চিনি বর্জন করুন, কয়েকদিনের মধ্যেই পরিবর্তন বুঝতে পারবেন
আমরা সবাই জানি, চিনি বেশি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত চিনি স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ ও ক্যান্সারের মতো স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। তাই অনেকের উচিত চিনি বর্জনের মতো অভ্যাস গড়ে তোলা।
চিনি খাওয়া কমালে যেমন অতিরিক্ত চিনি গ্রহণজনিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, ঠিক তেমনি এর কিছু চমকপ্রদ সুবিধাও আছে। ডালাসভিত্তিক পুষ্টিবিদ এবং নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান অ্যামি গুডসন বলেন, "চিনি কম খেলে প্রফুল্ল মন, হাস্যোজ্জ্বল ত্বক, সুস্থ ও মজবুত দাঁতের পাশাপাশি মস্তিষ্ক ও শরীর আরও বেশি কার্যক্ষম হয়ে ওঠে।"
এসব সুবিধা ভোগ করতে হলে আপনাকে আগে জানতে হবে কোন চিনি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়া আজ থেকেই আপনি কীভাবে চিনি খাওয়া কমাতে পারেন তাও জানা জরুরি।
কোন ধরনের চিনি আপনার জন্য ক্ষতিকর?
প্রথমে যেটা জানা জরুরি তা হলো, সব চিনি আপনার জন্য ক্ষতিকর নয়। কারণ প্রাকৃতিক চিনি ও কৃত্রিমভাবে যুক্ত করা চিনি বা অ্যাডেড সুগারের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে।
সাধারণত রুটি থেকে গ্লুকোজ, ফল ও নানা শাকসবজি থেকে ফ্রুকটোজ এবং দুধ থেকে পাওয়া ল্যাকটোজ হচ্ছে প্রাকৃতিক চিনি। এ খাবারগুলো গ্রহণের ফলে শরীরে শক্তি যোগানোর পাশাপাশি খাবারে মিষ্টতা ও স্বাদ যোগ করে খাবারগুলো খেতে আমাদের উৎসাহিত করে। এছাড়া এ খাবারগুলো মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন, খনিজ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানও রয়েছে। এসব পুষ্টি উপাদান শরীরে চিনির প্রভাবকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে।
উদাহরণস্বরূপ, আম এমন একটি ফল যার মধ্যে প্রাকৃতিক চিনির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। মাঝারি আকারের একটি আমে ২০ গ্রাম বা তার বেশি চিনি থাকতে পারে। কিন্তু এই একই আমে চিনির পাশাপাশি প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন সি এবং খাদ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রচুর পরিমাণে আঁশ রয়েছে। জিন মেয়ার ইউএসডিএ হিউম্যান নিউট্রিশন রিসার্চ সেন্টার অন এজিং-এর সিনিয়র সায়েন্টিস্ট এবং ডায়েট ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধের বিশেষজ্ঞ অ্যালিস লিচটেনস্টাইন বলেন, "আঁশ শরীরের চিনি শোষণ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। ফলে দেহে চিনির মাত্রা সামলানো সহজ হয়ে যায়।"
এক্ষেত্রে আপনি যদি অনেক পরিমাণে চিনিও খান এর পাশাপাশি আপনার শরীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক পুষ্টি উপাদানও গ্রহণ করছে। আর এ খাবারের আঁশ চিনির শোষণ প্রক্রিয়ার গতিকে কমিয়ে দিচ্ছে, ফলে রক্তে চিনির মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কোনো ঝুঁকি থাকছে না। বরং শরীরকে দীর্ঘসময় শক্তি ধরে রাখতে সহায়তা করছে।
অপরদিকে, অ্যাডেড সুগার হলো 'প্রক্রিয়াজাত চিনি' যা রান্নার সময় কিংবা খাবারের সঙ্গে আলাদাভাবে যুক্ত করা হয়। এ ধরনের চিনি সাধারণত প্যাকেটজাত খাবারে বেশি থাকে। প্যাকেটের গায়ে পুষ্টি তথ্য সম্বলিত লেবেলে 'অ্যাডেড সুগার' নামে এ চিনির পরিমাণ উল্লেখ থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) প্রতিদিন এ চিনি গ্রহণের পরিমাণ ৫০ গ্রাম পর্যন্ত সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়েছে।
খাবারের লেবেলে এ অ্যাডেড সুগারের আরও ২৬০টির বেশি নাম রয়েছে। সাধারণত প্যাকেটের লেবেলে কোনো উপাদানের শেষে যুক্ত ওএসই বা সিরাপ শব্দগুলোই চিনির ধরণ সম্পর্কে ধারণা দেয়। এ চিনি মূলত খাবারের প্রিজারভেটিভ হিসেবে, কিংবা টেক্সচার বা পরিমাণ বাড়াতে ব্যবহার করা হয়ে। আর অস্বাস্থ্যকর ও অতিমাত্রায় প্রক্রিয়াজাত খাবারের স্বাদ আরও বাড়াতে এ চিনি যোগ করা হয়।
