লিটন দাসের সমস্যা কোথায়?
তার ব্যাটিং নিয়ে সতীর্থদের মুগ্ধতার শেষ নেই। কারও কারও বর্ণনায় তার একেকটি শট যেন শিল্পীর রং-তুলিতে আঁকা। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান তিনি। সামর্থ্য-দক্ষতা নিয়েও নেই কোনো প্রশ্ন। ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা বইয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন লিটন কুমার দাস। কিন্তু জাতীয় দলে কয়েক বছর সফরের পরও সেই লিটনই এখন নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে আছেন।
ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি কোনো কোনো ফরম্যাটে উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব সামলান তিনি। যদিও তার কাছে দলের একটাই চাওয়া; রান করা। এই কাজটাই করতে পারছেন না ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। গত বছর মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৭৬ রানের রেকর্ড গড়া ইনিংস খেলার পর লিটন যে নিজেকে হারিয়েছেন, আর ছন্দে ফিরতে পারেননি।
কেবল টেস্টে কিছু রান করেছেন, সেখানেও নেই বড় কোনো ইনিংস। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, কোনো আঙিনাতেই লিটনের ব্যাটে রান নেই। করোনাভাইরাসের বিরতির পর গত বছরের শেষ দিকে দুটি ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আয়োজন করে বিসিবি। একটিতেও ব্যাট হাতে শাসন করা হয়নি তার। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন লিটন।
গত জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিনটি ওয়ানডেতে ৩৬ রান করেন লিটন, সর্বোচ্চ ২২। এরপর নিউজিল্যান্ড সফরেও তার ব্যাট হাসেনি। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ৬ ম্যাচে মাত্র ৫০ রান করেন ডানহাতি এই ওপেনার। শ্রীলঙ্কা সফরেও ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী থেকে যান। ছয় নম্বরে ব্যাটিং করে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫০ রান করলেও পরের টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে তিনি করেন মাত্র ২৫ রান।
লিটনের ব্যর্থতার গল্প দীর্ঘই হয়ে চলছে। সর্বশেষ ৮ ওয়ানডের মধ্যে তার সর্বোচ্চ ইনিংস ২৫ রানের, মোট রান ১০১। এর মধ্যে তিনটি ইনিংসে রানের খাতাই খুলতে পারেননি। শেষ ৩ টি-টোয়েন্টিতে করেছেন ১০ রান। ধারাবাহিক এই ব্যর্থতার ফল ভালো হয়নি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ২ ওয়ানডেতে রান না পাওয়ায় তার ওপর আর ভরসা রাখা হয়নি। তার বদলে জায়গা দেওয়া হয় নাঈম শেখকে।
যাকে নিয়ে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, যাকে ভাবা হয় দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হওয়ার যোগ্য হিসেবে, সেই লিটন কোথায় হারালেন? সমস্যা ব্যাটিংয়ে নাকি মাথায়? সেটা হয়তো লিটনেরই সবচেয়ে ভালো জানার কথা। তবে এ নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিজেদের মত জানিয়েছেন বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিম, ওয়ানডের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা এবং সাবেক অধিনায়ক ও বিসিবির বর্তমান নির্বাচক হাবিবুল বাশার।
দীর্ঘদিন বিসিবির কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এবং বর্তমানে বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছে মনে হয়েছে, লিটনের সমস্যাটা মানসিক, আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি। সাকিব-তামিমদের এই কোচ মনে করেন, লিটনদের মতো প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের পরিচর্যা করার ধরনেও আছে সমস্যা।
