যদি ফেসবুক মৃত ব্যক্তির ডিজিটাল গোরস্থান হয়ে যায়
'চলে যাচ্ছি দোস্ত, একদম নেটওয়ার্কের বাইরে!' সেই নেটওয়ার্কের বাইরে যাওয়ার পর আর ফেরা হয়নি। পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন সাব্বির হাসান। ফেসবুকের সেই স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়েছিল মুহূর্তের মধ্যেই। আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করা ব্যক্তির সংখ্যাও একেবারে হাতেগোনা নয়। দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, রোগ কিংবা স্বাভাবিক মৃত্যু, প্রতিদিনই ফেসবুক হারাচ্ছে অসংখ্য জীবিত অ্যাকাউন্টধারীকে। তবে এখনো ফেসবুক ডিজিটাল গোরস্থানে পরিণত না হওয়ার কারণ, ফেসবুকের অ্যাকাউন্টধারীদের অধিকাংশই তরুণ।
এমন একসময় আসবে যখন ফেসবুকে মৃত ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে জীবিত ব্যবহারকারীদের তুলনায়। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ফেসবুকের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সংযোগ। সাধারণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে উন্মুক্ত হওয়ার পরও দীর্ঘদিন এর মূল ব্যবহারকারী ছিল তরুণেরাই। তবে তরুণেরা ধীরে ধীরে মধ্যবয়সের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় এবং সব বয়সের মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হওয়ায় গত কয়েক বছরে ব্যবহারকারীদের গড় বয়সও বেড়েছে খানিকটা, যদিও এখনো বয়স্কদের তুলনায় তরুণদের মধ্যেই ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বেশি।
অতীত
ফেসবুকের ওয়েবসাইট গ্রোথের হার এবং বয়সের পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায়, ১ কোটি থেকে ২ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। এবং এই মৃত ব্যক্তিরা কেবল বয়স্করাই নয়, সব বয়সের মানুষেরাই আছেন। ষাটোর্ধ্বদের তুলনায় তরুণদের মৃত্যুর হার কম হলেও ফেসবুকের মৃত অ্যাকাউন্টধারীদের মধ্যে এক বিশাল অংশ এই তারা। কারণ, ফেসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে তাদের অনুপাতটিই যে সবচেয়ে বেশি।
ভবিষ্যৎ
২০১৩ সালে প্রায় ২ লক্ষ ৯০ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে সে সংখ্যা কয়েক লক্ষ। বর্তমানে এ সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ এবং আরও ৮ বছর পর এ সংখ্যা আরও ২ গুণ বাড়বে। যদি এই মুহূর্তে ফেসবুক তাদের রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করে দেয়, তবুও এই মৃতের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। কারণ, ফেসবুকে যুক্ত হওয়া ব্যবহারকারীদের বয়স বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এখন ফেসবুকে মৃত ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্ট সংখ্যা বেশি হবে নাকি জীবিত ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্ট, তা নির্ভর করছে ফেসবুক ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্মকে কতটুকু নিজেদের দিকে টানতে পারবে সেদিকে।
ফেসবুক ২১০০
আধুনিক প্রযুক্তির হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখনো নতুন, আবার অন্য হিসেবে অনেক পুরোনো কারণ প্রযুক্তি দুনিয়া প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। তবুও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পরিণতি বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এখনো প্রযুক্তিবিদরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় অনেক প্রভাবশালী ওয়েবসাইটই কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ ওয়েবসাইটই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হওয়ার পর একসময় একজায়গায় স্থির হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। ফেসবুকও কত দিন তাদের এ জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারবে, তা বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে মানসিক রোগ বৃদ্ধি, ফিল্টার বাবল তৈরি করে হানাহানি বৃদ্ধি, ধর্মীয় ঘৃণা, ফেক নিউজ ছড়ানোসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ফলে অন্যান্য ওয়েবসাইটের মতো ফেসবুকেরও যে একই রকম পরিণতি হবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