এর চেয়েও খারাপ বিষয় হলো এ অ্যাডেড সুগার যুক্ত খাবারগুলোতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ কিংবা আঁশ বা ফাইবার থাকে না। ফলে এ খাবার গুলো দেহের চিনির ভারসাম্যকে ঠিক রাখতে পারে না, যা পরবর্তীতে শরীরের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
মেয়ো ক্লিনিকের নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান পুষ্টিবিদ ক্যাথরিন জেরাটস্কি এ বিষয়ে বলেন, "এ কারণেই এ অ্যাডেড সুগারকে 'ফাঁকা ক্যালোরি বলা হয়। কারণ এতে ক্যালোরি রয়েছে ঠিকই কিন্তু কোনো পুষ্টি উপাদান নেই।"
অ্যাডেড সুগার গ্রহণ কমালে যেভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানো যায়
অ্যাডেড সুগার অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণের সঙ্গে যুক্ত ঝুঁকিগুলো অত্যন্ত গুরুতর। অতিরিক্ত অ্যাডেড সুগার গ্রহণ করলে রোগ প্রতিরোধে বাঁধা সৃষ্টি করে এমন রোগ, যেমন- ক্রোনস ডিজিজ এবং মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের মতো রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ে। একটি ২০২৩ সালের বিএমসি মেডিসিন গবেষণা অনুসারে অ্যাডেড সুগারের মাত্রা পাঁচ শতাংশ বাড়ালেই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে ৬ শতাংশ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ১০ শতাংশ।
এ ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বড় কারণ হলো, অতিরিক্ত চিনি শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার কারণে এগুলো দেহে চর্বি হিসেবে জমা হয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে স্ট্যানফোর্ড হেলথ কেয়ারের ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান এবং নিবন্ধিত ডায়াবেটিস কেয়ার ও এডুকেশন বিশেষজ্ঞ এলেইন হোন বলেন, এর ফলে দেহের ওজন বেড়ে যায় এবং প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নিঃসরণের মাত্রা কমে যায়। যার কারণে ডায়াবেটিস, স্থূলতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ঝুঁকি বাড়াতে থাকে।
গুডসন বলেন, অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমতে পারে। এর ফলে লিভারের টিস্যুতে দাগ পড়ে এবং এর কার্যক্ষমতা কমে যায়। এ রোগকে ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বলা হয়।
এছাড়া অ্যাডেড সুগার অন্ত্রে থাকা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এর ফলে অন্ত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ দেখা দিতে পারে এবং স্বাস্থ্যকর অনুজীবগুলো তার ভারসাম্য হারাতে পারে। ম্যাসাচুসেটসে প্র্যাকটিস করা পুষ্টি মনোচিকিৎসক এবং 'দিস এজ ইয়র ব্রেইন অন ফুড' বইয়ের লেখক উমা নাইডু এ বিষয়ে বলেন, "অ্যাডেড সুগার নানা ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা তৈরি করতে পারে।"
চিনি খাওয়া কমানোর কিছু চমকপ্রদ উপকারিতা
অ্যাডেড সুগার বর্জন বা খাওয়া সীমিত করা গেলে শুধু ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে নয়, বরং এটি জীবান মানও উন্নত করতে সহায়তা করতে পারে। এর বড় কারণ হলো, চিনি কম খেলে দেহে এজিই'স (অ্যাডভান্সড গ্লাইকেশন এন্ড-প্রোডাক্টস) নামক ক্ষতিকর অণুগুলোর উৎপাদন হ্রাস পায়। আর এ অণুগলোর উৎপাদন হ্রাস পেলে অকাল বার্ধক্য ও অ্যালঝেইমরাসহ বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
নিউ হ্যাম্পশায়ার একাডেমি অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটেটিকসের প্রেসিডেন্ট এবং নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান জেন মেসার বলেন, "যখন রক্তে চিনির পরিমাণ অতিরিক্ত মাত্রায় থাকে তা লিপিড বা কোলাজেন এবং ইলাস্টিনের মতো প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হলে ত্বকে বলিরেখা তৈরি করে কিংবা ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে বার্ধক্যের মতো লক্ষণ তৈরি করতে পারে।"
