‘বিদেশি’ শিল্প এনআরসি, টাকা রোজগারের নতুন দিশা আসামে
এনআরসি বা রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জী হচ্ছে হাতিয়ার। রোজগারের হাতিয়ার। বাঙালি হলেই চলবে। হিন্দু বা মুসলিম বিচার করার দরকার নেই। চরম হয়রানি করে পুলিশ থেকে সাধারণ নেতা, পয়সা রোজগারের ‘শিল্প’ রমরমিয়ে চলছে। আর এই ‘হয়রানির কারখানা’ থেকে নিস্তার নেই মরে গিয়েও!
বাংলাদেশি খোঁজার অমানবিক এই অত্যাচারের শিকার অবসরপ্রাপ্ত ফৌজি অফিসারদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ। এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও। নারীরাও রাষ্ট্রীয় যন্ত্রে নিয়মিত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এনআরসির তালিকা প্রকাশের পর সেই হয়রানি শিল্প আরও বেড়ে গিয়েছে।
পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পড়েছে একটি উদাহরণ দিলেই আঁচ পাওয়া যাবে। আসামের চিরাং জেলার বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা মধুবালা দাসকে ২০১৬ সালে বিদেশি বলে ঘোষণা করে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল। কিন্তু তার আগেই তিনি মারা যান। তাতেও নিস্তার নেই। গ্রামের আরেক মধুবালা (মন্ডল)কে তিন বছর জেলখানার ভিতর বিদেশি বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়। জেলা পুলিশ সুপার সুধাকর সিং নিজেই এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য বলছেন, ‘নামে কিবা আসে যায় নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহদের আমলে! বাঙালি হলেই হলো! ভারতে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র চলছে।’
বাঙালিকে হয়রানি করা শিল্পের চেহারা নিয়েছে। বাঙালির গায়ে ‘বিদেশি’ তকমা লাগিয়ে রোজগার বৃদ্ধির রমরমা ব্যবসা। উকিল বা পুলিশদের তো কথাই নেই! সাধারণ মানুষেরও রোজগারের সুযোগ রয়েছে। খিলঞ্জিয়া (ভূমিপুত্র) হলেই চলবে। সঙ্গে থাকা চাই শাসক দল বিজেপির নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক। উগ্র অসমিয়া জাত্যাভিমানকে পুঁজি করে দিব্যি চলছে অনেকেরই সংসার।
এনআরসি ছাড়াও বিদেশি ধরার আরও তিনটি স্তর রয়েছে আসামে। প্রথম স্তর এলভিও (লোকাল ভেরিফিকেশন অফিসার)। এসআই বা এএসআই পদমর্যাদার এই পুলিস কর্মীদের কাছে কারও বিরুদ্ধে বিদেশি বলে অভিযোগ জানিয়ে ‘ব্ল্যাক মেলিং’ করে পয়সা রোজগারের সুযোগ রয়েছে। হচ্ছেও। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে মন্তব্য-সহ বর্ডার পুলিসের এসপির কাছে রিপোর্ট পাঠানোর নিয়ম। এই তদন্ত নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। উদাহরণ হিসাবে মহম্মদ সালাউদ্দিনের ঘটনাই তুলে ধরা যায়।
৩০ বছর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন মহম্মদ সালাউদ্দিন। লড়াই করেছেন কার্গিল যুদ্ধে। পেয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতির পদক। অবসরের পর যোগ দেন আসামের বর্ডার পুলিসে। তিনিও ছিলেন এলভিও। কিন্তু তাঁকেই বিদেশি বলে সনাক্ত করে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল। জেলে পাঠানো হয়। বর্তমানে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত সালাউদ্দিন।
কী ভাবে তিনি বিদেশি হলেন? প্রথমে গ্রামেরই কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে। চন্দ্রমল দাস নামে এক এলভিও-র ওপর ভার পড়ে তদন্তের। তিনি ২০০৮ সালের ২৩ মে এসপির কাছে রিপোর্ট পাঠান - সালাউদ্দিন বিদেশি। তাঁর রিপোর্টে বলা হয় সালাউদ্দিন নাকি নিজেই বাংলাদেশি বলে টিপ শই দিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
অথচ, রেকর্ড বলছে সেই সময়ে সালাউদ্দিন ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে মণিপুরে জঙ্গি দমন অভিযানে কর্মরত। এলভিও-র রিপোর্টের ভিত্তিতে এসপি বিষয়টি পাঠান ট্রাইবুনালে। কিছুই জানতেন না সালাউদ্দিন। কোনও নোটিশও পাননি। ট্রাইবুনাল তাঁকে বিদেশি বলে ঘোষণা করে জেলে পাঠায়। পরে অবশ্য উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
সালাউদ্দিন উদাহরণ মাত্র। এরকম বহু ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে আসামে। রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এলভিওরা।
পাশাপাশি ৩৩টি জেলাতেই তাঁদের মাথার উপর রয়েছেন বর্ডার পুলিশের এসপি পদমর্যাদার অফিসার। তার ওপর রয়েছে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালও। ১০০ আছে। আরও ১ হাজার ট্রাইবুনাল খুলবে রাজ্য সরকার। এরমধ্যে ২০০টি খোলা হচ্ছে সেপ্টেম্বরেই। তার মানে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ।
তপোধীরবাবুর ভাষায়, এই কোয়াশি বিচার ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি পক্ষপাতদুষ্ট। গৌহাটি হাইকোর্টে সিনিয়র অ্যাডভোকেট হাফিজ চৌধুরির মতে, বিদেশি বানানোই তো কাজ ট্রাইব্যুনালের। তাঁরা সেটাই করেন। স্বদেশি বনে যাচ্ছে বিদেশি। এহেন ট্রাইব্যুনালই ভরসা এনআরসি-ছুট ১৯ লাখ মানুষের।
৩১ আগস্ট প্রকাশিত হল এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা। এনআরসির জন্য আবেদন করেছিলেন ৩ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৪ জন। বাদ পড়লেন ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন। চূড়ান্ত খসড়ায় বাদ পড়েছিলেন ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭২৭ জনের। অতিরিক্ত খসড়ায় বাদ পড়েছিলেন আরও ১ লাখ ২ হাজার ৪৬৫ জন।
সংযোজন ও সংশোধন প্রক্রিয়ার পর এই ১৯ লাখ মানুষ রাষ্ট্রহীন। হ্যাঁ, এখনই তাঁদের রাষ্ট্রহীন বলা যেতেই পারে। কারণ তাঁদের নাগরিকত্ব তো সন্দেহমুক্ত নয়। আর আসামে ভোটার তালিকায় সন্দেহযুক্তদের নামের পাশে ডি বা ডাউটফুল লিখে কেড়ে নেওয়া হয় ভোটাধিকার।
বাদ পড়াদের বেশির ভাগই হিন্দু। তাই চিন্তিত হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। বাঙালি হিন্দু ভোট হাতছাড়ার হওয়ার ভয়ে এখন নাগরিকত্ব সংশোধনের কথাও বলছেন তাঁরা। কিন্তু তাতে করেও গরিব মানুষগুলোর সমস্যা কমছে না। এনআরসি প্রক্রিয়া চলাকালেই অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছেন অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে। এখন ফের বিপদ।
এনআরসি তালিকায় দেখা যাচ্ছে একই পরিবারের বাবা-মা ভারতীয়, অথচ কোনও এক ছেলে বা মেয়ের নাম নাগরিক তালিকায় নেই।
আবার উল্টোটাও হয়েছে। ১৫০০ কোটি রুপিরও বেশি অর্থ খরচ করে ৫২ হাজার লোকবল কাজে লাগিয়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে প্রকাশিত তালিকায় বহু পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসে আসামে বসবাসকারীরাও নিজেদের ভারতীয় বলে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাদ পড়েছেন গোর্খারাও।
৩৩ বছর ভারতীয় বায়ুসেনায় চাকরি করেও ওঠেনি তালিকায় নাম। বর্তমান জনপ্রতিনিধি অনন্ত মালোর নাম নেই তালিকায়। নাম নেই সাবেক রাষ্ট্রপতি ফখিরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারের। অসঙ্গতিতে ভরা এনারসি তালিকা মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে চলেছে।
ভারত ও অসম সরকার বলছে এখনই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এঁদের সকলকে যেতে হবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। সেখানে প্রমাণ দিতে হবে নাগরিকত্বের। ফেল করলেই জেলখানার ভিতর বিদেশি বন্দিশালা। হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট পরের বিষয়। আগে যেতে হবে জেলে। সেখান থেকে জামিনের আবেদন চলতে পারে। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে হারলেই জেল হবে ঠিকানা।
আসামে বর্তমানে ৯৮৬ জন ঘোষিত বিদেশি বন্দি রয়েছেন। প্রতিদিনই সংখ্যাটি বদলাচ্ছে। তবে এনআরসি-র ট্রাইব্যুনাল শুরু হলে সংখ্যাটি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। আছে এক হাজারেরও বেশি ট্রাইব্যুনাল।
বর্তমানে ৬টি জেলখানার ভিতর রয়েছে বিদেশিদের জন্য বন্দিশালা। ৪৬ কোটি রূপি খরচ করে ৩ হাজার বন্দি রাখার পরিকাঠামোসহ রাজ্যের গোয়ালপাড়ায় গড়ে তোলা হচ্ছে শুধুমাত্র বিদেশিদের জন্য বন্দিশালা। সবমিলিয়ে চলছে বিদেশি ধরার নামে বিশাল কর্মযজ্ঞ। আর এই কর্মযজ্ঞে বাঙালিরা সর্বস্বান্ত হলেও অনেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।