এ অবস্থায় যদি ধরা হয়, ফেসবুকেরও অন্য ওয়েবসাইটের মতো পরিণতি হবে এবং এই দশকের শেষে শেয়ারমার্কেটে দর হারানোর পর আর কখনোই তাদের হারানো গৌরব ফেরত পাবে না, সে হিসাবে ধারণা করা যায়, ২০৬৫ সালের আশপাশে জীবিত অ্যাকাউন্টের তুলনায় ফেসবুকে মৃত ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্ট সংখ্যা বেশি হবে।
অন্যদিকে ফেসবুক যদি তাদের গবেষণা বাড়িয়ে কীভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে টিকিয়ে রাখতে পারে, তবে মৃত ও জীবিত ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্টের অনুপাত সমান হতে সময় লাগবে দ্বাবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।
তবে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। কারণ, কম্পিউটার প্রযুক্তিতে যেকোনো সময়েই উত্থান-পতন হতে পারে। আজ থেকে ১০ বছর আগেও যাকে মনে হতো এই প্রযুক্তি ছাড়া সবকিছু অচল, তা কয়েক বছর না ঘুরতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। ইয়াহু, মাইস্পেসের মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান এর উদাহরণ। তবে কবে এই দুটির অনুপাত সমান হবে? সেটি জানতে হলে আমাদের অপেক্ষা ছাড়া অন্য কিছু করার নেই।
আমাদের অ্যাকাউন্টের পরিণতি কী হবে?
আমাদের সকল তথ্য অনির্দিষ্টকালের জন্য সংরক্ষণ করার মতো সক্ষমতা ফেসবুকের আছে। বিশেষ করে মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট নতুন কোনো তথ্য উৎপাদন না করায় তা নিয়ে আলাদা করে ভাবতেও হয় না ফেসবুককে, বরং জীবিত ব্যবহারকারীদের নতুন তথ্যগুলো ধারণ করা নিয়েই তাদের মাথাব্যথার কারণ। যদিওবা কখনো মৃত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট বেশি হয়ে যায়, তারপরও তাদের অবকাঠামো ব্যয়ের সামান্য অংশ খরচ হবে এর পেছনে।
তারচেয়েও বড় ব্যাপার এই তথ্যগুলোর কী হবে? কেউ যদি তাদের তথ্য মুছে না ফেলার অনুরোধ না করে, তবে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যায়, ফেসবুক তা সংরক্ষণ করে রাখবে। বর্তমানে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন তার অ্যাকাউন্টকে 'মেমোরিয়াল পেজ'-এ পরিণত করতে পারে। কিন্তু এর ফলে নানা নীতিগত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়: অ্যাকাউন্টগুলোতে কি অন্য কাউকে ঢুকতে দেওয়া উচিত? কারণ, তাতে একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য থাকতে পারে? যদি করাও হয়, কোন কোন বিষয়গুলো ঢোকা থেকে বিরত রাখা যায়? মেমোরিয়াল পেজগুলোতে কি মন্তব্য করার সুযোগ থাকা উচিত? যদি থাকে তবে কীভাবে ট্রল এবং হেট স্পিচ থেকে এগুলো মুক্ত রাখা যাবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কেবল ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মাধ্যমেই বের করার সুযোগ আমাদের হাতে রয়েছে। মৃত্যু সব সমাজের ক্ষেত্রেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সাথে কঠিন ও আবেগের সাথে জড়িত। একেক সমাজ একেকভাবে মৃত্যুকে দেখে থাকে। প্রযুক্তির সাথে সাথে আমাদের জীবনও সেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, নতুন প্রযুক্তির সাথে সমাজ নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে আচরণ করতে হয়, কীভাবে একজনের সাথে পরিচয় হতে হয়, সবকিছুরই একটি মানদণ্ড কয়েক বছরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গেছে। কীভাবে শোক জানাতে হয়, তারও একটি মানদণ্ড দাঁড়িয়ে যাবে, প্রয়োজন শুধু অপেক্ষার।