বড় শহরগুলোতে কেনো গড়ে উঠছে ছোট ছোট ‘নগর-বন’
নেদারল্যান্ডসের উটরেখট। জুনের উষ্ণ বিকেল। একটি এলম ও উইলো ঝোপে পাখির কিচিরমিচির। প্রায় বাস্কেটবল কোর্ট সাইজের মুজিয়েকপ্লাইন নামের বনটি একটি ১৮ তলা দালান ও রেললাইনের মাঝখানে। ২০১৮ সালে এ বন গড়ে তোলার আগে জায়গাটিতে পার্কিং লট ছিল।
উটরেখট শহরে এমন ছোট আকারের বন আরও সাতটি আছে। নেদারল্যান্ডসজুড়ে এমন বন আছে ১৪৪টি। এ বছরের শেষে সংখ্যাটি ২০০ ছাড়িয়ে যাবে।
ইউরোপ, ভারত ও অন্যান্য দেশে শহরে এমন ছোট ছোট বন গড়ে তোলা হচ্ছে। উদ্দেশ্য বড় জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। এই বনগুলো নানা প্রজাতির পোকামাকড়, প্রাণিসহ নতুন প্রজাতির উদ্ভিদকেও আকৃষ্ট করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের ছোট ছোট সবুজায়ন কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে অবদান রেখে শহরগুলোকে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে।
২০১৫ সালে প্রথম নেদারল্যান্ডসে এ ধরনের প্রথম বন তৈরি করা হয়। এরপরই ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ ধারণার উদ্যোক্তা দান ব্লাইখরড। এসব নগর-বন এক বছরের মধ্যেই তৈরি করা যায়।
মিয়াওয়াকি মেথড
ছোট শহুরে বন তৈরি করা হয় জাপানি উদ্ভিদবিদ আকিরা মিয়াওয়াকির কাজের ওপর ভিত্তি করে। মিয়াওয়াকি ১৯৭০-এর দশকে পতিত জমিতে বনায়নের জন্য দেশি প্রজাতির চারাগাছ লাগানোর একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
মিয়াওয়াকি এক প্রবন্ধে লেখেন, এ ধরনের বনায়নে গাছ বাছাইয়ের জন্য ওই অঞ্চলের প্রধান গাছপালাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। বনায়ন করতে হয় স্থানীয় প্রাকৃতিক বন অনুসারে।
মিয়াওয়াকি মেথডে এক মিটারের মতো ছোট্ট জায়গায়ও ক্ষুদ্র বন সৃষ্টি সম্ভব। যদিও কয়েক প্রজাতির গাছ লাগানোর জন্য কমপক্ষে ছয় মিটার জায়গা হলে সুবিধা হয়।
প্রকৌশলী শুভেন্দু শর্মা ভারতের টয়োটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ২০০৯ সালে তিনি প্রথম এ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারেন। মিয়াওয়াকি তখন ভারতের টয়োটা ফ্যাক্টরিতে একটি বন তৈরি করেছিলেন। মিয়াওয়াকি মেথডকে পরে শুভেন্দু জনপ্রিয় করে তোলেন।
শুভেন্দু এ ধরনের বন তৈরির জন্য একটি কোম্পানি চালু করেন। নিজের বাড়ির পেছনে তিনি পদ্ধতিটি নিয়ে গবেষণা চালান। ২০১৪ সালে তিনি এরকম বন তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কিত একটি ভিডিও অনলাইনে ছাড়েন।
এরপর ধারণাটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শর্মার প্রতিষ্ঠান অ্যাফরেস্ট ৪৪টি শহরে বন তৈরি করতে সাহায্য করেছে। বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে এরকম বন গড়ে তোলা হচ্ছে। এশিয়ার অনেক শহরে মিয়াওয়াকি স্টাইলের নগর-বনের ধারণাকে লুফে নেওয়া হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা আগামী ফেব্রুয়ারিতে আরও অনেকগুলো বন তৈরির পরিকল্পনা করছে। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঘোষণা দিয়েছেন লাহোরে ৫০টি মিয়াওয়াকি বন তৈরি করা হবে। ভারতের চেন্নাইয়ে ১ হাজার নগর-বন তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বন তৈরি
শুভেন্দু শর্মার তত্ত্বাবধানে ২০১৫ সালে আইভিএন নেচার এডুকেশন নামক সংস্থা প্রথম ডাচ টাইনি ফরেস্ট সৃষ্টি করে। বন তৈরির প্রথম ধাপে স্থানীয় প্রজাতির গাছের ওপর জরিপ চালানো হয়। ছোট বনে সাধারণত ২০ থেকে ৪০ প্রজাতির বৃক্ষ ও গুল্ম প্রজাতির উদ্ভিদ থাকে। প্রতি বর্গমিটারে তিনটি করে চারা লাগানো হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা, স্কুল ও পৌরসভাকে সঙ্গে নিয়ে টাইনি ফরেস্ট তৈরির প্রকল্পে কাজ করে আইভিএন। এই বন সাধারণত ২০০ থেকে ২৫০ বর্গমিটার জায়গার মধ্যে বানানো হয়। বন যেকোনো আকারের হতে পারে, তবে কমপক্ষে চার মিটার চওড়া হতে হবে।
