বৈশ্বিক ভ্যাকসিন পরিবহন ব্যবস্থা অপ্রস্তুত,কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে না
পৃথিবীব্যাপী মহামারি নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেই চলেছে। যার ফলে ব্যাহত হয়েছে বৈশ্বিক যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাও। বিশ্বমারির সঙ্কট থেকে পৃথিবীকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছে সম্ভাব্য প্রার্থী ভ্যাকসিনগুলো। কিন্তু, জাহাজ, বিমান এবং ট্রাকে করে পণ্য পরিবহন কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, উৎপাদকদের কাছ থেকে কোভিড-১৯ প্রতিষেধকের চালান বিশ্বময় শত শত কোটি মানুষের পৌঁছে দেওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা এখনও প্রস্তুত নয়।
বহুমুখী সমস্যা:
বিশ্বমারিতে পণ্য পরিবাহী ব্যবসাগুলো নানাবিধ সঙ্কটের মুখে পড়েছে। কার্গোবাহী জাহাজের পরিবহন সক্ষমতা কমে আসা এবং মালবাহী বিমানের সঙ্কট যেমন আছে, ঠিক তেমনি কবে নাগাদ উৎপাদিত ভ্যাকসিন বাজারে আসবে; সেটাও ঠিকঠাক জানা নেই তাদের। একারণে অগ্রিম প্রস্তুতি নেওয়াটা হয়ে পড়েছে আরও কঠিন।
পাশাপাশি মহামারির কারণে সৃষ্ট পণ্য সরবরাহের চাপ- অনেক সময় মোকাবিলা করতে হচ্ছে সীমিত জনবল আর বাহন সঙ্কট নিয়েই।
জাহাজে মালামাল পরিবহনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে শুল্ক, পণ্য ঘোষণা এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কিত নথিপত্র। মহামারির অনেক আগে থেকেই- বহু বছর ধরে জাহাজে পণ্য পরিবাহীরা এসব দীর্ঘ এবং মান্ধাতার আমলের জটিল প্রক্রিয়াকে আধুনিকীকরণের চেষ্টা করে এসেছেন। সেই চেষ্টার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি উপলদ্ধি করা যায় বর্তমান সময়ে। অচিরেই এ সমস্যার সমাধান না হলে; তাতে পাতলা কাঁচের শিশিভর্তি সংবেদনশীল ভ্যাকসিনের চালান বিপুল পরিমাণে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ অনেক দীর্ঘসূত্রিতার ব্যাপার হয়ে পড়বে।
দ্রুত কার্যকর প্রতিষেধক উৎপাদন এমনিতেই দুরূহ কাজ, কিন্তু তা বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেওয়া ভিন্নমাত্রার অনেক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। পরস্পরবিরোধী বেশ কিছু ঘটনার ধারাবাহিকতা এ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। যেমনটি দেখা যাচ্ছে ভ্যাকসিন পরিবহনের চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে। বিশ্ববাণিজ্যের পরিবহন অবকাঠামো যখন মহামারির তাণ্ডবে ব্যবসার পরিধি কমাতে বাধ্য হয়েছে, ঠিক তখনই সাতশ' কোটি মানুষের চাহিদা পূরণে ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলোকে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাতে হচ্ছে।
এক্ষেত্রেও, পণ্য পরিবাহী কোম্পানিগুলোই সামলাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য উপকরণ পৌঁছে দেওয়ার চাপ। নিকট ভবিষ্যতে এ চাপ আরও বাড়বে, তা বলাবাহুল্য। ফলে একইসঙ্গে, বহুবিধ জরুরি পণ্য সরবরাহের মধ্যে কোনটি অগ্রাধিকার পাবে, তা নিশ্চিত করাটাও হবে এক জটিল বিষয়।
সমস্যাটির ব্যাপকতা সম্পর্কে শুধু এটাই বলা যায়, আধুনিক যুগে কোনো নির্দিষ্ট একটি পণ্যের উৎপাদন, এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। তাই ইতিহাসে নজিরবিহীন হতে চলেছে ভ্যাকসিন পণ্যের বাজারজাতকরণ।
''আমরা মোটেই প্রস্তুত নই'' বলেন সান ফ্রান্সিসকো ভিত্তিক পণ্য সরবরাহকারী কোম্পানি ফ্লেক্সপোর্টে'র আকাশপথে পণ্য পরিবহন শাখার বৈশ্বিক প্রধান নীল শাহ জোনস। চলতি সপ্তাহেই লজিস্টিকস কোম্পানিগুলোর মুখ্য নির্বাহীদের এক ওয়েব সেমিনারে একথা স্বীকার করেন তিনি।
