বার্ধক্য প্রতিরোধী ওষুধ কী বয়স্কদের দেহে টিকার কার্যকারিতা বাড়াতে পারবে?
মানবদেহে বয়সের সাথে সাথে অবনতি দেখা দেয়। দিনে দিনে ত্বক লাবণ্য হারায়, কুঁচকে যায় আর হাড়ের জোড়া দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি শরীরের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
বয়সের এই প্রবণতা ঘিরে বিজ্ঞানের যে শাখা, তাকে বলা হয় ইম্যিউনোসায়েন্স। এর মাধ্যমেই কেন কোভিড-১৯ জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলছে, আমরা সে সম্পর্কে জানতে পারি।
বিশ্বজুড়ে এখন করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির চেষ্টা জোর গতিতে চলছে। কিন্তু, এর আগে নানা রোগের টিকাই বয়স্কদের দেহে সন্তোষজনকভাবে রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা তৈরি করতে পারেনি।
বিজ্ঞানের এ শাখাটির সূত্রে আমরা বুঝতে পারছি; তুলনামূলক কম বয়সের ব্যক্তির দেহে টিকা সফল হলেও, বয়স্করা এর সুফল বঞ্চিত হতে পারেন। অথচ, টিকার সুরক্ষা তাদেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
তবে এসব আজকের কথা নয়। আয়ু নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীরা বিগত কয়েক দশক ধরেই জানতেন বয়স বাড়লে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যেমন দুর্বল হয়, ঠিক তেমনি কোনো রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়তে থাকে। তাই টিকার মাধ্যমে খুব একটা সুফল পাওয়া যায় না।
গত জুনেই মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) জানায়, তাদের মানদণ্ড অনুসারে কোনো কোভিড-১৯ প্রার্থী টিকাকে চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে এটি গ্রহণকারী কমপক্ষে অর্ধেক ব্যক্তির দেহে- তা সফল হতে হবে।
টিকা পরীক্ষামূলকভাবে সকল বয়সের ব্যক্তির দেহেই দেওয়া হয়। এবং তা বয়স্কদের দেহে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না এমন আশঙ্কাই করা হচ্ছে।
শরীর বার্ধক্যের দিক এগিয়ে যাওয়ার এ বিজ্ঞানের শাখাটির নাম- জেরান্টোলজি। আর সিয়াটলে অবস্থিত ওয়াশিন্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেরান্টোলজিস্ট ম্যাট কাবেরলিন জানান, ''তরুণদের মধ্যে যেভাবে সফল হবে, কোনো টিকাই বয়স্কদের ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর হবে না। এটা প্রায় নিশ্চিত।''
আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা অসম্ভব রকমের জটিল। আর বয়স বাড়লে তার প্রত্যেক প্রক্রিয়াই ব্যাহত হয়। বৃদ্ধদের দেহে কিছু রোগ প্রতিরোধী কোষ সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ; তাদের দেহে জীবাণু সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রতিরোধে সক্রিয় হয়ে ওঠা টি-সেলের সংখ্যা কম থাকে। একইভাবে, কম থাকে জীবাণু ধ্বংসে অ্যান্টিবডি তৈরিকারী বি-সেল।
সবল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় কোষগুলোর সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। তবে ক্রমাগত পড়তির দিকে থাকায় বয়স্কদের দেহ এরফলে জীবাণু মোকাবিলা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
কাবেরলিন জানান, 'এই বাড়তি ক্ষয়ের কারণেই আমরা বৃদ্ধদের নানাবিধ দুরারোগ্য রোগে ভুগতে দেখি। তাছাড়া, তাদের দুর্বল স্বাস্থ্যের অবস্থাও এর মাধ্যমে উঠে আসে।''
প্রতিরোধী কোষের ক্ষয়ের কারণেই তাদের দেহে জীবাণুর সংস্পর্শে এসে ইনফেকশন বা প্রদাহ দেখা দেয় সহজেই। টিকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশও এরফলে নষ্ট হয়। কারণ, সকল টিকাই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নির্দিষ্ট একটি জীবাণু শনাক্ত করতে সাহায্য করে, প্রতিরোধ কোষে যুক্ত হয়ে। এজন্য ওই ভাইরাসের একটি দুর্বল সংস্করণ ব্যবহার করা হয়, যা প্রতিরোধ কোষকে আসল হুমকি শনাক্তে প্রশিক্ষিত করে।
আবার প্রদাহ মানেই দুর্বল ও কম পরিমাণ প্রতিরোধ কোষের অতিরিক্ত তৎপরতা। বৃদ্ধদের দেহে এটি বেশি দেখা দেয়। ফলে জীবাণুর বাহ্যিক হুমকি মোকাবিলায় ক্রমাগত প্রদাহের কারণে সম্পূর্ণ রোধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে।