সামাজিকভাবে টেনিস কোর্ট আকারের (২০০-২৫০ বর্গমিটার) বন তৈরির খরচ নেদারল্যান্ডসে ২০ লক্ষ থেকে ২২ লক্ষ টাকা। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছোট পরিসরে আরও কম খরচে, প্রায় ৩ লক্ষ টাকায় এ ধরনের বন তৈরি করা যায়।
নেদারল্যান্ডসে এখন প্রায় ৬০টি বাড়ির পেছনে এরকম ছোট পরিসরের বন আছে। যাদের জায়গা কম, তাদেরকে উৎসাহ দিতে আইভিএন ২০১৯ সালে টুইনি ফরেস্ট প্রকল্প চালু করে। এ প্রকল্পের আওতায় মাত্র ১৩ হাজার টাকায় স্রেফ ৬ বর্গমিটার জায়গায় ছোট্ট বন বানানো যাবে।
জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে অবদান
গত এপ্রিলে ওয়াগেনিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, নগর-বনগুলোতে বেশ কয়েক প্রজাতির প্রাণি ও উদ্ভিদকুল থাকে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১১টি 'টাইনি ফরেস্টে' ৬৩৬ প্রজাতির প্রাণির দেখা পেয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। বনগুলোতে প্রথমে লাগানো উদ্ভিদপ্রজাতির পাশাপাশি বাড়তি আরও ২৯৮ প্রজাতির উদ্ভিদ পেয়েছেন তারা। এ বনের যত্ন বলতে মাঝেমধ্যে কেবল অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া আগাছা ছেঁটে দিতে হয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ছোট্ট প্রকল্প শহরের জীববৈচিত্র্য বাড়াতে পারে। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকরা কেবল উটরেখটের মুজিয়েকপ্লাইন বনেই ৪০টি ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণির দেখা পেয়েছেন।
ওয়াগেনিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফ্যাব্রিস অটবার্গ বলেন, নগর অঞ্চলে সবুজ জায়গা বৃদ্ধির জন্য এসব ছোট বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অটবার্গ বলেন, তাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করা হয় তিনি বনগুলোতে দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদ পান কিনা। কিন্তু সাধারণ প্রজাতির উদ্ভিদ-প্রাণী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা গুবরেপোকা, মৌমাছির মতো সাধারণ প্রজাতির প্রাণিরা খাদ্যশৃঙ্খলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কার্বন ও জলবায়ু পরিবর্তন
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে নেদারল্যান্ডসের ছোট বনগুলো গড়ে ১২৭.৫ কিলোগ্রাম কার্বন শোষণ করেছে।
অটবার্গ জানান, নতুন বনগুলো পরিণত হওয়ার পর একটি ২৫০ বর্গমিটার বন গড়ে প্রতি বছর ২৫০ কিলোগ্রাম কার্বন শোষণ করে নেবে। যা একটি ১০-১৫ বছর বয়সী প্রকৃত ডাচ বনের ২৫০ বর্গমিটার জায়গা কর্তৃক এক বছরে শোষণ করা কার্বনের সমান।
যদিও ছোট ছোট ঝোপ আকারের বন একা জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন কার্বন নিঃসরণ কমানো।
এই নগর-বনায়ন প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতি ও শিশুদের মধ্যে আত্মিক বন্ধন গড়ে তোলা।
এ ধরনের ক্ষুদ্র বনায়ন শহরের পরিবেশ একটু ঠান্ডা করতে, পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে, জীববৈচিত্র্য বাড়াতে সাহায্য করে।
স্থানীয় প্রজাতির গাছ ব্যবহার করে, যেগুলো স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে অনায়াসে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে, এমন ছোট বন সৃষ্টি করলে টেকসই বাস্তুতন্ত্র তৈরি সম্ভব। ছোট বনে যদি ছোট ঘাস লাগিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে 'ছোট বাস্তুতন্ত্র' তৈরি হয়ে যাবে।
এ বন তৈরির জন্য সঠিক প্রজাতির উদ্ভিদ নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের শহরগুলো এখন ইট-পাথরের খাঁচার নামান্তর। একটুখানি সবুজের ছোঁয়া ঢাকার মতো শহরে বিরল। সারা বিশ্ব যখন ছোট নগর-বনায়নের দিকে এগোচ্ছে, আমরা তখন মেতেছি গাছ কেটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো শহরের ফুসফুসগুলোর গাছ কেটে ফেলার উৎসবে। অবিলম্বে এই বৃক্ষনিধন বন্ধ করে কর্তৃপক্ষের উচিত বাংলাদেশের শহরগুলোতে মিনি 'নগর-বন' গড়ে তোলা।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক