দেখলেন তার ক্রেতারা সাবান কেনে বটে, কিন্তু তাদের আগ্রহ সাবান নয়, বেকিং পাউন্ডার। তত দিনে হাতে পুঁজি এসে গেছে। ঠিক করলেন কম লাভের সাবান নয় বরং কিছুটা বেশি দামের বেকিং পাউডারের ব্যবসা ধরবেন। তিনি তাই করলেন। এখানেও একটা কিছু ফ্রি দিতে চান। মুখটাকে ব্যস্ত রাখার মতো চুইংগাম তখন বাজারে এসে গেছে। দামেও সস্তা। এক কৌটা বেকিং পাউডার কিনলে ছোট দুই প্যাকেট চুইংগাম ফ্রি।
রিগলির একই অভিজ্ঞতা হলো ক্রেতারা বেকিং পাউডার নিচ্ছে বটে, তারা নিচ্ছে মূলত বিনে পয়সার চুইংগামের জন্য।
তাকে আবার ভাবতে হলো- তাহলে চুইংগামের কারখানা নয় কেন? চুইংগামের ব্যবসায় লাভ আরও বেশি। ১৯০৭ সালে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা চলছে, মানুষ ব্যয় সংকোচন করছে চকলেট থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সব খাবারেই খরচ কর্তন অব্যহৃত রয়েছে। রিগলি এটাকে সুযোগ হিসেবে নিলেন। রিগলি চুইংগাম কারখানা স্থাপন করলেন। চুইংগাম চিবানো মুখ এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে অন্য খাবারের পেছনে পয়সা ঢালতে হবে না। সহায়-সম্পদ প্রায় সবই বন্ধক দিয়ে আড়াই লক্ষ ডলার জোগাড় করে শহর, শহরতলির সব বিজ্ঞাপনবোর্ড ভরে দিলেন রিগলি চুইংগামের বিজনেস প্রমোশনে। টেলিফোন ডিরেক্টরির ঠিকানা ধরে পনেরো লক্ষ আমেরিকানের বাড়িতে পাঠালেন চারটি চুইংগামের একটি প্যাকেট।
১৯২০ সালের একটি বিজ্ঞাপনে বলা হলো, খাবারের পর রিগলি চিবোতে থাকুন- দাঁত পরিষ্কার করবে, গলায় শীতল আরামদায়ক অনুভূতি এনে দেবে, আর বেশি খেয়ে থাকলে সেই অস্বস্তি দূর করে দেবে।
একটি বিজ্ঞাপনে বলা হলো: আপনি যদি বাড়িতে টেলিফোনের খরচ মেটাতে পারেন, তা হলে অবশ্যই এক প্যাকেট চুইংগামও কিনতে পারবেন।
১৯১০ থেকে বহু আমেরিকান শিশু তাদের জন্মদিনে উইলিয়াম রিগলির পাঠানো চুইংগামের প্যাকেট পেয়েছে। রিগলি নামটির সাথে পরিচিত নয় এমন কোনো আমেরিকান শিশু কিংবা বুড়ো খুঁজে পাওয়া একটি দুর্লভ ব্যাপার ছিল, এখনো তাই।
প্রথম বছর রিগলি ১ লক্ষ ৭০ হাজার ডলারের চুইংগাম বিক্রি করলেন, যা তৃতীয় বছরে ৩০ লক্ষ ডলার ছাড়িয়ে গেল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সৈনিকদের রেশনের মধ্যে ঠাঁই পেল রিগলি চুইংগাম। রণক্ষেত্রের উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তা দমনে রিগলি চিবানোই সর্বোত্তম ওষুধ। স্পিয়ারমিট এবং জুসি ফ্রুট গাম কোম্পানি সবচেয়ে পরিচিত চুইংগাম। রিগলির বাণিজ্য সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকল। ঢাকা শহরের বহু দোকানে রিগলির চুইংগাম মিলবে।
১৯৩২ সালে আরিজোনা রাজ্যে নিজের ফিনিক্স নামের ম্যানসনে রিগলি জুনিয়র মৃত্যুবরণ করেন। এতদিন তাঁর প্রপৌত্র উইলিয়াম রিগলি জুনিয়র কোম্পানি চালাচ্ছিলেন। ব্যবসা বদলে রিগলি পরিবার ব্র্যান্ডনামসহ কোম্পানি ৩২ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দিয়েছে। এর একজন ছোট ভাগীদার (৪.৪ বিলিয়ন ডলার) শীর্ষ ধনীদের একজন ওয়ারেন বাফেট। বড় ভাগীদার মার্স চকলেট কোম্পানি। ২০১৯ সালের হিসাবে পৃথিবীর বার্ষিক চুইংগামের বাজার ৩২.৬১ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে রিগলি এবং ক্যাডব্যারির দখলে ৬০ ভাগেরও বেশি বাজার। রিগলি কোম্পানির বিশ্ববাজার অংশ ৩৫%, ক্যাডব্যারির ২৬%, লোটে ১৪, পারফেডি ভ্যান মেল্লে ৬% এবং হার্শে ২%। এর মধ্যে ক্যাডব্যারি ব্রিটিশ, লোটে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান দ্বৈত বিনিয়োগ, হার্শে যুক্তরাষ্ট্রের। বাজারের অবশিষ্ট ১৭ ভাগের দখল উপভোগ করছে ২০০ থেকে ২৫০ কোম্পানি।
