ফিরেই অধিনায়কত্ব পাবেন সাকিব?
অপেক্ষার প্রহর সব সময়ই দীর্ঘ হয়, কাটতেই চায় না। সাকিব আল হাসানের অপেক্ষা আরও বিষাদী, আরও যন্ত্রণার। প্রাণ ভোমরা হয়েও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল থেকে কতো দূরে বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার! চোখের সামনেই দলের হাসি-কান্নার চিত্রনাট্য মঞ্চায়িত হয়, যেটার অংশ সাকিব নন। মাঠে গিয়ে খেলা দেখবেন, সেটাতেও বিরাট বিপত্তি।
আইসিসির নিষেধাজ্ঞার কারণে দল, ক্রিকেট, চেনা ভুবন; সব কিছু ছেড়ে দূরে সরে যেতে হয়েছে সাকিবকে। জুয়ারির প্রস্তাব গোপন করায় গত বছরের অক্টোবর থেকে অভিশপ্ত এক অধ্যায়ে ঠিকানা হয় তার। যে অধ্যায়ের শেষ হতে আর দেড় মাসের মতো বাকি। আগামী ২৯ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত হবেন দেশসেরা এই অলরাউন্ডার। আবারও তিনি ফিরবেন চিরচেনা সবুজ গালিচার বুকে।
সব কিছু প্রস্তুতই আছে সাকিবের জন্য। নিষেধাজ্ঞা ফুরানোর কয়েকদিন পরই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার সুযোগ হতে যাচ্ছে তার। কোয়ারেন্টিন জটিলতায় অনিশ্চয়তায় পড়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা সফর শেষ পর্যন্ত হলে দ্বিতীয় টেস্ট থেকেই বাংলাদেশ শিবিরে দেখা যাবে সাকিবকে। দলে ফিরতে সাকিব যেমন একটি একটি করে মুহূর্ত গুনছেন, তেমনি তার অপেক্ষায় বাংলাদেশ দলও।
নিষেধাজ্ঞায় থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কোনো সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন না সাকিব। যে কারণে নিজেকে প্রস্তুত করতে শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা বিকেএসপিকে বেছে নিয়েছেন তিনি। গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে শৈশবের দুই কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম ও মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে অনুশীলন শুরু করেছেন সাকিব।
যতই তার দলে ফেরার সময় ঘনিয়ে আসছে, একটি আলোচনা, একটি প্রশ্ন ততোই বেগবান হচ্ছে। দলে ফিরেই অধিনায়কত্ব পাবেন সাকিব? এই প্রশ্নের উত্তর এখনই মিলছে না। এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলার দায়িত্বটি বিসিবির কোনো কর্তাই নিচ্ছেন না। তবে গুঞ্জন আছে, আপাতত সাকিবকে অধিনায়কত্ব দেওয়া নিয়ে ভাবছে না বিসিবি।
তার হারানো রাজ্য টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির নেতৃত্বভার তার কাছেই ফিরবে, তবে সেটা নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর। আবার এমনও শোনা গেছে, অধিনায়কত্ব ফিরে পেতে বেশি সময় নাও লাগতে পারে তার। ওয়ানডেতে তামিম ইকবালই থাকবেন অদিনায়ক। বাকি দুই ফরম্যাট টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে সাকিবকে অধিনায়কত্বে ফেরানো হবে।
অধিনায়ক সাকিবের মেধা, কৌশল, চুতরতা নিয়ে কারও মনেই প্রশ্ন নেই। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা শেষে দলে সুযোগ পেয়েই কেউ অধিনায়কত্ব ফিরে পেয়েছেন, বিশ্ব ক্রিকেটে এমন নজির নেই বললেই চলে। আদৌ এমন হয়েছে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন। তাই সাকিব যদি বাংলাদেশ দলে ফিরেই অধিনায়কত্ব পান, সেটা হবে ক্রিকেট ইতিহাসের বিরল এক ঘটনা।
সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে স্টিভেন স্মিথের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বল টেম্পারিংয়ের দায়ে নিষিদ্ধ হওয়া অস্ট্রেলিয়ার এই ব্যাটসম্যান ক্রিকেটে ফিরেছেন অনেকদিন হলো। কিন্তু এখনও ফিরে পাননি অধিনায়কত্ব। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাকে এক বছর খেলায় ও দুই বছর অধিনায়কত্বে নিষিদ্ধ করেন। কোনো নিষেধাজ্ঞাই আর নেই তার ওপর। তবু অধিনায়কত্বে ফেরা হয়নি স্মিথের।
নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে আসা একজন ক্রিকেটারকে খুব দ্রুতই অধিনায়কত্ব দেওয়ার বিপক্ষে অনেকেই। এই অনেকের তালিকায় আছেন বাংলাদেশের দুজন সাবেক অধিনায়কও। সাকিবের অধিনায়কত্ব নিয়ে তাদের প্রশ্ন না থাকলেও তারা চান না ফিরেই সাকিব নেতৃত্বভার পাক। দলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর, হারিয়ে ফেলা বিশ্বাস অর্জন করার পর দল যদি তাকে অধিনায়ক করতে চায়, তবেই তাকে অধিনায়ক হিসেবে দেখতে চান তারা।
বাংলাদেশের সাবেক এক অধিনায়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'তাকে কিন্তু বিসিবি নিষিদ্ধ করেনি। তাকে নিষিদ্ধ করেছে আইসিসি। এর মাঝে যদি কাউকে অধিনায়ক করা হয়, তাকে নিশ্চয়ই বলা হয়নি তুমি খন্ডকালীন অধিনায়ক। কিংবা সাকিব এলে তুমি অধিনায়কত্বে থাকবে না। এটা কিন্তু পরিষ্কার করেনি বিসিবি। পরিষ্কার না করে তাকে বাদ দিলে সেটা অবিচার হবে।'
টেস্টে মুমিনুলের ওপরই ভরসা রাখার কথা বলছেন তিনি, 'মুমিনুলকে যেহেতু অধিনায়ক করা হয়েছে, তাকে বাদ দেওয়া উচিত হবে না। সাকিব এসেছে বলে সে বাদ, এটা তো আরও হওয়া উচিত নয়। পারফরম্যান্সের কারণে হিসাব করলে সেটা ভিন্ন কথা। কারণ ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে মুমিনুলের নেতৃত্বে খারাপ খেলেছে। তবু হিসাব অনুযায়ী সাকিবকে অধিনায়কত্ব দেওয়া উচিত নয়।'
'আইসিসি তাকে নিষিদ্ধ করেছে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা গুরুতরও। তাকে আবার প্রমাণ করে আসতে হবে। এটাই প্রক্রিয়া হওয়ার উচিত। ক্রিকেট বোর্ড যদি মনে করে, সে ছিল অধিনায়ক এখনও সেই হবে। তাহলে সেটা বোর্ডের ব্যাপার। এটা বোর্ডের কল। কিন্তু নীতিগত জায়গার দিক থেকে এটা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়।' যোগ করেন তিনি।
সাকিবের শাস্তি যে বাড়াবাড়ি নয়, সেটা যেন দেশের ক্রিকেট ভক্তদের মনে করিয়ে দিতে চাইলেন তিনি, 'একজন ক্রিকেটারকে কখন নিষিদ্ধ করা হয়! সে ফিক্সিং করুক আর না করুক, আইসিসির আইন ভঙ্গ করেছে। যখন কেউ আইন ভঙ্গ করে, তখন সে দোষী। দোষী না হলে তো তাকে নিষিদ্ধ করতো না। অনেকে বলতে পারে সে তো ফিক্সিং করেনি। কিন্তু প্রস্তাব পেয়ে না বলাও তো শাস্তির কাজ।'
এই ঘটনায় দলীয় বিশ্বাসে আচড় পড়েছে বলে মনে করেন তিনি। সাবেক এই অধিনায়ক বলেন, 'বিশ্বাসের জায়গাটা নষ্ট হয়েছে। সে না থাকায় দলের ক্ষতি হয়েছে। তার জায়গায় দুজন খেলোয়াড় দরকার হয়। একজন ব্যাটসম্যান, একজন বোলার লাগে। তার পেছনে ইনভেস্ট করেছে জাতীয় দল। সে তো আর আবাহনী বা কোনো ক্লাবে খেলে চলে আসেনি। অধিনায়ক একটা বড় ভরসার জায়গা। এখন তাকে অধিনায়ক করা হলে অন্যরা সেই ভরসা পাবে কিনা, বলা কঠিন। তো তার জন্য যেহেতু ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতির ঝুঁকিটা বিসিবির জন্য না নেয়াই ভালো।'
আরেক সাবেক অধিনায়ক প্রক্রিয়ার কথা জানালেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বললেন, 'সাকিবকে এখন অধিনায়ক করা হলে আপনি অন্যদেরকে কী বার্তা দিলেন? অধিনায়ক তৈরি করতে হয় একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সাকিব কতো বড় অধিনায়ক, সে আলোচনা পরে। কিন্তু সে তো একদিনেই এমন অধিনায়ক হয়নি। তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।'
'একইভাবে যারা এখন আছে, তাদেরও সুযোগ দিতে হবে। তাদেরকে হুট করে বাদ দিলে সেটা হবে অনৈতিক। এ ছাড়া সাকিবকে ভরসা অর্জন করতে হবে। অন্যদের মনে অবিশ্বাস জন্ম নিতেই পারে। এত সিনিয়র ক্রিকেটার যখন এমন ভুল করে, সেখানে অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। সেদিক থেকে আমি বলব সাকিব আমাদের বড় খেলোয়াড়, তাকে ফেরানো হোক। কিন্তু অধিনায়কত্বে নয়। সময় হলে তাকে আবার অধিনায়ক বানানো যাবে।' যোগ করেন তিনি।
সাবেক দুই অধিনায়কই ভরসার জায়গা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। জাতীয় দলের এক ক্রিকেটারকে তাই বিশ্বাসের জায়গাটি নিয়েই প্রশ্ন করা হলো। এই ক্রিকেটারও বিশ্বাস ভঙ্গের জায়গাটি নিয়ে শঙ্কিত। তার ভাষায়, 'সে আমাদের দলের সবচেয়ে বড় তারকা। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি, ক্রিকেটারদের মধ্যে অবিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়েছে। সে নিজেকে শুধরেই ফিরবে। কিন্তু পুরনো ঘটনা অন্যদের মন থেকে আপনি মুছে দিতে পারবেন না।'
পরিসংখ্যানে সাকিব বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। রেকর্ড তার পক্ষেই রায় দেবে। ১৪ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে তিনটি ম্যাচে বাংলাদেশকে জিতিয়েছেন তিনি। অধিনায়ক হিসেবে তার জয়ের গড় ২১.৪২। সাকিবের জয়ে বেশি গড় কেবল মুমিনুল হকের, ২৫.০০ (৪ ম্যাচে একটিতে জয়)।
ওয়ানডেতেও সফল বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার। ৫০ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ২৩ ম্যাচে জয় (জয়ের গড় ৪৬.৯৩) নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন অধিনায়ক সাকিব। এই ফরম্যাটে তার চেয়ে সফল কেবল মাশরাফি বিন মুর্তজা (৮৮ ম্যাচে ৫০ জয়, গড় ৫৮.১৩)। টি-টোয়েন্টিতেও দারুণ নেতৃত্বে দলকে ঠিক পথেই রেখেছিলেন তিনি। ২১ ম্যাচে দলকে জিতিয়েছেন ৭টি ম্যাচে (জয়ের গড় ৩৩.৩৩)।
অনেকের চোখেই সাকিব অন্যতম সেরা অধিনায়ক। কারও কারও চোখে মাঠে তিনি মাশরাফি বিন মুর্তজার চেয়েও বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়ক। যে কারণেই টেস্ট ও টো-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব সাকিবের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। মাশরাফির অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর ওয়ানডেতেও নেতৃত্বভার পেতেন তিনি। দ্বিতীয়বারের মতো তিন ফরম্যাটেই অধিনায়ক হওয়ার খুব ছিলেন বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার। কিন্তু তখনই ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে চলে যান সাকিব।
অধিনায়ক সাকিব, তার পরিসংখ্যান, সফলতা; এ সবই তার পক্ষে। কিন্তু এসবও উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা জাগছে নিষেধাজ্ঞার ঘটনার কারণেই। দারুণ নেতৃত্বগুণ থাকার পরও শৃঙ্খলাজনিত কারণে অধিনায়ক হতে পারেননি কিংবা অধিনায়কের সফর বড় করতে পারেননি, বিশ্ব ক্রিকেটে এমন নজির অনেক আছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আফসোসের নাম শেন ওয়ার্ন। স্টিভ ওয়াহর অধিনায়ককালে অস্ট্রেলিয়ার পরবর্তী অধিনায়ক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বেশিরভাগ ক্রিকেটবোদ্ধা নাম নিতেন সাবেক এই লেগ স্পিনারের। কিন্তু শৃঙ্খলাজনিত (মাদক, নিয়ম ভঙ্গ করা) কারণে অধিনায়ক হয়ে উঠা হয়নি কিংবদন্তি ওয়ার্নের।
সাকিব নিশ্চয়ই ওয়ার্ন হবেন না। নিজেকে শুদ্ধ করে, আরও পরিণত হয়ে, নিয়ম মানার মানসিকতা প্রখর করেই ২২ গজে ফিরে আসবেন চ্যাম্পিয়ন এই ক্রিকেটার। তবে যে দাগ লেগে গেছে ক্যারিয়ারে, তা ঝেরে ফেলতে সময় দিতেই হবে সাকিবকে। বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে তাকে সেই সময় ফিরিয়ে আনতে হবে, যখন আর কেউ তার পেছনের কালো অধ্যায়ের কথা মনে করবেন না। তখন মাঠে কেবল সাকিব, সাকিব গর্জনই উঠবে।