বিশ্বব্যাপী এখন ৫০টির বেশি কোভিড প্রার্থী টিকা মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে। বয়স্কদের দেহে এসব টিকা কেমন প্রভাব ফেলবে, সে সম্পর্কে তারা এখনও নিশ্চিত নন বলেই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
কেমব্রিজে করা এক পরীক্ষায় ৫৬ বছর এবং তা বেশি বয়সের ৪০ জন রোগীর দেহে তাদের mRNA-1273 নামক প্রার্থী টিকা পরীক্ষা করে মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক মডের্না ইঙ্ক। পরীক্ষার ফলাফলে বেশ আশাব্যঞ্জক বলেই তারা দাবি করে। প্রার্থী টিকা তরুণদের মতোই বয়স্কদের দেহে সমান মাত্রার অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পেরেছে, বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়।
চীনের সাইনোভ্যাক বায়োটেক একই রকম সফলতার কথা জানায় তাদের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ভিত্তিতে। ওই দুই পর্যায়ে প্রায় ৪২১ জন ৬০ থেকে ৮৯ বছরের ব্যক্তির দেহে সংস্থাটির করোনাভ্যাক নামক প্রার্থী টিকা দেওয়া হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর এর ফলাফল প্রকাশ করে তরুণ এবং বয়স্ক সকলের মধ্যেই এটি কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
অন্যান্য গবেষণাধিন টিকা অবশ্য এ সফলতা দাবি করতে পারছে না। সম্প্রতি, ফাইজার এবং জার্মানির বায়োএনটেক তাদের BNT162b2 প্রার্থী টিকার প্রথম পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে এটি তরুণদের দেহে যতটুকু সফল হয়েছে- বয়স্কদের ক্ষেত্রে তার অর্ধেক হওয়ার কথা জানানো হয়।
অবশ্য, তরুণদের তুলনায় বয়স্করা বেশি পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি করেছিলেন। পূর্ব আলোচিত প্রদাহের কারণে সেই অতিরিক্ত তৎপরতাই এর প্রধান কারণ। তবে ওই অ্যান্টিবডি ভাইরাস প্রতিরোধে আদৌ কতটুকু সক্ষম- তা এখনও জানা যায়নি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া মানেই সুরক্ষিত থাকা নয়। বয়স ও শারীরিক অবস্থা অনুসারে তার কার্যকারিতার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে।
বেশিরভাগ ট্রায়ালেই কিছু সংখ্যক বয়স্ক ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এমন ১৮টি ট্রায়ালের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সেখানে বয়স্কদের বাদ রাখার ঝুঁকিও অনেক বেশি। এই ১৮টির মধ্যে অর্ধেকের বেশি ট্রায়ালে বয়সসীমা কম রাখা হয়। বাকি ট্রায়ালগুলোতে বয়স্কদের পূর্বাপর শারীরিক অবস্থা আমলে নিয়ে তাদের বাদ দেওয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।
সব মিলিয়ে করোনাভাইরাস ট্রায়ালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের কাছে বয়সসীমা এখন মূল আলোচনার প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে। টিকা যদি বয়স্কদের দেহে সত্যিই ফলপ্রসূ প্রতিরোধ না গড়ে তুলতে পারে, সেজন্যই তারা এখন অন্য ধরনের ওষুধের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবছেন। টিকা দেওয়ার আগে রোগীকে এসব ওষুধের ডোজ দেওয়ার মাধ্যমে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কিছুটা সক্রিয় করতে চান তারা। তারপর, টিকা দেওয়া হবে। বা টিকাতেও এমন ওষুধ মেশানো থাকতে পারে।
যেমন, কিছু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিনে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উদ্দীপ্তকারী উপাদান বা উচ্চমাত্রায় ভাইরাল অ্যান্টিজেন থাকে।
তবে কিছু বিজ্ঞানী এর চাইতেও ভালো আরেক উপায়ের কথা বলছেন। তারা এমন এক ধরনের ওষুধ তৈরির কাজ করছেন যা বৃদ্ধদের দেহে টিকা সহযোগী ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এর ফলে তাদের দেহ ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে আসল যুদ্ধটি চলিয়ে যেতে পারবে।
এ বিজ্ঞানীরা অবশ্য বয়সের ভারে দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন না। বরং তারা বিলুপ্ত কোষকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
পৃথিবীর বুক থেকে করোনাভাইরাস নির্মুল করতে হলে, সকল মানুষকে ফলপ্রসূ টিকা ব্যবস্থার আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। তাই চলমান অতিমারির কালে এ গবেষণা এক গুরুত্বপূর্ণ সমাধান অর্জনে আশার আলো দেখাচ্ছে।
- সূত্র: নেচার ডটকম
- অনুবাদ: নূর মাজিদ