উপন্যাসের নাম চুইংগাম
লিবিয়ার ঔপন্যাসিক মনসুর বুশনাফ ২০০৮ সালে আরবি উপন্যাস চুইংগাম প্রথম কায়রোতে প্রকাশ করেন। গাদ্দাফির আমলে এটি লিবিয়াতে নিষিদ্ধ হয়। ২০১৪ সালে ব্রিটেনে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হবার সাথে সাথে লেখক আলোচনায় চলে আসেন। কাহিনীর নায়ক মুখতার একজন পরিত্যক্ত প্রেমিক। তার বাবা ওমর এফেন্দি বুয়াল পুলিশ ফোর্সের সদস্য, তার মা রহিমা তুর্কি লিবিয়ান বংশোদ্ভূত। ফাতেমা, এই কাহিনির নায়িকা বহু পুরুষাসক্ত, তিনি তার প্রেমিক মুখতারকে নিয়ে একটি পরিত্যক্ত পার্কে গাছের আড়ালে যায়, মুখতার সেখানেই 'ফ্রিজড হয়ে থাকে। ফাতেমার অন্য পুরুষের সাথে চলে যাওয়ার দৃশ্যটি ছাড়া অন্য কিছু তার চোখে পড়ে না। এর মধ্যে দেশে চুইংগাম-ক্রেজ শুরু হয়। চুইংগামের টানে আরও বহু মানুষের সাথে ফাতেমার সাক্ষাৎ হয়। ফ্রিজড অবস্থায় মুখতার এক যুগ কাটিয়ে দেয়। বহু পরিবর্তন ঘটে চারদিকে, স্বৈরাচারী শাসন নিষ্প্রাণ করে দেয় সব কিছু। পাকে, রাস্তার্য় যত্রতত্র পরিত্যক্ত চুইংগাম এবং এমনকি মোড়কও পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ অবস্থার ব্যাখ্যা করতে হাজির হন বিভিন্ন তরিকার লিবিয়ান অধ্যাপক। তারা সমাজ পরিবর্তনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেন, পরিত্যক্ত চুইংগাম বিশ্লেষণ করেন। ঐতিহাসিক দার্শনিক নাট্যকর্মী, রাজনীতিবিদ বিভিন্ন ধরনের মানুষ এই প্রতীকী উপন্যাসটিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
গাম ওয়াল
আমেরিকার সিয়াটলে পাইক প্লেস মার্কেটের বিখ্যাত ইটের দেয়াল, মার্কেট থিয়েটার গাম ওয়াল এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ৫০ ফুট দীর্ঘ এবং ১৫ ফুট উঁচু মার্কেট থিয়েটারের বক্স অফিসের দেয়ালে পরিত্যক্ত হতে যাচ্ছে, মুখের এমন চুইংগাম লাগানো শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। দেয়াল ভরে ওঠে। চুইংগাম মুখে মানুষ এখানেই ছুটে আসে। ট্যুরিস্টদের আকর্ষণও বাড়তে থাকে- এটি হয়ে ওঠে রোগজীবাণুযুক্ত আমেরিকার শ্রেষ্ঠ পাঁচটি পর্যটন স্থানের একটি, কোনো কোনো শিল্পী দেয়ালে কিছু চিত্রকর্মও করেছেন। স্টিমওয়াশ করে দেয়ালের আবর্জনা ওঠাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে পর্যটক ও তরুণেরা অসন্তুষ্ট হন এবং প্রতিবাদ জানান। সব উপেক্ষা করে ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর পাইক মার্কেট প্রিজারভেশন ও ডেভলপমেন্ট অথরিটি বিপুলসংখ্যক পুলিশ প্রহরায় ১৩০ ঘণ্টায় দেয়াল পরিষ্কার করে। দেয়াল থেকে একটনেরও বেশি (২৩৫০ পাউন্ড) চুইংগাম অপসারণ করা হয়। ১৩ নভেম্বর ২০১৫ দেয়াল পরিষ্কার করার কাজ শেষ হবার সাথে সাথেই আবার চুইংগাম লাগানো শুরু হয়েছে। অগত্যা কর্তৃপক্ষ নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছে।
সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ চুইংগাম
