চট্টলার দেয়ালে দেয়ালে বিজয়, বিপ্লব আর প্রকৃতি
'রাজা যায় রাজা আসে
ঢেউ শেষে ঢেউ
বিদ্রোহ জারি রেখো
জিতে গেলেও!'
নীল দেয়ালের ওপর লাল তুলির আঁচড়ে এই বর্ণগুলোকে দেখলে মনে হবে, কেউ যেন রক্ত দিয়ে লিখে রেখেছে! শিহরণ জাগানো এই দেয়ালচিত্রে চোখ পড়ে যায় সহজেই! সত্যিই তো তাই। এক রাজা যায় তো আরেক রাজা আসে। কিন্তু তাতে পটের বদল হয় না। রক্ত দিয়ে যেতে হয় শুধু সাধারণের। আর শিল্পী যেন সেই রক্তবর্ণ এঁকেই পথচারীকে সাবধান করে দিতে চাইলেন। জিতে গেলেও যেন প্রতিবাদী হতে ভুলে না যাই, সে বার্তাই যেন আবার স্মরণ করিয়ে গেলেন!
বলছি চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান রোডের কথা। রাজধানী ঢাকার মতো চট্টগ্রাম শহরও ছেয়ে গেছে রঙিন দেয়াল আর বিপ্লবী সব লেখায়। হলুদাভ আবিররাঙা শেষ বিকেলে পাহাড়ঘেরা এই শহরের দেয়ালজুড়ে এখন কেবলই স্বাধীনতা। যে শহরের বুকে আনাগোনা করতে করতে প্রেমে পড়ে যেতাম তার যৌবনের, সেই শহরেই যেন নতুন করে ফাগুন এসেছে। বিপ্লবের ফাগুন! শহরের আনাচেকানাচে বাকি নেই কোনো দেয়াল। রঙিন সব দেয়ালচিত্র ঠাঁই করে নিয়েছে সেখানে। হয়তো মনে হতে পারে যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো এক নগরীকে যুদ্ধ শেষে সাজানো হচ্ছে মনের মতো করে।
প্রতিটি রাস্তায়, মোড়ে মোড়ে, অলিগলিতে রঙের ছাপ। অগ্নিঝরা সব অক্ষরে অক্ষরে বিপ্লব আর স্বাধীনতার জয়গান। কিছু কিছু দেয়াল ঠিকরে যেন উঁকি দেয় বিদ্রোহ। এমন সব দৃশ্যপট দেখার প্রবল আগ্রহ ব্যস্ত পথিকেরও। তাই তো কেউ কেউ রিকশা থেকে উঁকি দিয়ে দেখছেন, কেউ রিকশা চালাতে চালাতে। কেউ কেউ আবার গাড়ি থামিয়ে সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন গভীরভাবে। হেঁটে চলা পথচারীও একবার করে তাকিয়ে দেখছেন কী আছে দেয়ালে। এ যেন এক নতুন রাঙা শহর!
সড়কে সড়কে দেখা মিলছে তরুণ-তরুণীদের। হাতে তাদের রঙের কৌটা আর তুলি। চোখেমুখে বিজয়ের উচ্ছ্বাস। মনের সুখে দেয়াললিখন করে যাচ্ছেন যে যার মতো করে। দক্ষ চিত্রকরদের পাশাপাশি এ কাজে আছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। কোনো অতিরঞ্জন নেই তাদের কাজে। সাধারণ সব গ্রাফিতিতে শক্তিশালী সব বার্তা। কেউ বিদ্রোহ সঞ্চারের নতুন বার্তা প্রদানে মগ্ন তো কেউ আবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা লিখে যাচ্ছেন অকপটে। দিনবদলের প্রত্যাশা সবার চোখে-মুখে। তবে তা অতীতকে সঙ্গে নিয়েই।
গ্রাফিতি করছেন যারা, তাদের একজন জিসানুল মাহমুদ রায়হান। উচ্চ মাধ্যমিকের এই শিক্ষার্থী শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন কাজে। আন্দোলন চলাকালীন করে গেছেন দেয়াললিখনের কাজ। তবে আগে যেখানে প্রতি সেকেন্ডেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতেন, এখন সেখানে আছে বুকভরা স্বস্তি আর গর্ব। চোখজোড়া নির্ভীক আর উচ্ছ্বসিত। চোখেমুখে কোনো সংশয় নেই, নেই জীবন হারানোর শঙ্কাও। স্বাধীন পাখির মতো মনের গহিনে লুকিয়ে রাখা কথাগুলো লিখে যাচ্ছেন দেয়ালে দেয়ালে। 'বিজয়ের রং যেমন হয়, আমাদের গ্রাফিতিও হবে তেমন। বিপ্লবের সুখ-দুঃখ পাশাপাশি থাকবে দেয়ালে,' বলেন রায়হান।
অথচ চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান এলাকায় এসব দেয়ালজুড়ে আগে ছিল নানা কার্টুন, পেইন্টিং। পোকেমন, নবীতা, বেনটেনের মতো কার্টুন আঁকা ছিলো দেয়ালে দেয়ালে। কিছুটা এখনো বর্তমান। সেসবর আশেপাশেই হতো স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কত-শত গপ্প, আড্ডা আর খোলা গলায় গান। কিন্তু এখন চিত্র অন্য। জামাল খান রোড এখন রূপ নিয়েছে নব্য বিপ্লবের। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হচ্ছে বিদ্রোহের কথা, বিপ্লবের কথা, শহীদ ভাইদের রক্তের গাথা। এমনকি তরুণ-তরুণীদের আড্ডাগুলোতেও বিষয় হয়ে উঠেছে এক একটি দেয়াল।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ছয় আগস্ট থেকেই পুরো দেশজুড়ে শুরু হয়ে যায় এই গ্রাফিতি বা দেয়াললিখন। বিশেষ করে ঢাকা আর চট্টগ্রাম শহরের সড়কে সড়কে চোখে পড়ে বিভিন্ন পেইন্টিং, গভীর বার্তা, বিদ্রোহী কার্টুন ইত্যাদি। আন্দোলনের শুরুর দিকের মুছে ফেলা দেয়ালচিত্রও নতুন করে যুক্ত করছেন শিক্ষার্থীরা। লিখে রাখছেন জুলাই-আগস্টব্যাপী ঘটে যাওয়া আন্দোলনের প্রতিটি দাবি, ঘটনা, বক্তব্য। তাদের ভাষ্যও এই: 'সবকিছু মনে রাখা হবে'।
তাই কোনো বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাওয়া, পরিত্যক্ত দেয়াল দেখলেও বসে পড়ছেন রংতুলি নিয়ে। যেমন চট্টগ্রামের রাহাত্তারপুল মোড়ের কথাই বলা যাক। গত শনিবার, ১০ আগস্ট বিকেলের দিকে মোড়ের দেয়ালে দেখা মেলে দুজন তরুণের। কোনো অগ্নিঝরা বার্তা নয়, দেয়ালচিত্র দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশের ঐতিহ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামগাথা।
আবার শহরের পিচঢালা রাস্তায় রাস্তায় নকশার মাধ্যমে শহরকে রাঙিয়ে তুলছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা! পুরো নগরীর এমন আয়োজনে যেন উৎসবের ধুম পড়েছে চারদিকে।
নগরীর ডিসিহিল, চন্দনপুরা, অক্সিজেন, অলংকার, পাহাড়তলী, চট্টেশ্বরী, জিইসি, দামপাড়া, ভাটিয়ারীসহ প্রতিটি এলাকায় চোখে পড়ে দারুণ সব দেয়ালচিত্রের। যেমন একসেস রোডে দেখা যায় মানচিত্রের গায়ে লাগা রক্তের দাগগুলো মুছে দিচ্ছেন এক যুবক। পাশের দেয়ালেই আছে, 'ঘুষ চাইলি মাইরজ্জুম', তার পাশেই, 'শোনো মহাজন, আমরা অনেকজন!'
ছিল নানা স্লোগান। 'স্বাধীনতা এনেছি যখন, সংস্কার করি', 'ইতিহাসের নতুন অধ্যায় জুলাই ২৪', 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো জুলাই', 'আমাদের দেশের ভাগ্য আমরা পরিবর্তন করব', 'আমাদের দেশ আমাদেরই গড়ে নিতে হবে, পিণ্ডির গোলামি ছেড়ে দিতে হবে'। এসেছে শহীদ মুগ্ধের কথা, 'ভাই কারও পানি লাগবে, পানি...,' বাদ যায়নি যমুনা টেলিভিশনের ভূমিকাও।
তবে এই কাজের শুরুটা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টের মধ্য দিয়ে। চট্টগ্রাম পুনঃসংস্কার এবং বিজয়ের গ্রাফিতি কর্মসূচি নিয়ে পোস্ট দেওয়া হয় একটি গ্রুপ থেকে। সেখানে পোস্টার সরানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুড়ে যাওয়া দেয়াল রং করার আহ্বান জানালে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সাড়া আসতে থাকে ব্যাপক হারে।
ফেসবুকে দেওয়া সেই পোস্ট দেখে নগরীর দামপাড়া রোডে গ্রাফিতি আঁকতে চলে এসেছিলেন রুবাইয়াৎ নওশিন (ছদ্মনাম)। চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী রুবাইয়াৎ নিজেই নিয়ে এসেছিলেন রংতুলি। এই নিয়ে মোট দুদিন কাজ করেছেন। 'আন্দোলনে যেতে পারিনি। কিন্তু এই কাজে যুক্ত হতে পেরেছি। তাই খুব ভালো লাগছে। কিছু একটা তো করলাম দেশের জন্য!'