পৌঢ় এই কোচ বলেন, 'আমার মনে হয় এই মুহূর্তে আত্মবিশ্বাসে ওর যথেষ্ট ঘাটতি আছে। পারফরম্যান্সে অধারাবাহিক থাকার কারণে হয়তো এটা হয়েছে। কারণ অনেক কিছুই হতে পারে। তবে আমার মনে হয়, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিই মূল কারণ। যদিও শুধু লিটন নয়, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিভাবান বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানেরই কিন্তু একই অবস্থা। লিটন, মিঠুন, সৌম্য বা শান্ত বা সাইফ; সবার একই অবস্থা।'
এর কারণ হিসেবে নাজমুল আবেদীন বলেন, 'আমার মনে হয়, গত কয়েক বছর ধরে ওদের গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া আমরা দেখেছি, সেখানে হয়তো কোনো সমস্যা আছে। একজন খেলোয়াড়ের মূল কিন্তু তার বেসিক। আমরা যদি তুলনা করি একজন মানুষের ব্যাংকে অনেক টাকা আছে, ভালো ফান্ড আছে, তার মানে এই না সে ব্যবসা করতে পারবে। ব্যবসা করতে আলাদা একটা জ্ঞান লাগবে। এসব ব্যাটসম্যানের সবার ফান্ড আছে, টেকনিক্যাল দিক থেকে তারা ভালো।'
'এ কারণে ১৯ পর্যায় থেকে তারা উঠে এসেছে। তারা জাতীয় দলে মাঝে মাঝে অসাধারণ কিছু ইনিংস খেলেছে। কিন্তু ওরা যখন ব্যবসা করতে গেল, কীভাবে ব্যবসা করতে হবে, সেখানে হয়তো তারা দ্বিধায়। একবার এই দ্বিধাটা আসার পরে তারা ব্যবসাটা ভালোভাবে করতে পারেনি। ব্যবসায় মানুষ ব্যর্থ হলে কী করে, এলোপাথারি অনেক কিছু চেষ্টা করে। ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে বেসিক ফান্ডামেন্টাল থেকে দূরে সরে যায়। বেসিক থেকে দূরে সরে গেলে আসল জিনিসটা হারানো শুরু হয়। এতে আত্মবিশ্বাস আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমার মনে হয় লিটন, সৌম্য, শান্তদের সাথে এটাই ঘটছে। তবে ওদের মধ্যে যে দ্বিধা, সেটা আমাদের প্রক্রিয়ার কারণেই তৈরি হয়েছে।' যোগ করেন তিনি।
এখান থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিলেন অভিজ্ঞ এই কোচ। নাজমুল আবেদীন বলেন, 'ওদের উচিত দুই-এক স্টেপ পিছিয়ে এসে ওখান থেকে আবার শুরু করা। কিন্তু আমরা সেটা দেখিনি। আমরা দেখেছি এলোমেলো চেষ্টা। অনেক সময় অ্যাপ্রোচ, খেলার স্টাইল চেঞ্জ করে ফেলছি। এতে যেটা হয় যেভাবে খেলে আমি এতদূর এসেছি, সেটা হারিয়ে যায়। যেটা আমি জানি না, চিনি না, সেটা করতে গেলে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।'
'ওদের বেসিক দেখা দরকার, পেছনে তাকানো দরকার। যখন ওরা ভালো খেলছিল, ভালো খেলার সহায়ক কী ছিল, চিন্তা-ভাবনা কেমন ছিল, সেটা ভেবে দেখা উচিত। সমস্যা সমাধানের সময় মাথা পরিষ্কার না থাকলে সমাধান করা খুব কঠিন। ওদের মাথা একেবারেই পরিষ্কার নয়। তাদের মাথা পরিস্কার করতে হবে, দেখতে হবে ওরা কোত্থেকে এসেছে এবং ফান্ডামেন্টালগুলো কী। এটা করলে হয়তো ওরা আবার সেই ছবিটা দেখতে পাবে, যেখান থেকে ওরা উঠে এসেছে। এটায় হয়তো সুবিধা হবে ওদের।'
বাংলাদেশের হয়ে ২৪ টেস্ট, ৪৪ ওয়ানডে ও ৩২টি টি-টোয়েন্টি খেলা লিটনের জাতীয় দলে অভিষেক ২০১৫ সালে। মাশরাফি বিন মুর্তজার অধিনায়কত্বে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ৫-৬ বছরে লিটনকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন মাশরাফি। ওয়ানডের সাবেক এই অধিনায়কেরও মনে হয়েছে, মানসিক বাধাই লিটনের প্রধান সমস্যা।
মাশরাফি বলেন, 'পারছে না কেন, সেটা বোধহয় ব্যাটিং কোচ ভালো বলতে পারবেন। তবে আমার মনে হয় মানসিক বাধা। এ ছাড়া শট সিলেকশন একটা কারণ হতে পারে। ওর স্টান্স দেখে মনে হচ্ছে, ও দুই ভূমিকায় আছে। একটা হচ্ছে সেইফ থাকা, আরেকটা হচ্ছে হুট করে মারবে। টেকনিক্যালি দিক থেকে কোচরা আরও ভালো বলতে পারবেন। আমার কাছে মনে হয় যে মানসিক সমস্যা বেশি।'