লি কুয়ান ইউ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তিনি যখন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, জাতীয় উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী তাঁর কাছে একটি প্রস্তাব পাঠালেন যেন চুইংগাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ, দুষ্টলোকরা খাবার পর চুইংগাম যেখানে-সেখানে ফেলে অথবা পরিকল্পিতভাবে ক্ষতির উদ্দেশ্যে সরকারে বহুমূল্যসুউচ্চ হাউজিং অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষতি সাধন করছে, দরজায় চাবির ছিদ্রপথে ঢোকাচ্ছে, মেইলবক্সে ফেলছে, লিফট বাটনে ঠেসে দিচ্ছে। যেখানে-সেখানে ফেলাতে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। গণপরিবহণে সিটের ওপরও তারা চুইংগাম লাগিয়ে আসছে। লি কুয়ান চুইংগাম নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব সম্মতি দিলেন না।
১৯৮৭ সালে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের রেলওয়ে মাস র্যাপিড ট্রানজিট চালু হলে দুষ্কৃতকারীরা বগির সংবেদনশীল দরজায় সেন্সরের ওপর তা লাগাতে শুরু করল। ফলে মেরামত ব্যয় আরও বেড়ে গেল। ১৯৯২-এর জানুয়ারিতে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক টং সিঙ্গাপুরে চুইংগাম উৎপাদন আমদানি ও বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। তাৎক্ষণিকভাবে আমদানি বন্ধ হলো। দোকানিদের মজুত বিক্রি শেষ করার জন্য কিছুটা সময় দেওয়া হলো: আর বিক্রেতার বেলায় ২০০০ ডলার জরিমানা এবং আমদানিকারক ও সরবরাহকারীর বেলায় জরিমানা ও কারাবাস উভয় ধার্য হলো।
শুরুতে প্রতিক্রিয়া হলো। সীমান্তবর্তী মালয়েশিয়ার জোহর বারু থেকে যারা চোরাচালানি করে চুইংগাম আনত, ধরা পড়ার পর তাদের নামধাম বিস্তারিত পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশের বন্দোবস্ত করায় তা একধরনের সামাজিক বহিষ্কার হিসেবে বিবেচিত হলো। আইনের কঠোর প্রয়োগের কারণে চোরাচালানি বন্ধ হলো। তবে পরবর্তী সময়ে দন্ত চিকিৎসার প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষেত্রে সীমিত আমদানি অনুমোদন করা হয়। পশ্চিমের গণমাধ্যম এই নিষেধাজ্ঞাকে ড্রাকোনিয়ান আখ্যা দিয়েছে এবং তা সিঙ্গাপুরবাসীর সৃজনশীলতা সংকুচিত করবে বলে মন্তব্য করেছে।
এর মধ্যে পৃথিবীর কয়েকটি দেশে নিক্ষিপ্ত চুইংগাম সংগ্রহ করে তা রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে রাবার পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে।
চুইংগামের সূত্র ধরে তরুণীর ডিএনএ
বিজ্ঞানীরা তরুণীর নাম দিয়েছেন লোলা। ৫৭০০ বছর আগে বাল্টিক সাগরের একটি দ্বীপে বাস করত সে। সময়টা খ্রিষ্টজন্মের ৩৭০০ বছর আগে। মেয়েটি দুগ্ধ বা দুগ্ধজাত খাবার হজম করতে পারত না, তার দাঁতের মাড়িতে সমস্যা ছিল। সে তখন হাঁসজাতীয় কোনো পাখির মাংস খেয়েছে আর বাদাম। গায়ের রং এবং চুলের রং কালো, কিন্তু চোখ নীল। লোলাগাছের জমাট রস অনেকক্ষণ ধরে চিবিয়ে তা থু করে ছুড়ে ফেলেছে। ৫৭০০ বছর আগের এমন একটি চিবানো টুকরা তখনকার চুইংগামের বেশ ধরে বিজ্ঞানীরা এগিয়েছেন এবং লোলার জিনোম ডিকোডিং করেছেন।
একটি উদ্ধৃতি দিয়ে চুইংগামনামার সমাপ্তি টানি:
আমি চুইংগাম ঘৃণা করি,
আমাকে চুইংগামের মতো ব্যবহার করা হয়েছে।