এ কারণে চিনি কম খেলে ত্বকের স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হয়। আরক গবেষণায় দেখা গেছে, চিনি মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে যা ঘুমের মানের ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন, অতিরিক্ত চিনি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। আবার রক্তে চিনির মাত্রা বেশি কমে গেলে ঘুমের মধ্যে তৃষ্ণা, ক্ষুধা বা বাথরুম ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে পারে।
এছাড়া, চিনি মস্তিষ্কে আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী রাসায়নিকগুলোকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, যা আপনার মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। হোন বলেন, এই কারণেই অ্যাডেড সুগার কমানোর কারণে 'বিষণ্নতাজনিত ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।" আর এটি স্ট্রেসের মাত্রা কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এ বিষয়ে গুডসন বলেন, "অ্যাডেড সুগার গ্রহণ কমালে রক্তে চিনির মাত্রা স্থিতিশীল থাকে এবং এতে শরীরের কার্যক্ষমতাও অনেকটা বেড়ে যায়।"
সাময়িকভাবে চিনি কমানোর উপকারিতা
চিনি স্থায়ীভাবে বা দীর্ঘমেয়াদে খাওয়া কমালে সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়। তবে সাময়িকভাবে কমালেও এর কিছু ইতিবাচক প্রভাব আছে। পুষ্টিবিদ জেরাটস্কি এ বিষয়ে বলেন, "একটি ছোট গবেষণায় দেখা গেছে, লিভার স্টিয়াটোসিসে আক্রান্ত কিশোর ছেলেরা মাত্র আট সপ্তাহের জন্য কম চিনি-সমৃদ্ধ ডায়েট অনুসরণ করে এ রোগ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে।"
হার্ভার্ড টি. এইচ. চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথের এপিডেমিওলজি এবং পুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক ওয়াল্টার উইলেট বলেন, অ্যাডেড সুগারের পরিমাণ কমালে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি দ্রুত কমে যেতে পারে। তার মতে, মাস বা বছর নয় মাত্র কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
এছাড়া পরীক্ষার আগে কম চিনি গ্রহণ পড়ায় মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে চিনি মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় এবং মস্তিষ্কে মেমোরি রিসেপ্টরগুলোকে বাধা দেয়।
গুডসন বলেন, "স্বল্প সময়ের জন্য অ্যাডেড সুগার গ্রহণ কমানো গেলে হঠাৎ রক্তে চিনির মাত্রা কমে যাওয়ার মতো সমস্যা এড়ানো সম্ভব। আর সামগ্রিকভাবে এটি চিনি গ্রহণের ইচ্ছাকেও কমিয়ে দেয়। এভাবে অ্যাডেড সুগার গ্রহণ কমানোর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্ষমতা ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস বজায় রাখাও সহজ হয়।"
চিনি গ্রহণ কমানোর উপায়
চিনি খাওয়া ছাড়তে চাইলে সবার প্রথম খুঁজে বের করতে হবে যে, আপনি কোত্থেকে অতিরিক্ত অ্যাডেড সুগার খাচ্ছেন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক উইলেটের পরামর্শ হলো, সোডা বা অন্যান্য চিনি-মিশ্রিত পানীয় এড়িয়ে চলা কিংবা মাঝে মধ্যে গ্রহণ করা। উদাহরণস্বরূপ তিনি বেলেন, ২০ আউন্স কোকা-কোলার একটি বোতলে ৬৫ গ্রাম অ্যাডেড সুগার থাকে, যা দৈনিক চিনি গ্রহণের মাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
ডায়েটিশিয়ান মেসার বলেন, খাবারের লেবেলে অ্যাডেড সুগারের পরিমাণ পরীক্ষা করা অভ্যাসে পরিণত করা অত্যন্ত জরুরি। তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, "আমরা অনেক সময় একসঙ্গে একের অধিক খাবার খেয়ে ফেলি। এটি চিনির মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেয়।"
তার মতে, রান্নায় অ্যাডেড সুগারের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে কিংবা দারুচিনি, জয়ফল, ভ্যানিলা বা কাঠবাদামের রস মসলা ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ এসব মসলা অতিরিক্ত চিনির ব্যবহার ছাড়াই খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়।
গুডসন এ বিষয়ে বলেন, "ছোট ছোট পদক্ষেপ এবং ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে চিনি গ্রহণ কমালে আপনি ভালো অনুভব করবেন, কার্যক্ষমতা আরও বাড়বে এবং স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে।"