‘মনে হয় নিজের জুতো বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে হেঁটে বেড়াই’
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/06/09/mash_press.jpg)
ক্রিকেটারদের জন্যই ক্রিকেট বোর্ড। বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নয়ন থেকে শুরু করে ক্রিকেটারদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কাজটি বিসিবির। কিন্তু এসব কাজ করতে গিয়ে ক্রিকেটারদের সঙ্গে বোর্ডের কোনো কোনো কর্মকর্তা এমন শারীরিক ভাষা দেখিয়ে থাকেন, যা স্বাভাবকিভাবে নিতে পারেন না কেউ-ই।
বিষয়টি নিয়ে সাবেক ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা এতটাই বিরক্ত যে, হতাশা-আক্ষেপে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, 'মনে হয় নিজের জুতো বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে হেঁটে বেড়াই।'
শুধু এই বিষয়টিই নয়, প্রেসিডেন্টস বক্সে ক্রিকেটারদের নোংরা ভাষায় সমালোচনা করা, বোর্ড সংশ্লিষ্ট অনেকের ক্রিকেট জ্ঞান, তাদের তোষামোদী, দায়িত্ব পালন না করা, বিসিবি টাকায় সফর করে বেড়ানোসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা করেছেন মাশরাফি। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
টিবিএস: বোর্ড পরিচালকদের তথ্য রাখা, অফিস করা নিয়ে আপনি সংশয় প্রকাশ করেছেন। এমনকি নিজের টাকায় সফরে যায় কিনা, সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বিষয়টি নিয়ে যদি বিস্তারিত বলতেন…
মাশরাফি বিন মুর্তজা: তথ্য রাখার কথা বলেছি ফিটনেস নিয়ে। ফিটনেস টেস্টের তথ্য তো ক্রিকেট বোর্ডে থাকে। এটা হয়তো অফিস না করার দুর্বলতার কারণে দেখেনি তারা। আর পরিচালকদের প্রায় সবাই তো নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। কজন অফিস করেন? অফিস প্রতিদিন করা ক্রিকেট বোর্ডে জরুরি নয়। তবে তথ্য তো রাখতে হবে! মিডিয়া যখন প্রশ্ন করে, তথ্য নিয়ে উত্তর দিন!
দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে, প্রায়ই আপনারা শোনেন যে ক্রিকেটারদের পরিবার সফরে দলের সঙ্গী হয়, ক্রিকেটারদের পরিবারকে কি বোর্ড টাকা দিয়ে নেয় নাকি? পরিবারকে ক্রিকেটাররা নিজেদের টাকায় নেয়, ফ্রি নয়। পরিবারের জন্য তো বাড়তি ভাতা দেওয়া হয় না। বরং ক্রিকেট বোর্ড থেকে যারা সফরে যায়, তারা ৫০০ ডলার করে ভাতা পায় বলে শুনেছি। সেখানে ক্রিকেটাররা ট্যুর ফি ও অন্যান্য মিলিয়ে পায় হয়তো দৈনিক ১০০ ডলার। আপনি আছেন কোথায়? যাদের কারণে আপনি আরাম-আয়াশে আছেন, তাদেরকেই মাটিতে নামিয়ে দিচ্ছেন!
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/12/06/mash_fitness_test.jpg)
টিবিএস: তাহলে কি ক্রিকেটারদের ঠকানো হচ্ছে?
মাশরাফি: বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যে বেতন পায়, কোনোভাবেই তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মেলানোর দরকার নেই। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে যে পারফরম্যান্সও ওই পর্যায়ের হতে হবে। কিন্তু যে পর্যায়ের ক্রিকেট আমরা খেলি, সেই পর্যায়ের সঙ্গে এই বেতন কোনোভাবেই মেলে না। না জিতলে, বেতন দেবেন না, এটা কোনো কথাই হতে পারে না। জেতার কারণ হতে পারে বেতন বাড়ানো। আপনার একজন খেলোয়াড়ের নিবেদনের পর্যায় বেড়ে যেতে পারে, তা না হলে অফিসে আপনি ভালো করলে প্রমোশন দিতো না। এটা সাধারণ ব্যাপার। ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মেলানোর প্রয়োজন নেই। তবে মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড তো মানতে হবে!