গত ১৩ আগস্ট শহরের একসেস রোড থেকে জানে আলম দোভাষ সড়কে দুপাশের দেয়াল এবং মাঝের আইল্যান্ডসহ তিনদিক জুড়ে চলছিল এই গ্রাফিতি অভিযান। কেউ এসেছেন বন্ধুবান্ধব সাথে নিয়ে আবার কেউ কেউ ফেসবুকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করে।
'নতুন করে গড়বো বাংলাদেশ' নামের একটি ফেসবুক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জারিন তাসনিমের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, এ পর্যন্ত তারা কাজীর দেউড়ি, সিআরবি, গণি বেকারি, ডিসি মোড়, লালখান বাজারের ফ্লাইওভার, একসেস রোডে কাজ করেছেন। নিজেরা তো ব্যক্তিগতভাবে খরচ করেছেনই, অর্থ অনুদানও পেয়েছেন পাশাপাশি। ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছাড়াও আলাদাভাবে অনেকেই যুক্ত হচ্ছেন এই কাজে। নিজেদের ফেসবুক গ্রুপ থাকলেও এই কর্মসূচিগুলো রাখেন উন্মুক্ত। পুরো নগরকে বিজয়ের রঙে রাঙিয়ে তুলতে ৩০ হাজারেরও বেশী শিক্ষার্থী কাজ করেছেন বলে জানান তাসনিম।
চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়বে আরবি ক্যালিগ্রাফিও। একসেস রোডের আইল্যান্ডের লাল দেয়ালের ওপর সাদা হরফে লেখা সূরা ইয়াসিনের একটি আয়াত। যার অর্থ: আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং তিনিই হেফাজতকারী। অর্থটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন খোদ শিল্পীই। নাম তার সানজিদ আহমেদ ফারুক।
উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ফারুক বলেন, 'অনেক সময় কোনো একটি আয়াত দিয়েই ক্যালিগ্রাফি করি, আবার কখনো কখনো শুধু হরফ দিয়ে। তবে আয়াত দিয়ে ক্যালিগ্রাফিই বেশি অর্থবহ। ইচ্ছা থাকে বাংলা তর্জমা করে দেওয়ার। কিন্তু জায়গা হয় না।'
তার ভাষ্য, এখন রাস্তায় আরবি ক্যালিগ্রাফি করা হচ্ছে। মানুষও তা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখছে। অথচ কয়েকদিন আগেও প্রকাশ্যে দেয়ালে আরবি ক্যালিগ্রাফি করা অসম্ভব বিষয় ছিল। সানজিদের স্বাধীনতার সুখ ঠিক এখানেই!
চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ে পোস্টারে ঢাকা স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে আঁকা হয় জাতীয় পতাকা। লেখা হয় আন্দোলনে মারা যাওয়া ছাত্রদের নাম। আন্দোলনের সময় গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদ, আলোচিত নানা স্লোগান, গুলিবিদ্ধ ছাত্রের মর্মস্পর্শী কথা আর স্মৃতি। এরমধ্যে আছে কামানের গোলার মতো ভারী শব্দ, যেমন: 'বিবেক কোথায়?', উৎস 'মেধা', ' উই আর ওয়ান', '৩৬ জুলাই'!, কিংবা চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ ওয়াসিম আকরামের ছবি।
সংস্কারের এই কাজে একেবারেই যে ঝুঁকি নেই, তা নয়। অনেক শিক্ষার্থীর মুখে সে শঙ্কার কথাই শোনা গেল৷ কেউ কেউ উল্লেখ করলেন ১১ আগস্ট খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের সীমানা প্রাচীরে গ্রাফিতি আঁকার সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, লাঠিচার্জের ঘটনা।
শোনা যায় প্রণয় চাকমার নামও। দেয়ালচিত্র আঁকার কারণে এই শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কলেজ প্রাঙ্গন থেকেই। গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয় এই সংবাদ। সেখানে এই শিক্ষার্থীকে মারধর করার ঘটনাও উল্লেখ করা হয়।
'কিন্তু তাই বলে দমে কে? দমে গেলেই তো নিভে গেল স্বাধীনতা। নতুন যে সুর্যোদয়ের দেখা আমরা পেয়েছি, জীবন দিয়ে হলেও সেটায় ব্যাঘাত ঘটতে দেব না,' ঘোষণা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী তুর্ণার।