বলিউডে জিন্স
জিন্স ছাড়া বলিউডের কোনো সিনেমার কথা যেন কল্পনাই করা যায় না। অভিনেতারা তো পরেনই, এমনকি অভিনেত্রীরাও জিন্স ছাড়া হাজির হন না বলিউডের কোনো সিনেমায়।
বলিউড পাড়ায় জিন্সের এই উত্থান ১৯৮০-র দশকে। এর আগে এই ইন্ডাস্ট্রিতে ডেনিম জিন্সের এই রমরমা ছিল না। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকের কোনো ছবিতেই একটাও নীল জিন্স বা ডেনিম জ্যাকেটের দেখা পাওয়া যেত না।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে ভারতের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসতে থাকে। এই অর্থনৈতিক রূপান্তরের হাত ধরেই বলিউডি চলচ্চিত্রে প্রবেশ ঘটে ডেনিম ও জিন্সের। এরপর থেকে এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য জিন্স হয়ে উঠেছে শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো।
রুপালি পর্দায় জিন্স
একেবারে শুরু থেকেই কস্টিউম ছিল চলচ্চিত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। দর্শকদের চোখের প্রশান্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কস্টিউম।
হিন্দি চলচ্চিত্রের পুরুষ অভিনেতারা—নায়ক বা তারকার ও কিছু পার্শ্বচরিত্র—সিনেমায় ডেনিম জিন্স ও জ্যাকেট পরতে শুরু করেন সত্তরের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ। ওই দশকের শেষ দিক থেকে নারী তারকারাও এ পোশাক পরতে আরম্ভ করেন। যেহেতু দাম হাতের নাগালেই ছিল, তাই ভারতীয় মধ্যবিত্তদের কাছে এ পোশাক ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
জিন্স যখন প্রথম আবির্ভূত হয়, তখন এটি ছিল চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর নতুন পরিচয় ও সামাজিক গতিশীলতার প্রতীক। জিন্সের আগমনের সঙ্গেই বলিউডের মূলধারার চলচ্চিত্রে পরিবর্তন আসে। উত্থান ঘটে অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের। বলিউডের বদৌলতে জিন্স হয়ে ওঠে সমাজের নিচের স্তরের মানুষদের, অর্থাৎ সাব-অল্টার্নদের পোশাক।
স্যুট ও দর্জির হাতে বানানো পোশাক ছিল অভিজাতদের পোশাক। কিন্তু জিন্স একেবারেই সাধারণ মানুষের। কাজেই জিন্স হয়ে ওঠে অভিজাত বনাম সাব-অল্টার্নদের পার্থক্য ফুটিয়ে তোলার প্রতীক। নায়করা জিন্স পরতে আরম্ভ করলেও, সে সমাজের যেকোনো স্তরের প্রতিনিধিই হতে পারত। যেমন, ১৯৭৫ সালের সিনেমা 'শোলে'তে ধর্মেন্দ্রকে দেখা যায় ডেনিম ও জিন্স পরা এক নায়কের রূপে—সেই নায়ক ছিঁচকে অপরাধী থেকে পরিণত হয়েছিল আইকনিক হিরোতে।
পুরুষদের জন্য জিন্স ছিল স্রেফ নতুন স্টাইলের পোশাক। তবে বলিউডের নারী অভিনেত্রীদের জন্য জিন্স হয়ে ওঠে ভারতীয় স্টাইলের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন ও নতুন ধারার পোশাক। প্রথমদিকে নারীদের প্রকাশ্যে জিন্স পরে ঘুরে বেড়ানোকে ভালো চোখে দেখা হতো না। নারীদের জিন্স পরার প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে অনেকটা সময় লেগে যায়। প্রথমে সমাজের উচ্চবিত্ত নারীদের জিন্স পরা নিয়ে সংস্কার দূর হয়। তবে সাধারণ স্তরের নারীদের জিন্স পরা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা থেকেই যায়।
বলিউডের সিনেমায় নারীদের জিন্স পরা নিয়ে ট্যাবু ভাঙার কাজ শুরু করেন পারভিন ববি ও জিনাত আমানের মতো নায়িকারা। সত্তর ও আশির দশকের সিনেমায় তারা ব্লাউজের সঙ্গে জিন্স পরতেন। তাদের এই কস্টিউম বাছাই প্রথাগত নায়িকার সংজ্ঞা ধীরে ধীরে বদলে দিতে থাকে। ফ্যাশনের জন্য অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন এই অভিনেত্রীরা। সাধারণ নারী-পুরুষের ফ্যাশন-আইকন হয়ে ওঠেন এই নায়িকারা। জিন্সের জনপ্রিয়তা এমনই তুঙ্গে ওঠে যে ১৯৯৮ সালে তামিল ভাষায় 'জিন্স' নামের একটি সিনেমাই বানিয়ে ফেলা হয়। সেই ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন ঐশ্বরিয়া রায়।