আজ টেস্ট ক্রিকেট খেলার মানসিকতা হারিয়ে যাচ্ছে অনেকের। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলে না কেন অনেকে? ফার্স্ট ক্লাস খেলতে গিয়ে ভ্রমণ করতে হয় বাসে। এক-দুই বছর হলো প্লেনে নেওয়া শুরু করেছে। দুই খেলার মধ্যে বিরতি রাখেন তিন দিন। বর্ষাকালে খেলা রাখেন। একদিন অনুশীলন করেই চারদিনের ম্যাচ খেলতে হয়। ছোটখাটো চোটে পড়ে। তখন তারা আর খেলতে চায় না। কারণ চারদিনের ম্যাচে বড় ইনজুরিতে পড়লে বিপিএল, ঢাকা লিগ মিস হয়ে যাবে। ওখানে তো টাকা বেশি!
এখন আপনি বলতে পারেন, টাকার জন্য ক্রিকেট খেলেন? উত্তর হলো, আপনি টাকার জন্য চাকরি করেন কেন? আপনার অফিস দারুণ সম্মান করলেও কেন বেশি সম্মানী পেলে অন্য অফিসে চলে যান? শুধু ক্রিকেটারদের দোষ! আমি যেটা বলতে চাইছি, পেশাদারিত্ব আরও আনার জন্য, দায়বদ্ধতা বাড়ানোর জন্য বা দায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এই লেভেলগুলোকে বাড়াতে হবে। একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশে পারিশ্রমিক কখনোই ৫০ হাজার (প্রথম শ্রেণি) হতে পারে না।
ক্রিকেটারদের আন্দোলন হলো না? তারপর কেবল সিনিয়র ক্রিকেটারদেরই বেতন বাড়ে। নিচে যারা থাকে, তাদের বাড়ে না। সবাই জানে, ওই ৫-৬ জন ছাড়া আন্দোলন হয় না। দিন শেষে আমাদের জুনিয়র ক্রিকেটাররা বা ক্লাব ক্রিকেটাররা যেখানে থাকার, সেখানেই পড়ে থাকে।
টিবিএস: দল থেকে বাদ পড়া নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
মাশরাফি: বাদ পড়ার কারণের সঙ্গে আমি একমত। বিশ্বকাপে যে পারফরম্যান্স করেছি, তার পর বাদ যাওয়ার কথা। বোর্ডকে একটা না একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হতো। হয় আমার ওপর আরও কিছুদিন আস্থা রাখতে পারত, অথবা বাদ দিতে পারত। বাদ পড়াকে আমি কোনোভাবেই অকারণ মনে করি না।
কিন্তু এটাও ভাবেন, তার আগের তিন সিরিজ আমি সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি (তিন সিরিজের দুটিতে)। একটা বিশ্বকাপ দিয়ে তারা আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার মূল্যায়ন করেছে, এটা একমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব। আর কোথাও হয় না। ২০০৩ বিশ্বকাপে মাহেলা জয়াবর্ধনে ১৩ বা ২৩ রান করেছিল (৭ ইনিংসে ২১)। এরকম বহু ইতিহাস আছে, বিশ্বকাপ কারও না কারও খুব খারাপ গেছে।
তার পরও ধরে নিলাম ২০২৩ বিশ্বকাপ মাথায় রেখে বাদ দেওয়া হলো। কিন্তু বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া ঠিক হয়নি। কারণ আপনি এক মুখে বলছেন, আমরা চাই মাশরাফি মাঠ থেকে বিদায় নিক, কিন্তু আপনার প্রক্রিয়া ঠিক নেই।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/10/06/mashrafe_bin_mortaza.jpg)
টিবিএস: এইচপি-একাডেমির কোচ হতে আসা রাসেল ডমিঙ্গকে জাতীয় দলের কোচ করা হয়েছে। এটা কতোটা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল এবং আপনাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল কিনা?
