হবেকি'র নতুন গ্রাফিতি 'বেকারের জীবনডাটা'
পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার মিরপুর, মহাখালী, আগারগাঁওয়ের দেয়ালে 'হবেকি'র দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতি দেখা যাচ্ছে। গ্রাফিতিগুলোর প্রধান চরিত্র সুবোধ। সুবোধকে দিয়ে সমাজের সংকট প্রকাশ্যে আনছেন শিল্পী, সে সঙ্গে জানাচ্ছেন সময়ের দাবি। কিন্তু রহস্য কাটছে না একটা প্রশ্নের, কে করছে গ্রাফিতিগুলো?
ভয়ার্ত-বিধ্বস্ত এক মানুষ (সুবোধ) সূর্যকে খাঁচাবন্দি করে পালাচ্ছে- এমন দৃশ্য অভাবনীয়। সূর্যটাকে সে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? এখানে রাখলে কি অন্ধকার এটিকে গ্রাস করবে? এক প্রশ্নের সূত্র ধরে আসে আরো আরো প্রশ্ন। সুবোধ কি জানে ভোর কবে হবে? ফুল বাড়িয়ে দিয়ে সুবোধ নতুন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, 'হবে কি?' খাঁচা, গরাদখানা সুবোধের সঙ্গে সঙ্গেই ঘোরে-এটা কিসের ইঙ্গিত?
সময়ের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে সুবোধ। অদ্ভুত তার বেশবাস আর ভঙ্গি। বলা যায়, মানুষ তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।
সুবোধের শিল্পীর মূলমন্ত্র বুঝি এমন- দি বিউটিফুল পেইন্টিংস আর দোজ হুইচ স্পিক অব দ্য আগলিয়েস্ট। তাইতো 'সুবোধ তোর ভাগ্যে কিছু নেই' বলতে তার কোনো দ্বিধা দেখি না। যেমনটা দেখছি ঈদের পর অঙ্কিত নতুন গ্রাফিতিতে। মিরপুর ২ নম্বরের লাভ রোডের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা গ্রাফিতিটিতে দেখা যাচ্ছে এক বেকারের প্রতিচ্ছবি। শিরোনাম, বেকারের জীবনডাটা। ঠিক নীচেই আছে একটি বারকোড যেটি স্ক্যান করলে পাওয়া যাবে একটি দীর্ঘ কবিতা। এ কবিতায় হবেকি বেকারের জীবন যায় যেমন, তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। কবিতাটি হুবহু নীচে তুলে দেওয়া হলো:
আমার এ গল্পটা
জীবনের প্রকল্পটা
শুনে কেউ দেবে টিটকারী
কেউবা হাসির পিচকারী
কারও কাছে এটা মশকারী
বেকারের ছন্নছাড়া জীবন
দেখ্না আহা কাটে কেমন
মিছে ছল ভরা এ ভূবন
একটুও নেই আলোছটা।
ঝলমল এই শহরের কত পাড়াতে
আমি এক উদ্ভট থাকি ভাড়াটে
লেখাপড়া পাট সে তো চুকিয়েছি কবে
জানিনা তো চাকরীটা হবে কিনা হবে
গ্রাম হতে মা'র ফোন প্রতি দিনই আসে
মা'র মুখ দুটি চোখে মাঝে মাঝে ভাসে
বলেছে মা কতদিন যাই না'ক বাড়ি
একবার যেন ঘুরে আসি তাড়াতাড়ি
মিছে কথা বলি মাকে প্রতি বারেতেই
মা আমার চাকরীটা হল বলে এই
কেটে যায় দিন,ভাবনা বিহীন
বাড়ে শুধু ঋণ-জীবন মোহনায়।
কখনও বা থাকি ভাড়া কারও চিলেকোঠা
আলো নেই দেয়ালের রঙ চটা চটা
কখনওবা গ্যারেজের পাশে কোন ঘর
মশাদের গান শুনি রাত দিনভর