খারাপ সময় পেছনে ফেলতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্রিকা পড়া, সমালোচনা গ্রাহ্য করা; এসব বন্ধ করতে বলছেন মাশরাফি, 'ওর যদি এতো সমস্যা হয়, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া, পত্রিকা, মানুষের কথা থেকে দূরে সরে আসতে হবে। ওকেই পথ খুঁজতে হবে যে, কোনগুলো বাধা। খারাপ খেলছে, সমালোচনা হবেই। সমালোচনা প্রভাব ফেলছে নাকি সাহায্য করছে? আমার মনে হয় না সাহায্য করছে।'
'এসব খারাপ প্রভাব ফেলছে। তাহলে এসব কমাতে হবে। ওকে ওর ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ওকে ওর মতো করে লড়াই করতে হবে। দিন শেষে ২২ গজে ও কিন্তু একাই। কোচ কিছুই নয়। ওকে চিন্তা করতে হবে, আমার জন্য কী ঠিক। সেটাই করতে হবে। এ ছাড়া, আমি অন্য কিছু তো দেখছি না। যোগ করেন দেশের ওয়ানডের সফলতম অধিনায়ক।
ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী থাকলেও লিটনকেই খেলানোর পক্ষে মাশরাফি। তিনি বলেন, 'আমি লিটনের পক্ষে। এখনও আমি মনে করি যে, ওর ওপেন করা উচিৎ। সামর্থ্য অনুযায়ী আমার এখনও মনে হয় তারই খেলা উচিত। আহামরি কেউ কিছু করছেও না ওই জায়গায়। এ কারণে আমি সামর্থ্যের পক্ষে। যদি কেউ এসে আহামরি কিছু করে ফেলতো, বিকল্প নিয়ে ভাবতে বলতাম।'
অন্য পথের কথাও উল্লেখ করলেন মাশরাফি। লিটনকে বসিয়ে এই জায়গায় কাউকে তৈরি করতে চাইলে সেই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেন তিনি, 'লিটনকে সরিয়ে তার মতো খেলিয়ে অন্য কাউকে সময় দিয়ে তৈরি করার পরিকল্পনা থাকলে সেটা অন্য বিষয়। কাউকে সময় দিয়ে দিয়ে একটা জায়গায় সেট করার অবস্থায় বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেক দূর এগিয়েছে। এখন পারফরম্যান্স দরকার।'
নির্বাচক হিসেবে খেলোয়াড়দের খুব কাছ থেকে দেখে দল নির্বাচন করা হাবিবুল বাশারের কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে লিটনের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হয়েছে তার। সাবেক এই অধিনায়ক অবশ্য মানসিক কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন না। তার মতে করোনার দীর্ঘ বিরতির কারণে ছন্দ হারিয়েছেন লিটন।
হাবিবুল বাশার বলেন, 'মানসিক সমস্যা মনে হয় না। কোভিডের কারণে লম্বা গ্যাপ তৈরি হয়েছিল। ফর্মে ছিলো, এরপর লম্বা ব্রেক; এটার কারণে ওর হয়তো ফর্মে ফিরতে সমস্যা হচ্ছে। এ রকম না হলে হয়তো ওর এই সমস্যা হতো না। ও যে ধরনের ব্যাটিং করে, তাতে একটু ছন্দ লাগে। সেটা পেতে একটু সময় লাগছে।'
মাশরাফির মতো হাবিবুল বাশারও লিটনের ওপর আস্থা রাখতে চান, 'রান না পেলে বিরাট কোহলিরও সমস্যা হয়, মাঠে গিয়ে কাঁপে। লিটন টেস্টে কিন্তু রান করেছে। সাদা বলে করেনি। লাল বলে সে ভালো খেলছে। সে ক্ল্যাসিক ব্যাটসম্যান। ওর খেলা দেখতে ভালো লাগে। ও রান করলে তা দলের জন্য খুব ভালো। ওর প্রতি আমি আত্মবিশ্বাসী। আমার মনে হয় না ফিরে আসতে বেশি সময় নেবে সে।'
মানসিক বাধা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে দিক ভুলে বসেছেন লিটন। তবে এখানেই প্রতিভাবান এই ব্যাটসম্যানের শেষ দেখছেন না ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালও। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডের পর তামিম বলেছেন, 'আমার মনে হয় লিটন যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে। সে ৮-৯টা ম্যাচ খেলেছে। সে তার সামর্থ্য অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারেনি। তবে এটাই ওর জন্য শেষ নয়। আমরা জানি সে কতোটা ভালো খেলোয়াড়।'