মাশরাফি: বিশ্বকাপ চলার সময় একাদশে কে খেলবে, এটার মিটিংয়েই তারা পারলে অধিনায়ককে রাখে না। আপনি বলছেন বিশ্বকাপের পর কোচের ক্ষেত্রে মতামত নেবে! দেখেন, কোচকে নানা কারণেই বাদ দিতে পারে। চান্দিকা হাথুরুসিংহে বলুন, ডেভ হোয়াটমোর বলুন, তাদের পর সবচেয়ে সফল কোচ কিন্তু স্টিভ রোডস। তিনি দলটাকে সঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কোনো মানুষের শক্তি-দুর্বলতা, সব থাকে। কিন্তু রোডসের কোচিংয়ে ফল দেখেন, ম্যাসিভ খারাপ কিছু নেই।
কিছু কথা তাকে নিয়ে বলা হয়েছে। যেমন, বার্মিংহামে প্র্যাকটিস না করে তিন দিন ছুটি দেওয়া। বার্মিংহামে আমাদের ম্যাচের আগে ভারত-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ ছিল। চাইলেও তো প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড পাওয়া যাবে না, ওই দুই দল করবে প্র্যাকটিস। আমাদের তাহলে অন্য প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড ভাড়া করতে হতো। সেই দায়িত্ব তো বিসিবির! ম্যানেজার বা অন্য যারা ছিলেন বোর্ডের, তারাও তো উদ্যোগ নেননি।
এটা স্রেফ তারা উল্লেখ করেছে। মূল কারণ ছিল (রোডসকে বরখাস্ত করার), দল সেমি-ফাইনালে খেলতে পারেননি। দল যখন সেমিতে খেলতে পারেনি, তাড়াহুড়ো করে বাদ দেওয়া আর নতুন কোচকে মিডিয়া-দর্শকের চাপে তাড়াহুড়ো করে নিয়োগ দেওয়া, দুটিই ভুল সিদ্ধান্ত। এবং কোচকে ইংল্যান্ড থেকে ডেকে এনে তার হাতে চিঠি ধরিয়ে দেওয়া, এটাও অপেশাদারিত্ব। কারণ তিন-চারদিন পরই দল শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছিল। তাকে ওই সুযোগ দেওয়া যেত। শ্রীলঙ্কার পরে অনেক সময় ছিল, তখন ভেবেচিন্তি কোচ নেওয়া যেত।
আপনি কোচকে ডেকে এনে বিদায় করলেন, তখন বলতে হয়, দল বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনাল খেলতে পারেনি শুধুই কি মাশরাফির জন্য? হয়তো এখন বলতে গেলে কোনো কোনো ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে পারসোনাল হয়ে যাবে, নাম বলব না। কিন্তু ফিল্ডিংয়ের কারণে কি আমরা সেমি-ফাইনাল থেকে বঞ্চিত হইনি? ফিল্ডিং কোচ তো এখনও দলের সঙ্গে আছেন। ফিল্ডিংয়ের কারণে কি আমরা আফগানিস্তানের কাছে টেস্ট হারিনি? ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে দুটি টেস্ট হারিনি? সেই ফিল্ডিং কোচ এখনও কিভাবে আছে? আপনি কোচকে বরখাস্ত করেছেন, আরেকজনকে করছেন না। এটা তো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।
মাশরাফিকে আপনি ছেটেছেন, এই একজনের ওপর দিয়ে গেলেই ভালো হতো। অন্তত দলটা অস্থির হতো না। দলের কোচ অনেক বড় ব্যাপার। মাশরাফিকে সরানো বড় কিছু নয়। কিন্তু কোচ অনেক বড়। কোচের সঙ্গে সবার মানিয়ে নিতে হয়। আমাদের সংস্কৃতিতে এসব আছেই। একটু সময় লাগা, ভাষার সমস্যা, এসব আছেই। হুট করে একজনকে আপনি আনলেন, যে কিনা একাডেমি-এইচপির চাকরি চেয়েছিল। যার লক্ষ্যই ছিল নিচু জায়গায়, তাকে জাতীয় দলের কোচ বানালেন। লক্ষ্যের ওপরে কাউকে দিলে সে তো ব্যালান্স করতে পারবে না। তার ফল কি? একটা টি-টোয়েন্টি জিতেছে, ভারতের সঙ্গে।
এখন যখন তাকে এনেছেনই, সময়ও দেওয়া উচিত। মিডিয়ার কথায় বা মাশরাফির মতো দর্শকের কথায় বা অন্য দর্শকের কথায় যেন বরখাস্ত না করা হয়। মিডিয়া, দর্শক চাপ দেবেই। এটাই তাদের কাজ। আপনি ভারতের দিকে তাকান। এক নম্বর এমনি এমনি হয়নি। বোর্ডের সিদ্ধান্ত কাজে না লাগতেই পারে অনেক সময়। কিন্তু স্ট্রং ক্যারেকটার যদি দেখাতে না পারেন, তাহলে হবে না। অনিল কুম্বলেকে যখন বাদ দেওয়া হয়, ভারতের ৫০ কোটি মানুষ মনে হয় তার পাশে ছিল। শচিন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষণ, রাহুল দ্রাবিড়, এমনকি সৌরভ গাঙ্গুলি, সবাই কুম্বলের পক্ষে ছিল। বিরাট কোহলি ও বোর্ডের সিদ্ধান্তে রবি শাস্ত্রী দায়িত্ব পেয়েছে।
শাস্ত্রীর পেছনে সবসময় মিডিয়া লেগেই ছিল। এখনও লেগে আছে। সেই শাস্ত্রী দলকে কোথায় নিয়ে গেল? কারণ, বোর্ডের মানসিক শক্তি, সিদ্ধান্তহীনতায় না থাকা, বোর্ডের পূর্ণ আস্থা রাখা।এ জন্য বলি, একজন ক্রিকেটারকে নেয় আমাদের এখানে, কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়া নেয়। তার পর যখন খারাপ পড়ে, তখন চিন্তা ভাবনা পড়ে, আগে ওকে সরাও, বিকল্প কেউ থাকুক বা না থাকুক।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/01/09/mashrafe.jpg)
টিবিএস: বোর্ডের পরিচালকদের ও সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোর দায় নেওয়া কিনা?
মাশরাফি: অবশ্যই দায় নেওয়া উচিত। মাঠ ভালো না থাকলে, মাঠের দায়িত্বে থাকা লোকের দায় নিতে হবে। আজকে একজন ক্রিকেটার হুট করে একটা কথা বললে মিডিয়া কমিটির দায়িত্বে যে আছে, তাকে দায় নিতে হবে। এইচপি বা 'এ' দলের সমস্যা হলে দায়িত্বে থাকা লোককে দায় নিতে হবে।
একমাত্র গেম ডেভেলপমেন্ট আমি দেখছি যে রানিং প্রসেসে আছে। কারণ ওই পরিচালক সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডে নেই, সুজন ভাই (খালেদ মাহমুদ)। আমাদের সমাজে যে কাজ বেশি করে, সে বেশি গালি খায়। আজকে বায়ো-বাবলে যে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হলো, তার আগে তিন দলের ওয়ানডে টুর্নামেন্ট হলো, সর্বোচ্চ কৃতিত্ব সুজন ভাইয়ের। উনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে, কেউ তার অবদানের কথা বলবে না। বরং মিডিয়ার সামনে গিয়ে বলবে, ওর এত কথার দরকার কি? কিন্তু উনিই তো সিস্টেম গড়েছিলেন। বিপিএল খেলতে না দিয়ে কক্সবাজারে রেখে একটা দলীয় সমন্বয় গড়ে তুলেছেন। ভালো ভালো সিদ্ধান্ত নিলে কিন্তু ফল ঠিকই মিলেছে।
সুজন ভাইকে কারা কালারিং করছে মানুষের সামনে? তার নেগেটিভ তথ্যগুলো মিডিয়ার কাছে কারা দিচ্ছেন? এটা নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। কারণ, আমি নই শুধু, যেকোনো ক্রিকেটারকে জিজ্ঞেস করুন। সুজন ভাই তো আমার আত্মীয় নন। আগেও বললাম, শ্রীলঙ্কায় যখন হাথুরুসিংহের সঙ্গে মিটিং হলো, আমার কষ্টও লেগেছিল যে সুজন ভাই ছিল, উনি আমার হয়ে একটু কথা বললেন না। কিন্তু আমি তাকে দোষ দেব না। কারণ আমি জানি উনি কাজ করছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্রিকেটার কোচকে জিজ্ঞেস করেন, তারা বলবে যে একমাত্র আস্থার জায়গা উনি, যার কাছে কিছু বলা যায় যে আমার এই সমস্যা, ওই সমস্যা। বলার আর কোনো জায়গা নেই। সে তখন ওই খেলেয়াড়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন মিডিয়ার সামনে এসব চলে আসে আর তিনি গালি খান সে সুজন এমন। কিন্তু আমরা ক্রিকেটাররা এই বেচারাকে সবসময় দাড়িপাল্লার একটা পাশে রাখি। কোনো ক্রিকেটার সুজন ভাইকে নিয়ে কিছু বলবে না।
ভুল-ত্রুটি আছেই। এসব নিয়েই মানুষ। কিন্তু উনিই একমাত্র, যিনি কাজ করেন। অফিস করেন। সারাদিন ক্রিকেট ধ্যানজ্ঞানে রাখছেন। সারাদিন মোবাইল, ল্যাপটপে ক্রিকেটে ব্যস্ত থাকেন। তার ফলও গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগ পাবেন। তার ফল মিলেছে। বিশ্বকাপ জয়ের পর তো ওই বিভাগকে নিয়ে আর প্রশ্ন থাকে না। এর চেয়ে বড় কিছু তো নেই।
টিবিএস: জাতীয় দলের প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গোকে এখন পর্যন্ত কেমন দেখলেন?
মাশরাফি: সে তো দক্ষিণ আফ্রিকাতেও বরখাস্ত হয়েছিল, তাই না? বাদ দিয়েছিল। ঝামেলার জিনিসকেই আমরা ঢুকিয়ে রেখেছি। আপনি সৌম্যকে পরিকল্পনা করাচ্ছেন সাতে খেলাবেন। রিয়াদকে ছয়ে খেলিয়ে তাকে ম্যানেজ করতে পারছেন না। শান্ততে তিনে খেলানোর জন্য সাকিবকে চারে নামিয়ে দিচ্ছেন। সৌম্যকে খেলানোর জন্য সাতে খেলাচ্ছেন। এটা তো কোনো পরিকল্পনা হলো না!
শান্তকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, ভালো কথা। তরুণ ক্রিকেটারের পাশে থাকতেই পারেন। তাহলে সৌম্যকে বাদ দিন। জোর করে অন্য জায়গায় তো খেলানো জরুরি নয়! শান্ত পারফর্ম না করলে আবার সৌম্যকে নিয়ে আসেন! এরপর, ম্যান ম্যানেজমেন্টও আপনি ঠিকমতো করতে পারেন না।
প্রশ্ন হচ্ছে ফলাফল নিয়ে। বাংলাদেশ সেমি-ফাইনাল খেলতো, মাশরাফিকে নিয়ে কোনো কথা হতো না। কোচ হিসেবে আফগানিস্তানের কাছে টেস্টে হেরেছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে দুটি টেস্টে হেরেছে সি গ্রেডের টিমের সঙ্গে। তাকে নিয়ে আদর করবে নাকি? আমার ক্ষেত্রে আমি সহজভাবে নিয়েছি, তাকেও নিতে হবে।
সমস্যা হলো, যে-ই বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসে, তাকে আমরা এমন গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে দেই, তার পা আর মাটিতে থাকে না। দেশি কোচের ক্ষেত্রে তা করি না। সুজন ভাই যখন কোচ হয়ে শ্রীলঙ্কায় গেলেন, তার সঙ্গে এখন পার্থক্য কোথায় হচ্ছে? ওই তিন ম্যাচ হেরেছিলেন, এখানেও তো হারছেই। পার্থক্য কোথায়? এই কোচ কী করেছেন?