তবে একসময় ধারণা ছিল, সিনেমায় নায়িকাদের জিন্স পরিয়ে হাজির করা হয় তাদের যৌন আবেদনময়ী রূপে তুলে ধরার জন্য। এমনকি ২০০২ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের জিন্স পরা নিষিদ্ধও করে।
তবে এসব ওজর-আপত্তি জিন্সের জনপ্রিয়তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। নগরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের মধ্যে ক্রমেই জনপ্রিয় বেড়েছে এই পোশাকের।
বলিউডের সিনেমায় জিন্সকে কখনও কখনও সাংস্কৃতিক উপনিবেশ বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবেও দেখানো হয়েছে। মধুর ভান্ডারকরের সিনেমা 'ফ্যাশন'-এ উঠে এসেছে এই থিম।
জিন্সের ফেরিওয়ালা বলিউড
নারী তারকাদের পরনে জিন্স এখন সবার চোখ সওয়া হয়ে এসেছে। এটি সিনেমার কস্টিউমে জিন্সকে মেনে নেওয়ার প্রতীক।
তবে বলিউডের সিনেমায় এখন 'বিজ্ঞাপনে'র জন্য জিন্সকে ব্যবহার করা হচ্ছে সুকৌশলে। হিন্দি সিনেমার গান হয়ে উঠেছে পোশাক পণ্যের বিজ্ঞাপনের জায়গা। সঞ্জয় গাধভির সিনেমা 'ধুম ২'-এর শুরুর গানেই হৃত্বিক রোশনকে দেখা যায় রিপড জিন্স পরে নাচতে। ফারাহ খানের 'ওম শান্তি ওম' সিনেমায় 'দার্দ-এ-ডিস্কো' গানে শাহরুখ খানকে অন্তত চারটি জিন্স পরে নাচতে দেখা যায়। এই গানের আগেই শাহরুখ খানকে একটি সুইমিং পুল থেকে শুধু জিন্স পরা অবস্থায় উঠে আসতে দেখি আমরা।
পুরুষ অভিনেতাদের দিয়ে খালি গায়ে শুধু জিন্স পরিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রচারণা চালানো এখন বলিউডে নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। বলিউড তারকা জন আব্রাহাম জিন্স ব্র্যান্ড র্যাংলারের বিজ্ঞাপন করেছেন শুধু জিন্স পরে। আরেক তারকা অক্ষয় কুমার ২০০৮ লেভি-র জিন্সের প্রচারণায় অংশ নেওয়ার জন্য ১৫ লাখ মার্কিন ডলার পারিশ্রমিক নেন। এই বিজ্ঞাপনী প্রচারণার জন্য বিস্তর সমালোনার শিকারও হন এ তারকা।
এসব বিজ্ঞাপনে পুরুষ তারকাদের জিন্স পরিয়ে নারীদের কাছে আবেদনময় রূপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ জিন্সকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় যৌন-উত্তেজক পোশাক হিসেবে।
দেখা যাচ্ছে, বলিউড যে শুধু জিন্সকে কস্টিউমের অবিচ্ছেদ্য অংশই করে তুলেছে তা নয়—বরং এই ইন্ড্রাস্টি নিজেই নেমে পড়েছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জিন্স বিক্রিতে। শুধু কি জিন্স? জিন্সকে অনুষঙ্গ করে এই ইন্ডাস্ট্রি বিক্রি করছে যৌনাবেদন এবং সিনেমাও।
সত্তরের দশকে বলিউডে আবির্ভাব। এরপর মূলধারার হিন্দি সিনেমায় জিন্স নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে। এখন বলিউডের সিনেমায় নায়ক-নায়িকা উভয়েই দেদারসে জিন্স পরেন। সব ধরনের জিন্স পরা হয় এখন এই ইন্ডাস্ট্রিতে। জিন্স হয়ে উঠেছে বহু বলিউড কস্টিউম ডিজাইনারের আয়ের প্রধান উৎস।
ভারতে জিন্সকে আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলিউড। অভিনেতাদের শরীর দর্শকদের সামনে উপস্থাপনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে এই পোশাক। অভিনেতাদের সিনেমার সেট এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা, দুই জায়গাতেই সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে জিন্স, যা আর কোনো পোশাকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এভাবেই বলিউড হয়ে উঠেছে জিন্সের ফেরিওয়ালা।