''আমাদের সবাইকে সততার সঙ্গে ঘাটতিটা মেনে নেওয়া উচিৎ। ভ্যাকসিন সরবরাহ ব্যবস্থা আর পিপিই সরবরাহ করা এক বিষয় নয়। ভ্যাকসিন সরবরাহ ব্যবস্থা অনেক সংবেদনশীল, এজন্য বিশেষ প্রস্তুতিও প্রয়োজন। এ পণ্যটি যতদ্রুত সম্ভব সাবধানতার সঙ্গে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। পিপিই'র চালান বন্দরে কয়েকদিন বেশি পড়ে থাকলে তা নষ্ট হয় না, কিন্তু ভ্যাকসিন এর ফলে নষ্ট হয়ে যাবে'' যোগ করেন তিনি।
প্রয়োজন ৮ হাজার পণ্য পরিবাহী উড়োজাহাজ:
এমিরেটস এয়ারলাইন্সের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান স্কাইকার্গো'র ফার্মাসিটিক্যাল পণ্য শাখার প্রধান জুলিয়ান সাকচ অনুমান করেন, একটি বোয়িং ৭৭৭ বিমানে ভ্যাকসিনের ১০ লাখ ডোজ পরিবহন করা সম্ভব। সে হিসাবে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যার জন্য প্রতিষেধক সরবরাহে এমন ৮ হাজার কার্গোবাহী বিমানের প্রয়োজন হবে।
সাকচ জানান, চ্যালেঞ্জ থাকলেও এটা করা সম্ভব। কিন্তু এনিয়ে বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং কৌশল না থাকলে, তা বাস্তবায়ন করা মুশকিল হয়ে পড়বে। আপাতত, ভ্রমণকারীর সংখ্যা সীমিত থাকায় যাত্রীবাহী বিমানকে পণ্য পরিবহনের উপযোগী করে সহজেই রূপান্তরিত করা যাচ্ছে। দরকারি চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকে শুরু করে আমের মতো মৌসুমি ফল; সবকিছুই দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছে এসব বিমান। বর্তমানে এভাবে পণ্য সরবরাহে ৭০টি যাত্রীবাহী বোয়িং ৭৭৭ বিমান ব্যবহার করছে এমিরেটস।
হিমায়িতকরণের সমস্যা:
ভ্যাকসিনবাহী যানবাহনের ধারণ উপযোগিতার প্রধান শর্ত সেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, বাজারে প্রথমদিকে যে ভ্যাকসিনগুলো আসবে- তা সংরক্ষণে নুন্যতম ২ থেকে ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। জাহাজ, বিমান বা সড়কপথে ভ্যাকসিনবাহী সকল যানে এব্যবস্থা না থাকলে তা প্রতিষেধকের গুনগত মান পরিবর্তন করবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধটির চালান নষ্ট হয়ে যাবে।
আবার কিছু কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উৎপাদনে নতুন কিছু জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহৃত হওয়ায়; তা সংরক্ষণে মাইনাস ৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের হিমশীতল সুরক্ষা পরিবেশ দরকার। তাপাঙ্কের বিন্দুমাত্র ব্যতয় উপরে আলোচিত বিপর্যয়ের কারণ হবে।
কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন:
কিছু সমস্যা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উদ্বিগ্ন করছে।
ভ্যাকসিন যখন এত সংবেদনশীল এবং দামি; তখন কিভাবে তার সরবরাহ প্রত্যন্ত এবং দারিদ্রপীরিত অঞ্চলে- স্বচ্ছতা এবং দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে? এমন বেশ কিছু প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলছে বিশেষজ্ঞদের। এসব এলাকায় ড্রোনের সাহায্যে জরুরি ওষুধের চালান পৌঁছে দেওয়া সম্ভব বটে। কিন্তু, বিপুল সংখ্যক ও অতি-স্পর্শকাতর ভ্যাকসিন কিভাবে পৌছানো হবে! বিশেষজ্ঞরা তার সমাধান খুঁজে চলেছেন।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তারা এখনও কার্যকর কোনো সমাধান বের করতে পারেননি।
অন্যদিকে, প্রতিষেধক প্রস্তুতকারকদের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় থাকা বৈশ্বিক জাহাজ কোম্পানিগুলো কিন্তু নিজেরাই সংঘবদ্ধ ও প্রস্তুত নয়। সময় থাকতেই তাদের প্রস্তুতির গতি সম্পন্ন করতে হবে।
নীল শাহ জোনস এবং তার কোম্পানি ফ্লেক্সপোর্ট- ভ্যাকসিন উৎপাদনে জড়িত একাধিক ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে অগ্রিম আলোচনা করছে। এরপরও, পণ্যটি সরবরাহে ঠিক কী ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার, তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
''নিশ্চিতভাবে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশাপূরণ করে তারা খুব দ্রুত ভ্যাকসিন বাজারে ছাড়তে চায়। ভ্যাকসিনের সঠিক সরবরাহ নিয়ে কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীরা তাই খুব উদ্বিগ্ন'' জানান শাহ।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৬০টি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, এরমধ্যে মাত্র ২৫টি মানবদেহে পরীক্ষামূলক পর্যায়ের স্তরে রয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শেষ ধাপের দিকে থাকা প্রার্থী ভ্যাকসিন উৎপাদক কোম্পানিগুলো; চলতি বছরের শেষ দিকেই নানা দেশের সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে জরুরিভিত্তিতে ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমতি নেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করছে। এ লক্ষ্যের আওতায় প্রথমে স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি এমন প্রথম সারির পেশাজীবীরা প্রথমে ভ্যাকসিন পাবেন।
লক্ষ্য ২০২১ সাল:
পরিশেষে, বলা যায়, প্রথমে বিশ্বের সকল দেশে কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিন প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতির পরিকাঠামো বিদ্ধংসী জীবাণুটির পুনঃসংক্রমণ রোধে এবং স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু, ২০২১ সালের আগে এমনটা ঘটার সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।
এরমধ্যে, বর্তমানে উৎপাদকদের সঙ্গে নানা প্রভাবশালী ও ধনী দেশের সরকারের ভ্যাকসিন ক্রয় চুক্তি চলছে। ব্যাপক মাত্রায় উৎপাদনের লক্ষ্যে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিদ্যমান অবকাঠামো ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কিন্তু, দ্রুততার সাথে উৎপাদিত ভ্যাকসিন গবেষণাগারে কাজ করলেও চিকিৎসালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে অকার্যকর হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি করছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন অনেক প্রযুক্তি এখনও অপ্রমাণিত, তাই ব্যাপক মাত্রায় উৎপাদনটাও একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তবে শীর্ষ ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলোর মুখ্য নির্বাহীরা স্বীকার করছেন জে, উৎপাদনের চাইতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করাটাই হতে চলেছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
মার্ক অ্যাড কো. –এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কেনেথ ফ্রেইজার বলেন, ''বেশিরভাগ সময় মানুষ দ্রুত ভ্যাকসিন উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া নিয়েই বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু, অনেকদিক থেকে এর চাইতে বড় সমস্যাটা তারা বুঝতে পারছেন না। উৎপাদিত পণ্যের সঠিক সরবরাহটাই হচ্ছে সেই বিষয়। পৃথিবীর সকল মানুষ সুরক্ষিত হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা কেউই এককভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারব না। আমাদের এমন একটি প্রতিষেধক দরকার যা ব্যাপক উৎপাদন এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ করা সহজ হবে।''
- মূল প্রতিবেদন: The supply chain to save the world is unprepared for a vaccine
- অনুবাদ: নূর মাজিদ