জানালার পাট দুটো পেরেক দিয়ে আঁটা
শ্যাওলাতে ভরে আছে দেয়ালের গা-টা
মেঝেটাও স্যাঁত স্যাঁতে প্লাস্টার গেছে উঠে
টিকটিকি আর তেলাপোকা বন্ধুরা জুটে
চৌকিটার দুটো পা ইট দিয়ে গড়া
সাবধানে উঠানামা করি নড়াচড়া
কেটে যায়...।
চাকরী নেই তাতে বলুন কি হয়েছে
দিন ঠিকই চলে যায় ধার বাকীতে
টিউশনি করি দুটো পাই কিছু টাকা
মাসের দশদিন যেতে যেতে পকেটটা হয় ফাঁকা
দু মাস হল ঘর ভাড়া পারিনি দিতে
ঘরে ফিরি তাইতো আমি গভীর রাতে
লণ্ড্রীতে কত পায় নেইনি তো খোঁজ
মুদিওয়ালা দিচ্ছে হানা কদিন থেকে রোজ
বারোটায় ঘুম হতে প্রতিদিন উঠি
বাড়িওয়ালা নেই ঘরে শুনে তাই ফুটি
কেটে যায়...।
সিগারেট টানি আমি ট্রিপল ফাইভ
জামাজুতো ঝকঝক টিপটপ লাইফ
ড্রেস সার্কেলে দেখি ছবি মাসে চার
হাসি খুশি ভরা মুখ থাকে যে আমার
দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত পড়ি
চাকরির বিজ্ঞপ্তিটা সবার আগে খোঁজ করি
Semi Govt, govt-private corporation
experience চায় যে ওরা ভীষণ ভীষণ
কেউবা চায় ব্যাংক ড্রাফট কেউ বা জামানত
ভুয়া কোম্পানি দুদিন পরে মারে যে চম্পট
Bio data ছবি চায় তিন কপি করে
একটা এপ্লিকেশনে ভাই ফিফটি টাকা পড়ে
চাকরি হবেনা জানি তবু পাঠিয়ে তা দেই
দিবাস্বপ্ন দেখি চাকরি পেলাম বুঝি এই
কেটে যায়...।
মাঝেমাঝে পোস্টম্যান চিঠি নিয়ে আসে
চাকরিটা হয়েছে ভেবে ফাটি উল্লাসে
ভেতরের লেখা পড়ে যখন নিশ্চিত হই
থেমে যায় নিমিষেই সকল হৈ চৈ
পিয়ন চাচা গোমড়া মুখে ফিরে চলে যান
ডেকে তারে বলি একটা খাননা মিষ্টি পান
আশা তবু থাকে আমার বুকটাতে জুড়ে
মনের আকাশে হাজার রঙের ঘুড্ডি উড়ে
ইন্টারভিউ শেষে আমার ভুল ভেঙ্গে যায়
মালিকের এক আত্মীয় চাকরিটা পায়
কেটে যায়...।
কখনওবা পদব্রজে শহরটাতে ঘুরি
ক্ষিদে পেলে খাই যে সস্তায় আটার ডাল পুরি
রমনা পার্কে বিকেল বেলা সময়টা কাটাই
ধনীর দুলাল-দুলালীদের হাসির শব্দ পাই
সংসদ ভবন লেকের ধারে ফুরফুরা বাতাসে
উচ্চসুরে গান গেয়ে যাই যেটাই মুখে আসে
চেহারাটা হিরোর মতো দেখে সুন্দরীরা
হয়তো ভাবে আমি সোনা মানিক কিংবা হীরা
বেশি রাতে ফিরলে বাড়ি পুলিশ ভাইরা ধরে
ছিনতাইকারী হাইজ্যাকার এই সন্দেহটা করে
কেটে যায়...।
দেশের বাড়ির খবর আসছে খারাপ বাবার শরীর
যৌতুকের কারণে বিয়ে ভেঙে গেছে পরীর
ছোট ভাইটার নামটা কাটা পড়ছে যে ইশকুলে
অভাবে দুশ্চিন্তায় মায়ের পাক ধরেছে চুলে
কি করে বুঝাই ওদের আমি অসহায়
চাকরির খোঁজে পায়ের তলার চামড়া খোসে যায়
মিলেনা তো চাকরি তবু আমি আছি সুখে
কেউ জানেনা অনেক অসুখ আছে আমার বুকে
হতাশা নিরাশা কেবল আমার নিত্য সাথী
কেউ আসেনা তাই তো আমার ঘরে জ্বালতে বাতি।
কেটে যায়...।।