ধোনিকে যেমন দেখেছেন মুশফিক-রুবেলরা
প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়ক, সেটাও আবার ভারতের। যারা গত কয়েক বছরে মাঠের লড়াইয়ে রীতিমতো 'শত্রুতে' পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের কাছে। কিন্তু তাকে দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যেত ইমরুল কায়েস, রুবেল হোসেন, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, নুরুল হাসান সোহানদের। সুযোগ মিললেই 'মাহি ভাই' বলে ডেকে বুঝে নিতে চাইতেন ক্রিকেটের কৌশলগত নানা বিষয়।
সেই মাহি ভাই, মহেন্দ্র সিং ধোনি তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন। ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে দুটি ভিন্ন ফরম্যাটের বিশ্বকাপ ও একটি আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিজয়ী ধোনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়েছেন।
বিদায় লগ্নে বিশ্ব ক্রিকেটের অনেকেই ধোনির সঙ্গে কাটানো সময়ের কথা মনে করে স্মৃতির পাতা ওল্টাচ্ছেন। কেউ কেউ ধোনি স্তুতিতে মেতে আছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের চোখে ধোনি কেমন, কিংবদন্তি এই অধিনায়ককে কতটা চেনেন তারা, ফিনিশার ধোনিকে নিয়ে তাদের কী মত; এসব জানতে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
মুশফিকুর রহিম
ধোনির অধিনায়কত্ব আমার ভালো লাগে। কারণ সর্বকালের সেরা অধিনায়কের মধ্যে তার নাম থাকবে বলে আমি মনে করি। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় অনেক ভালো, আগে থেকে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে সে। তার ক্রিকেটিং সেন্সও অনেক ভালো। তার জয়ের গড়, পরিসংখ্যান অনেক ভালো।
এমন কোনো বড় টুর্নামেন্ট নেই, সে জেতেনি। সে আমার ভালো লাগার অধিনায়ক। ধোনিকে আমার আদর্শ বলতে পারেন। আমি মনে করি বিশ্ব ক্রিকেটে অন্যান্য অধিনায়কদের জন্য সে আদর্শ। সে জীবন্ত কিংবদন্তি, সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন। ক্রিকেট বিশ্ব ধোনিকে মিস করবে।
রুবেল হোসেন
ভারতের মতো দলকে তিনি দীর্ঘদিন পথ দেখিয়েছেন। যেকোনো অবস্থায় ঠান্ডা মেজাজে থাকার কারণে উনার নামই হয়ে যায় মি. কুল। সব সময় শান্ত থাকতেন মাঠে। আমি যতটুকু দেখেছি, উনি খুবই ভদ্র মানুষ। হোটেল লবিতেও উনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। উনাদের মতো কিংবদন্তি ক্রিকেটার যখন অবসরে যান, তখন খারাপ লাগে। তবে অবসর তো নিতেই হবে।
সম্মানের সঙ্গে উনি অবসর নিয়েছেন, এটা দেখে ভালো লেগেছে। তাকে দেখে তরুণ প্রজন্ম অনেক অনুপ্রাণিত হবে। উনি এমনই একজন ক্রিকেটার। তাকে অবশ্যই মিস করব। শুধু ক্রিকেটার হিসেবে নয়, ভক্তের মতো করেই ধোনির খেলা মিস করব। মাঠে উইকেটের পেছনে থাকতেন বা ব্যাটিং করতেন, অনেক স্মৃতিই আছে। এসব মিস করব।
ইমরুল কায়েস
ধোনিকে খুবই ভালো লাগে আমার। সে সেরা। তার সঙ্গে হয়তো আমার খুব বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি, কিন্তু যে কয়টা ম্যাচ খেলেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে সে খুবই উন্নতমানের ক্রিকেটার। এত বুদ্ধিদীপ্ত ক্রিকেটার আমি আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। মাঠে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে আরও যে অন্যান্য বিষয় থাকতো, তিনি দারুণ দক্ষতার সঙ্গে সব পালন করতেন।
তিনি মাঠে সব সময়ই ঠান্ডা মেজাজে থাকতেন। নিপাট একজন ভদ্রলোক। আমার খুবই পছন্দের ক্রিকেটার ধোনি। অবশ্যই ধোনিকে মিস করব। কারণ এমন খেলোয়াড় যুগে যুগে দুই-একজন আসে। এমন একজন ক্রিকেটারের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার থাকে। ভারত দলের অনেকই শিখতো আবার আমরা বাইরে থেকেও শিখতাম। বিশ্ব ক্রিকেট তাকে অবশ্যই মিস করবে।