আমি শুনি যে কোচ নাকি বলছেন, 'আমাকে স্যাক করুক, সমস্যা নেই।' কারণ, সে তো জানেই, বরখাস্ত করলে পুরো এক বছরের টাকা নিয়ে চলে যাবে। চুক্তি তো ওরকমই। সে আবার সমানে ছুটি কাটাতে পারবে। ফ্ল্যাট সাজানো-গোছানো, সব সুযোগ-সুবিধা আছে। আমাদের দেশি কোচ না খেয়ে মরে যাচ্ছে। অথচ সারাটা বছর একজন কৃষকের মতো তারা মাঠে খাটেন। বাবুল ভাই, সালাউদ্দিন ভাই, সুজন ভাই, সোহেল ভাই, মুর্তূজা ভাই, রাজিন সালেহ, আফতাবরা আসছে এখন, কারও দামই নাই।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/01/12/mashrafe.jpg)
টিবিএস: বিসিবি ও বিসিবি সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সাকিব আল হাসানের করা সমালোচনা কীভাবে দেখেন? আরেকটি বিষয়, সাকিব বলেছেন বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে আইপিএল খেলবেন, এটাকে কতটা যৌক্তিক মনে করেন?
মাশরাফি: সত্যি কথা বলতে টেস্টের সঙ্গে টি-টোয়েন্টির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। টেস্ট ক্রিকেট মানে টেস্ট। আমরা তো জানতামই যে বাংলাদেশ ফাইনালে খেলবে না (টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে)। ওই চিন্তা করলে হবে না যে টেস্ট ক্রিকেটে কোনো সুযোগ নেই বলে মূল্য নেই। এটা ভুল ধারণা। সর্বোপরি, বাংলাদেশের ক্রিকেট মানে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এটার সঙ্গে কোনো আইপিএল, সিপিএল আমি অন্তত মেলাতে পারব না। এটা আমার ফাইনাল কথা। সে সাকিব হোক বা অন্য কেউ বা আমি, এটা বাস্তব কথা।
দ্বিতীয় কথা, প্রস্তুতির কথা যখন সাকিব চিঠিতে উল্লেখ করেছে, সে তো অনুমতি চেয়েছে, সে তো বলেনি যে যাবেই। অনুমতি চেয়েছে। বিসিবি অনুমতি দিয়েছে। অনুমতি দেওয়ার পর যখন বিসিবি বলেছে যে সে টেস্ট খেলতে চায় না, তখন পুরো ভুল উপস্থাপনা। কিন্তু বিসিবি যদি এটা করত যে 'তোমাকে অনুমতি দেব না, টেস্ট খেলতে হবে', তখন যদি সাকিব জোর করে যেত, তখন পুরো ব্যাপার পরিষ্কার হতো। বিসিবি নিজেও তো অবস্থান নিতে পারেনি যে দেশের খেলা আগে।
আরেকটা যেটা বলেছে যে, যারা খেলতে চায় না, খেলবে না। এটা ভালো সিদ্ধান্ত, আমি মনে করি। জোর করে না খেলিয়ে নতুন কাউকে দেখি। এটাও খারাপ নয়। এটা পেশাদারী চিন্তা। বহির্বিশ্বে যদি তাকান, আইপিএলের সময় কোথাও ক্রিকেট হয় না। শুধু বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে হয়। কারণ পাকিস্তানের কাউকে নেওয়া হয় না। বাংলাদেশের মাত্র দুজন সুযোগ পায়। আর সবাই বসে থাকে। তাতে করে সিরিজ আয়োজনের সুযোগ হয়। তখন আবার সাকিব ও মুস্তাফিজের সমস্যা হয়। এখানেও ভাবার চিন্তা।
এখানেও কিন্তু অন্য চিন্তা করা যায়। সবসময়ই কোনো না কোনো পথ আছেই। স্টুয়ার্ট ব্রড, জেমস অ্যান্ডারসনরা কি আইপিএল খেলার যোগ্য নয়? ৪০০-৫০০ করে উইকেট পেয়েছে। তারা আইপিএলের দিকে আসে না, কারণ ইসিবি তাদের দেখভাল করে। আইপিএল খেললে যে টাকা পেত, অতটা হয়তো নয়, মাঝামাঝি কিছু টাকা নাও। ওরা জানে, এই দুজন তাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা মোটেও ভুল প্রক্রিয়া নয়। সারাবিশ্বেই এটা চলে। সাকিবকে যদি ওইভাবে সামলান, যে 'আইপিএল খেলো না রেস্ট নাও, আর এই টাকাগুলি রাখো।
পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমি কি জন্য বলছি যে টেস্টের ম্যাচ ফি ১০ লাখ করে দাও, ওয়ানডের ম্যাচ ফি ৬ বা ৫ লাখ করে দাও, কারণ সারাবিশ্বে পারফরম্যান্স এভাবেই বাড়ে। একসময় ইংল্যান্ডের পারফরম্যান্স কিছুই ছিল না। আমাদের কাছে হেরে ২০১৫ বিশ্বকাপে বাদ গিয়ে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে চার বছরের মধ্যে বিশ্বকাপ জিতেছে। এর পেছনের কারণ কী? শাস্তি দিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছে? নিশ্চয়ই কিছু পুরষ্কার, কিছু ছোট ছোট পদক্ষেপের কারণে তারা পেরেছে।
সবচেয়ে বড় উদ্যোগ, ইয়ইন মর্গানকে তারা অধিনায়কত্ব থেকে সরায়নি। এটা কত বড় আস্থা, ধারণা করতে পারেন? বাংলাদেশ তো চিন্তাও করতে পারবেন না। ঘুমের ভেতরও ঘুম ভেঙে যাবে। আল্লাহ না করুক, তামিমের যদি কয়েকদিন খারাপ যায়, কী অবস্থা হয় দেখেন। আর ওরা, বাংলাদেশের বিপক্ষে হারার পরও অধিনায়ক বদলায়নি। চাট্টিখানি কথা নয়।
টিবিএস: বিসিবি প্রেসিডেন্ট বক্সে ক্রিকেটারদের সমালোচনা হয়? ওখানকার পরিবেশটা কেমন?
মাশরাফি: প্রেসিডেন্ট বক্সে আসলে একজন ক্রিকেটারকে উলঙ্গ করা হয়। পুরো উলঙ্গ করা হয়। এটা উনারাও জানেন। উনারা অস্বীকার করতে পারবেন না। ওখানে আমাদের মানুষরাও থাকেন। ক্রিকেটারদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ভালো সম্পর্কের মানুষও থাকেন। আমরা শুনি। প্রেসিডেন্ট বক্সে যখন বলা হয়, 'ওই প্লেয়ার চলে না', তখন ওই প্লেয়ার আর চলেই না। যেখানেই ভালো খেলুক আর চলে না।
ক্রিকেটারদের কানে না এলে আমরা জানলাম কোত্থেকে? অন্য কেউ বলছে না এখন। আমার মতো কেউ ছেড়ে আসুক, তখন সেও বলা শুরু করবে। কারণ সে জানে কোড অফ কন্ডাক্ট আর নাই। মিলিয়ে দেখবেন তখন।
টিবিএস: এসব যারা বলেন, তাদের ক্রিকেট জ্ঞান নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মাশরাফি: বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে এমন মানুষ কারা আছেন, যে ক্রিকেট খুব বোঝে? কজন আছেন এরকম মানুষ, আপনি আমাকে দেখান। এমন মানুষও ড্রেসিং রুমে ঢুকে আমাদেরকে অর্ডার করেন, আমাদের ক্যারিয়ারের ১০ বছর হওয়ার পরও যাদের আমরা ক্রিকেটে দেখিনি। আমাদের সঙ্গে বোল্ডলি কথা বলে তারা। আমি তো ২০০১ সালের খেলোয়াড়। আতহার ভাই তখন অবসর নিলেন। এ ছাড়া সব সিনিয়র ক্রিকেটারের সঙ্গে আমি খেলেছি, আকরাম ভাই, বুলবুল ভাই, মনি ভাই, রফিক ভাই, এমন কোনো ক্রিকেটার নেই, যাদের সঙ্গে খেলিনি। তখন থেকেই দেখে আসছি। যারা ক্রিকেট বোঝে, তারা অনেকেই নাই। যারা বোঝে, তাদের নিয়েও এমনিতে সমস্যা নেই। বোর্ডের সুবিধায় যাকে খুশি নিতে পারে। কিন্তু তারা যখন বড় বড় কথা বলে, তাদের ছাড়া কাজ হবে না বলে, তাদের দেখে কষ্ট লাগে কী, এরা তো কোনোদিন ক্রিকেটই খেলেনি!
তো কথা হচ্ছে, এই মানুষগুলি ড্রেসিং রুমে ঢোকে, মাঠে ঢুকে বা বিসিবিতে এমন ভাবে কথা বলে, তখন নিজের কাছে মনে হয়, নিজের জুতো বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে হেঁটে বেড়াই। এ ছাড়া আর বলার কিছু থাকে না। এই মানুষগুলি যখন আমাদের নিয়ে সমালোচনা করেন, তখন মনে হয়, ক্রিকেট না খেলে, তেলবাজি করে বেড়ালে আমার জীবনে অনেক ভালো কিছু হতো।
টিবিএস: বসে বসে বেতন নেয়, আপনাকে জড়িয়ে এমন মন্তব্য এসেছে ক্রিকেট বোর্ড থেকে। এটাকে কীভাবে দেখেন?
মাশরাফি: আপনাদের কাছেই তো এসব মানুষ এছে বলছে যে মাশরাফিকে সম্মান করা উচিত। তখন তো আপনারা বলেন না যে এসব কথা কেন বলছেন। আপনারাও তো প্রশ্রয় দেন। এই যে কথাগুলি হয়, একমাত্র আপনারাই জায়গা যে অন্যায়গুলি তুলে ধরতে পারেন। আপনারাই কেউ না কেউ প্রশ্রয় দেন। এ জন্য কেউ না কেউ মিথ্যা বলার সুযোগ পায়। আজ একজন আমি কথা বলে লাভ নেই। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। খেলোয়াড়রা শুধু পারবে না। খেলোয়াড়েরই একমাত্র কোড অফ কন্ডাক্টে থাকে। যেটা আমি ২০ বছর ছিলাম, বলতে পারিনি। আজকে যা মন চায়, বলতে পারি।
টিবিএস: এখন থেকে নিয়মিত বলবেন?
মাশরাফি: যদি দেখি আমি বলব। বোর্ডে তো যাই না। যা দেখব, সেটা বলব। আমার তো বলতে সমস্যা নেই। এই ২০ বছরে যা দেখেছি, সেসব বলতেই তো ১ বছর লাগবে!
টিবিএস: আপনি এবং সাকিব একই সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। এটা কি পরিকল্পনা করে বলা?
মাশরাফি: সাকিবের আগেই আমি বলা শুরু করেছি। সাকিব তো সেদিন রাতে অনলাইনে বলেছে, আমি দুপুরেই একটি টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়েছি। ১২টার দিকে। সাকিব যে বলবে, আমি তো জানতাম না। আমারটা আগে প্রচার হলে হয়তো বলা হতো, আমারটা দেখে সাকিব বলেছে। আসলে আমরা কেউ কারওটা জানি না। কাকতালীয়ভাবে হতে পারে, লোকে বলতে পারে। কিন্তু সাকিব ওর মতো বলেছে, আমি আমার মতো।