নুরুল হাসান সোহান
ধোনি আমার অনেক পছন্দের ক্রিকেটার। আমি আশা করেছিলাম হয়তো আরও কিছুদিন খেলবেন। ভাবিনি এমন হঠাৎ করেই নিয়ে নেবেন অবসর। আমার কাছে মনে হয় উনি ক্রিকেটকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। উনার মতো করে সাজিয়েছেন। কারণ আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, কিপিংয়ে বেসিক লাগবে, এটা লাগবে-ওটা লাগবে। কিন্তু কিংপিংয়ের বেসিকটা নতুন করে তৈরি করেছেন ধোনি।
ব্যাটিংয়ে উনি অসাধারণ করেছেন, দারুণ ফিনিশার। কিন্তু আমি উইকেটকিপিং নিয়ে বলতে চাই। উনার সঙ্গে কিপিং নিয়ে আমার কথা হয়েছিল। উনি বলেছিলেন কমফোর্টেবল জোনের (যার যার পছন্দ বা আরামদায়ক ব্যাপার) কথা। যার যেটায় ভালো লাগে, সেটা করতে। কিন্তু আমরা আগে দেখতাম অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ওরা কীভাবে বেসিক তৈরি করে। ধোনি এটা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছেন। এশিয়ায় কেমন কিপিং করতে হবে, সেই আরামের জায়গা উনি বের করে দিয়েছেন। প্র্যাকটিক্যালি উনার কাছ থেকে বড় শিক্ষা পেয়েছি আমরা।
এশিয়া এবং এশিয়ার বাইরের অবস্থা কিন্তু পুরোপুরি ভিন্ন। কিপিংয়েও তাই ভিন্নতা থাকে। যে কারণে যখন যেখানে যেটা দরকার, সেটা করতেন তিনি। ইংল্যান্ডে উনি বেসিক পরিবর্তন করে অন্যভাবে কিপিং করতেন। আমার কাছে মনে হয় এই ব্যাপারটা এভাবে কেউ কখনও চিন্তা করেনি। আমরা এক বেসিকেই কাজ করতাম সব সময়। উনি এটা পরিবর্তন করেছেন এবং নতুন করে চিন্তা করার সুযোগ তৈরি করেছেন যে, যার যার আরামের জায়গা থেকে চেষ্টা করে শক্তিশালী হওয়া যায়।
ধোনিকে অবশ্যই মিস করব। কারণ উনার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সবাই সবার প্রতিপক্ষ, কিন্তু সবার কাছ থেকেই শেখা যায়। ধোনির কাছ থেকে অনেক বেশি শেখা সম্ভব। যেটা আগে বললাম ক্রিকেটকে অন্য একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন ধোনি। তার মতো অধিনায়ক, উইকেটরক্ষক, ফিনিশার; এক সঙ্গে এমন প্যাকেজ হয় না। বিশ্ব ক্রিকেট অবশ্যই তাকে মিস করবে।
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন
ধোনির সম্পর্কে বলতে গেলে আজ দিন-রাত মিলিয়ে বলেও শেষ করা যাবে না। কোনো সন্দেহ নেই উনি সেরা অধিনায়ক, সেরা নেতা, সেরা ফিনিশার। ভারত দলের সাফল্যের অন্যতম কারণ তিনি। আইসিসির তিনটি ট্রফি উনি জিতিয়েছেন। ২০০৭ সালে ধোনি যখন অধিনায়ক হিসেবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতেন, তখন আমরা অনেক ছোট। টিভিতে খেলা দেখেছি।
ফাইনালেরে শেষ ওভারে যোগীন্দর শর্মাকে যেভাবে প্রতি বলে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন, তখন থেকেই তার প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা কাজ করতে শুরু করে। যেটা এখনও আছে। কাল হঠাৎ তার অবসরের ঘোষণায় কিছুটা খারাপই লেগেছে। কারণ শচিন টেন্ডুলকারের পর কেউ যদি বড় করে সংবর্ধনা পাওয়ার দাবিদার হয়ে থাকেন, তিনি ধোনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা হয়নি। আমি দর্শক সারিতে গিয়ে বলতে চাই, ধোনি মাঠ থেকে বিদায় নিতে পারলে ভালো লাগতো।
ধোনিকে অবশ্যই মিস করব। কিন্তু বাস্তবতাকেও মেনে নিতে হবে। কারণ সবাইকেই অবসর নিতে হয়। রিকি পন্টিং, গিলক্রিষ্ট, সাঙ্গাকারা, জয়াবর্ধনে, শচিন, দ্রাবিড়, লারা; সব কিংবদন্তিকেই অবসর নিতে হয়েছে। তারপরও অধিনায়ক, নেতা, উইকেটরক্ষক, ফিনিশার ধোনিকে ভারত দল অবশ্যই মিস করবে বলে আমার বিশ্বাস।